ছোটগল্প

গগন ঢাকির রক্ত

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:১৬

সুজন ভট্টাচার্য

        হারামজাদা গগনাটা কাটল ক’নে? মেজকত্তার হুংকারে ঠাকুরদালানের লোকজন সব্বাই চমকে উঠল। মেজকত্তার গলা বলে কথা! বয়স্করা এখনো বলাবলি করে, নতুন বিয়ের পরে রাতে তার নিভৃত প্রেমালাপের দায় থেকে বাঁচবার জন্যই লজ্জায় নাকি তার বাপ জীবন ভুঁইঞা ফের বাগানবাড়িতে রাত কাটাতে শুরু করে। আর তাতেই নাকি বাগদিপাড়ার রূপীর কপাল ফিরে যায়। এই কাহিনীর সূত্রপাতের ক্ষেত্রেও তার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।

মেজকত্তা ঠাকুরদালানের সামনের সিঁড়িতে অস্থির হয়ে দাপাদাপি করতে থাকেন। ভোলা চক্কোত্তি পুরোহিতের আসনে বসেই একবার মিনমিনে গলায় বলতে চেষ্টা করে, - ও আসপে খনে...
  মেজকত্তা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ভোলা চক্কোত্তির গলা বসে যায়। আধখানা কথা গিলে ফেলতে গিয়ে তার কাশি পায়। আবার মেজকত্তা হামলে উঠবে ভয়ে সে কাশি হজম করার চেষ্টা করে। ফলে বেশ একটা হালকা শব্দ করে খানিকটা বায়ুত্যাগ হয়ে যায়। ভোলা ভেবেছিল কেউ টের পায় নি; কিন্তু মেজকত্তার ছোটশালীর গাব্দাগোব্দা মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হেসে ফেলে। ভোলার লজ্জায় মাথা কাটা যায়। শালা! মেজকত্তার এই মোগলাই মেজাজের জন্য আজ এই মেয়েটার কাছে ওর পেস্টিজ পাংচার হয়ে গেল!!

মেজকত্তা যখন দাপাতে থাকেন, তখন এই হরিহরপুর গ্রামের সাধারণ নিয়ম হল যে আর সবাই পারতপক্ষে তার ছায়া মারাবে না। কিন্তু পুজোগন্ডার বাড়িতে কি আর সে নিয়ম মানা সম্ভব! তাই প্রতি মিনিটে গড়ে দেড়জন করে মেজকত্তার সামনে পড়ে যাচ্ছে। আর গাণিতিক নিয়ম মেনেই সেকেন্ডখানিক সময়ের মধ্যেই গগন ঢাকিকে খোঁজার নামে তারা একেকজন বিশ্বব্রহ্মান্ডের বিভিন্ন কোণের অভিমুখে কেটে পড়ছে। 
   - অ্যাই শালা কাঁসরের বাচ্চা! তোর ঢাকি হারামজাদা ভাগছে ক’নে? মেজকত্তা গগন ঢাকির সঙ্গী পুঁচকে ছোঁড়াটাকে নিয়ে পড়েন। ছোঁড়াটা ঢলঢলে জামা আর বোতামহীন প্যান্ট সামলাতে সামলাতে গতকাল সন্ধ্যে থেকেই গগন ঢাকি যখনি ঢাকের উপর হামলে পড়েছে, তখনি ছোট কাঁসরটায় কাঁই-নানা কাঁই-নানা বোল তুলে এসেছে। কিন্তু সে বেচারাও ঠিক জানে না, ঢাকি গেছে কোথায়। ফলে মেজকত্তার হুংকারের সামনে সেও চুপ করেই থাকে।

পরিস্থিতি ক্রমশ গরম হতে হতে মে মাসের ল্যু আক্রান্ত দুপুর হয়ে যাচ্ছে দেখে মেজকত্তার মুম্বাই প্রবাসী স্মার্ট ন-জামাই আসরে নেমে পড়ে। 
      -ঢাকির কথা ছাড়ুন বাবা; ঢাক তো আছে। আমিই বাজিয়ে দিচ্ছি।
মেজকত্তার ন-মেয়ে বুলিকে তার সেজ জামাইবাবু কনুই দিয়ে একটা সেমি-ভালবাসার গুঁতো দিয়ে বলে, - তোমার কত্তার তো মেজাজ এসে গেছে দেখছি!
  ন-জামাই গতকালই মুম্বাই থেকে এসে “ল্যান্ড” করেছে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এই প্রথম পুজো উপলক্ষ্যে আসা। আসা থেকেই সেজ-ভায়রাকে একটু বেশি বেশি করে বুলির গা ঘেঁষে চলাফেরা করতে দেখে এমনিতেই তার অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে আছে; সুযোগ পেলেই গান্ডুটাকে এমন সাইজ করে দিতে হবে যে শালা সার্কাসের জোকার হয়ে চোক করে যাবে।
অজয় দেবগণ মার্কা একটা হালকা উদাস হাসি ঠোঁটের কোনায় ঝুলিয়ে ন-জামাই সামান্য নিচু হয়ে ঢাকের মোটা দড়িটা তুলতে তুলতে বলে - আরে দাদা, আমরা হলাম মুম্বাইয়া; গণেশ চতুর্থীতে এমন ছোটখাটো নাচানাচির অভ্যাস আমাদের আছে। আমাদের শুধু কনুই চলে না; গোটা হাতটাই চলে। 
সেজ-জামাইকে হেভি আপারকাট দেওয়া গেছে ধরে নিয়ে ন-জামাই হৃষ্টচিত্তে ঢাক তুলে প্রায় কাঁধে নিয়ে ফেলেছে, এমন সময়ে মেজকত্তা ফের সিনে এন্ট্রি নিয়ে ফেলেন।
   -আরে, আরে, ছ্যামরায় করে কি!
জামাইদের শখ-আহ্লাদে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা ভুঁইঞা বাড়ির রীতি নয়। কিন্তু মেজকত্তার গলায় যেটুকু তিক্ততা ছিল, মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করা ন-জামাইয়ের তা পড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হল না। তাই সে দ্রুত ঢাকটা নামিয়ে রাখে।
  -সে কি গো বুলুসোনা, জয়ন্তর গণেশ-মার্কা নাচ আর দেখা হবে না! সেজ-জামাই টিটকিরি কাটে। ন-জামাই শ্বশুরের দিকে ফিরে তাকায়। মেজকত্তার ভূমিকা যে তার ভাল লাগে নি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তা পরিষ্কার।
    -ঢাকটা আমি বাজালে কি কোন অসুবিধে হত, বাবা? 
   মেজকত্তা কিঞ্চিৎ ফাঁপরে পড়েন। জামাই না হয়ে অন্য কেউ হলে একটা ধমক লাগিয়ে দিলেই হত। কিন্তু জামাইকে আর যাই হোক, ধমক দেওয়া যায় না। তার উপর হরিহরপুর গ্রাম থেকে হাজার মাইল দূরের জামাইকে তো নয়ই। হাজার হোক, মেয়েটার সুরক্ষার বিষয় তো আছে। কিন্তু এতলোকের সামনে বিষয়টা বলেন কিভাবে! জীবনে এই প্রথম মেজকত্তার তার বাবা জীবন ভুঁইঞার উপর ভয়ংকর রাগ হল। বাপ না হলে চুটিয়ে শুয়োরের বাচ্চা বলে খিস্তি করা যেত। আরে, গাঁ-গঞ্জে অমন দু-চারটে মাগি সব পয়সাওয়ালাই পোষে। কিন্তু তাই বলে তার ছাওয়ালরে কেউ বাড়ির মধ্যে আসন পাতিয়ে দেয় নাকি! 
   আসলে মেজকত্তা জানেন, এই নিয়ে বেশি নাড়াঘাঁটা করতে গেলে তার ঘাড়েও দায় আসবে। নতুন বৌ নিয়ে বিয়ের পরদিন থেকেই তার হাঁকডাকের কারণেই জীবন ভুঁইঞা বাগানবাড়িতে পার্মানেন্ট আশ্রয় নেয় বলেই পাবলিক জানে। আশ্রমের জীবনে সাংসারিক সুখ অব্যাহত রাখার জন্য মোহন বাগদীর ডবকা বৌ রুপীকেও নিয়ে আসা হয়। রুপীর কিলো-কিলো মাংসস্তুপের মধ্যে জীবন ভুঁইঞা মহানন্দে সংগ্রাম – ঐক্য – সংগ্রাম তত্ত্বের পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকে।

   বিষয়টা এই পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল। মুশকিলটা হল রুপী হঠাৎ করে পেট বাঁধিয়ে ফেলায়। মেজকত্তার বৌ তখন নিজেই সাত মাসের সাধ মিটিয়ে মনের সুখে পেট ঢোল করে রেখেছে। ফলে বাপ-ব্যাটার জোড়া কীর্তি নিয়ে আশপাশেও বেশ ভালরকম কেচ্ছার কারবার চালু হয়ে যায়। জীবন ভুঁইঞাকে হরিপদ মাস্টার, বাড়ুয্যে বাড়ির ছোটখুড়ো, সকলেই পরামর্শ দিয়েছিল আপদ খালাশ করে দিতে। এমনকি মেজকত্তার মা-ও লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন কাঁদতে কাঁদতে জীবন ভুঁইঞাকে বলেছিলঃ- যা করিছো, কিছু কই নাই। কিন্তু এতবড়ো সব্বোনাশ কোরো নি গো!

    জীবনকে রুপী কি টুপি খাইয়েছিল, কে জানে; কারুর পরামর্শই সে কানে তুলল না। অবশেষে মেজকত্তার বড়মেয়ে টুনি আর রুপীর গভ্ভের সন্তান গগন ট্যাঁট্যাঁ করে দুনিয়ার কাছে নিজেদের হাজিরা পেশ করে।

  জীবন ভুঁইঞা বাগানবাড়ির মাঠে তখন পৌষের রোদ্দুরে গুষ্ঠিসুখ উপভোগ করছিল। গগনের বয়স হবে বছর-পাঁচেক। পোষাকআশাক জীবন ভুঁইঞার সন্তানের উপযোগী হলেও, বামুন বা কায়েতপাড়ার কোন ছেলে তার সঙ্গে খেলে না। ভারতীয় গ্রামসমাজ বাইরে যতই বাপের দাপ দেখানো হোক না কেন, অন্তরে আসলে মায়ের কাঁথার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। আসলে, জমিতে কে হাল দিল, সেটা কথা নয়; জমিতে ধান হবে, না পান, সে তো জমির উপর নির্ভর। আর তাই জীবন ভুঁইঞার ছেলে হলেও গগনের আদত পরিচয়লিপি রুপী বাগদীর ছাওয়াল হিসাবেই বিস্তৃত হতে থাকে।

      সেদিন গগন কি হিসাবে কে জানে সোজা গিয়ে হাজির হয়েছিল বামুনপাড়ার মাঠে। মাঠে কয়েকটা ছেলেপুলে তখন বাতাবিলেবু নিয়ে ফুটবলের কাছাকাছি কিছু একটা খেলার চেষ্টা করছিল। বাতাবিলেবুটা হঠাৎই এসে পড়ল গগনের পায়ের কাছে। ভারতীয় গ্রাম-সমাজের বর্ণবিশ্লেষণ ঠিকঠাক হজম না হবার কারণে গগন সেই লেবুতে একটা লাথি লাগিয়ে দেয়। আর সেই অস্পৃশ্য লাথিযুক্ত বাতাবিলেবু সোজা গিয়ে লাগল হরিপদ ভটচাযের নাতির মাথায়।

      জেবন, তুমি তোমার মাগি নে যা খুশি করগে যাও; কিন্তু আমরা গরীব ব্রাহ্মণসন্তান, আমাদের উপর উৎপাত কর কেন! হরিপদ ভটচায সবদিক সামলে-সুমলে বলে। হাজার হোক, জীবনের পয়সা এবং জমিজমা, দুইই আছে।

     -কি করি বলেন ভটচায মশায়! ওইটুকুনি ছাওয়াল, কথা শুনতি চায় না।

    -সে কয়ে তো লাভ নাই, বাবা জেবন। ধম্মের নিয়মকানুন, সে তো সকলেরই মানি চলতি হবে।
   -আমার ছাওয়াল হলিও তার ছার নাই! অসহায় লাগে পরাক্রমী জীবন ভুঁইঞার ক্লান্ত কন্ঠস্বর। 
রাতে রুপী বাগদিনী নিজের শরীরে জীবনকে পুরোপুরি আটকে রেখে সরাসরি প্রশ্ন করেঃ- গগনির কি হাল করি যাবা? তোমার ছাওয়াল হয়ি ওরেও কি জন খাটি খাতি হবে? 

জীবন বুঝতে পারে সবই। বুঝতে পারে, গগনকে জাতে উঠতে দেওয়া হবে না। হাজার-হাজার বিঘে জমি বিলিয়ে দিলেও না। আর তাই রুপীর শরীরের বিভিন্ন ফাঁকফোকরের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে জীবন গগনের জন্য নতুন পথের খোঁজ করে যেতে থাকে। 

খানিকটা জায়গা-জমি দিয়ে দেওয়াটা কোন সমস্যা নয়। সমস্যা হল রেজিস্টারি করা। গগনের নাম কি হবে? গগন বাগদী, নাকি শ্রী গগনচন্দ্র ভুঁইঞা! শেষে ভূদেব মাষ্টারের কথামত নিচুভিটের টানা জমি দেবোত্তর করে দেওয়া হল দুর্গাপূজার বাজনদারের সংসার নির্বাহ করার জন্য। আর বংশপরম্পরায় গগন ঢাকিই হবে মায়ের আবাহনের সংবাদ সর্বত্র পৌঁছে দেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাকে বা তার রক্তের সম্পর্কযুক্ত কাউকে ছাড়া মায়ের বোধন সম্পূর্ণ হবে না।

জীবন বেঁচে থাকতে গগনকে একবারও ঢাক ধরতে হয় নি। বাগানবাড়িতে প্রবল ঝড়বৃষ্টির এক রাতে জীবন ভুইঞার জীবনকাহিনী শেষ হয়ে যায়। গগন জানত, এই বুড়োটা তারও বাবা। ফলে তারও কিছু কাজকর্ম আছে। কিন্তু পরদিন খবরটা পাওয়ামাত্রই মেজকত্তা ময়দানে নেমে পড়েন এবং প্রবল কান্নাকাটি সহযোগে বাবার শব, রুপী বাগদিনী ও গগন ঢাকিকে একইসঙ্গে বাগানবাড়ি থেকে বার করে আনেন। রুপী অনেক কায়দা করেছিল। এমনকি মেজকত্তাকে ছাওয়াল বলে ডেকেও ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মেজকত্তা হলেন মেজকত্তা। বাপের দাপ মাইনাস মেয়েছেলের টান, দুয়ে মিলে তিনি পুরো ব্যাপারটা সামলে নিলেন।

 গগনের কাহিনী এইখানেই শেষ হয়ে যেত, মেজকত্তার মা হঠাৎ করে এইসময়ে পিকচারে চলে না এলে। ভারতীয় নারীর জন্মগত সমস্যা অর্থাৎ ক্রনিক অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় রক্তের প্রতি তার টান তিনি অনুভব করতে আরম্ভ করেন এবং মেজকত্তাকে নির্দেশ দেন, জমিজমা ব্যাপারটা তিনি বোঝেন না; কিন্তু তার মৃত স্বামীর ইচ্ছামত পুজোতে গগনই ঢাক বাজাবে। অতএব, সেই ষাটের দশকের সিনেমার চিত্রনাট্যের ধারা মেনে আজ এই মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বোধনের সময় গগন ঢাকি অনুপস্থিত।

আশ্চর্যের বিষয় হল, গগন খানিক আগেও ঢাক বাজিয়েছে। গেল কোথায়! পুজোদালানে সবাই খুব অবাক হয়েই যায়। এমনও নয় যে গগন জানে না কখন কি হবে। তাহলে!
    -অই যে, আসতিছে। কাঁসির বাচ্চাটা চেঁচিয়ে ওঠে। 

হ্যাঁ, গগনই আসছে বটে; কিন্তু এ কি দশা! যেন পায়ে জোর নেই, কোনরকমে টলমল করতে করতে আসছে।মেজকত্তা পর্যন্ত এতটাই আশ্চর্য হয়ে যান যে স্বভাবভঙ্গীতে গালিগালাজ না করেই স্রেফ টলমল করা গগনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। গগন টাল খেতে খেতে একটা থামের সঙ্গে প্রায় ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে যায়। 

-গগন, তোর হইছে ডা কি? মেজকত্তার এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরে আসে। এতক্ষণ আছিলি কোন চুলায়?
   গগন কোনরকমে ঢোঁক গিলে বলে,- আজ্ঞা, প্যাডটা বড্ড হাঁকুপাঁকু করতিছে, তাই মাঠে গ্যাসলাম।

-এতক্ষণ লাগায়ে দিলি শুয়ার! মেজকত্তা এতক্ষণে যেন ফর্মে ফিরে আসেন। 

-কি করুম কন! মাঠে গিয়া সারি, সঙ্গে সঙ্গেই জ্যান নতুন কইর্যা  চাপ আসতি লাগে।
   -হারামজাদা, দুপুরে খাইছিলি কি?

গগন চুপ করে থাকে। মেজকত্তা ফের হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন,- ত’রে কাল সিধা দেয় নাই? চাউল আর ডাইল?  
গগন মাথা নিচু করে থাকে; কোন জবাব দেয় না।
     -কি হইল কি? জবাব দ্যাস না ক্যান?
     -আজ্ঞা দিছিল। এতক্ষণে গগন উত্তর দেয়।
     -হেইগুলান কি শুয়ার তুমি বিলাইয়া দিছ? 

গগন আবার চুপ করে যায়। এইবারে আসরে নামে মেজকত্তার সেজ জামাই। গগনের পিঠে আলতো একটা চাঁটি বুলিয়ে দিয়ে সে বলে, 
      - ঠিকঠাক বল তো বাপধন, ঠিক কি হয়েছে!
সেজ জামাই-এর শহুরে কথার ভাঁজে গগন বলেই ফেলে, চালডাল ঠিকঠাক পেলেও সেগুলো রান্না না করে বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে রেখে দিয়েছে। দুপুরে ও রান্নাঘর থেকে যে ভাত পুকুরপাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তারি খানিকটা তুলে এনে খেয়েছে।
       -কস কি হারামজাদা! তুই পুকুরপাড়ের নোংরা কুত্তার ছুঁয়া ভাত খাইয়া ঠাকুরদালানে আইসস! তরে শালা আমি কুত্তা দিয়া খাওয়ামু! মেজকত্তা রাগে গরগর করে ওঠেন। 
       সেই রাগের গমকেই কিনা কে জানে, গগন হঠাৎই ‘অরে বাবারে’ বলে চিৎকার করে ওঠে। আর তারপর কাউকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই হুড়হুড় করে বমি করে ফেলে। একটা টকটক গন্ধে গোটা ঠাকুরদালান ম-ম করে ওঠে।
       মেজকত্তার দাপাদাপিতে দু-চারটে চাকরবাকর মিলে ধরাধরি করে গগনকে সরিয়ে নিয়ে যায়। জল ঢেলে জায়গাটা ধুয়েও ফেলা হয়। সবকিছু আবার ঠিকঠাক হয়ে গেলে দেখা গেল সেই আগের মতই গগন ঢাকি নেই।
     -মাইজ্যা কত্তা, লগন কিন্তু পারাইয়া যাইব! ভোলা পুরুত ভয়ে ভয়ে বলে।
     -হ্যা তো জানি। কিন্তু ঢাক বাজাইব কেডা?
     -আমি বাজাব, বাবা? ন জামাই এবার আসরে নেমে আসে। মেজকত্তা ন জামাই-এর মুখের দিকে তাকান। তারপর    বলেন,- সে উপায় নাই। গগন ঢাকির রক্ত আছে, এমন কাউরে লাগব। আমার বাপের আদেশ।
     সেজ জামাই নাক গলিয়ে দেয়,- একবার খোঁজ করলে হয় না, ওর কে কে আছে? মেজকত্তা পাথরের মত মুখ করে করে বলেন,- ওর কেউ নাই। 

ভোলা পুরুত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। মেজকত্তার সামনে এসে বলে,- কত্তা, সময় প্রায় আর নাই কইলেই হয়। আর কথা বাড়ায়েন না। আপনেই না হয় ঢাকটা ধরেন গিয়া।

মেজকত্তার মনে হয় যেন আচমকাই প্রকাশ্যে তার ধুতিখানা খুলে নেওয়া হয়েছে। ভোলা পুরুত যে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে দুম করে জামাইদের সামনে বলে বসবে, এ শালা কে জানত! দুই জামাই একবার ভোলা আরেকবার মেজকত্তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আর মেজকত্তা! ভোম মেরে দাঁড়িয়ে আছেন।
     -মাইজ্যাকত্তা, দেরি করনের আর সময় নাই। আসেন! এই বলে ভোলা মেজকত্তার হাতদুটো ধরে তাকে টেনে নিয়ে আসে ঢাকটার কাছে। 
    - নেন, কত্তা, শুরু কইর্যাভ দেন! আপনের বাপের হুকুম, গগন ঢাকির বংশের লোক না বাজাইলে মায়ের বোধন হইব না। ন্যান, ন্যান, আর সময় নাই। ভোলা পুরুত লাফ দিয়ে গিয়ে আসনে বসে পড়ে। 
মেজকত্তা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে পড়েন। বাপের হুকুম...... গগন ঢাকি........ বোধন......
    -আর দেরি কইরেন না! ন্যান, ধরেন! ভোলা যেন ব্যান্ড মাস্টারের ইন্সট্রাকশন দেয়। 
    -ও......ম...... ভোলার কন্ঠ যেন গমগম করে ওঠে। মেয়েরা উলুধ্বনি শুরু করে। কয়েকজন শাঁখও বাজাতে শুরু করে।
    -কই! হইল মাইজ্যা কত্তা, ঢাকটারে বাজান! 

মেজকত্তা বিহ্বলমুখে ঢাকের গায়ে কাঠিদুটো আছড়ে দেন। ড্যাং – ড্যাড্যা ড্যাং- ড্যাড্যাং – ড্যাড্যাং বোলে কাঠিগুলো মেজকত্তার হাত ছুঁয়ে গম্ভীর শব্দ তুলতে থাকে। বাচ্চা কাঁসুরেটাও কাঁসর নিয়ে কাঁইনানা- কাঁইনানা করে সঙ্গত দিতে শুরু করে। 
দালানের বাইরে মাঠের মধ্যে গগন ঢাকি চিৎ হয়ে পড়েছিল। আচ্ছন্ন তন্দ্রার মধ্যেই সে হঠাৎই বিড়বিড় করে ওঠে,- জয় মা!

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত