বাংলার গণসঙ্গীতের শেকড় সন্ধান

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০১৭, ১২:১০

প্রদীপ ঘোষ

লোকসমাজ থেকে উঠে আসা লোকায়ত ভাষায় লোককবিদের রচিত ও গীত সঙ্গীতকেই বলে লোকসঙ্গীত। লোক মানুষের নিজস্ব ভাষায় যার উপস্থাপন। প্রান্তীয় মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, সমস্যা-সংকটের প্রতিকারের তাগিদে সহশ্র বছর ধরে সৃষ্টি হয়েছে এই গান। লোকগানের স্রষ্টা যারা তারা আমাদের গ্রামীণ জীবনের খেটে-খাওয়া শেকড়ের মানুষ। ধান কাটতে কাটতে, নৌকা বাইতে বাইতে, হাল চষতে চষতে অথবা মাছ ধরতে ধরতে শ্রমমুখর মানুষ সৃষ্টি করেছেন এই গান হাজার বছর ধরে। উৎস-সন্ধানে লোককবিদের গভীরে রয়েছে কঠিন শ্রমকে সহজতর করা ও আনন্দ লাভের মধ্য দিয়ে শ্রমকে উপভোগ করার আকাঙক্ষা। লোকায়ত মানুষের হৃদয়ের এই গীতকেই আমরা বলি লোকসঙ্গীত। 

লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকে ও বিষয়বস্তুতে রয়েছে প্রকৃতি প্রেম, দেহতত্ত্ব, বিরহ ভালোবাসা ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ব্যঙ্গবিদ্রুপ। রয়েছে শ্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিষয়বস্তুর প্রকরণ। শ্রেণিবিভক্ত গ্রামীণ সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে বারবার প্রতিরোধ গড়েছে লোকসঙ্গীত। 

সমাজতাত্ত্বিকরা মনে করেন, মানব সৃষ্টির প্রথম যুগে আদিম মানবেরা যেসব শব্দ ব্যবহার করত সেগুলোই নানা ধ্বনির সাহায্যে সৃষ্টি করেছিল কথার। এভাবেই জন্ম হলো ভাষার। মানুষ প্রাণী থেকে ক্রমশ হলো স্বতন্ত্র। জন্ম দিল সভ্যতার।  কথা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে বশে আনতে শুরু হলো নানা আচার-অনুষ্ঠান। ভয় থেকে জন্মাল ভক্তি, যা প্রকাশ পেল নানা ব্রত অর্চনা ও নানা ধরনের পূজার মধ্য দিয়ে। এসব ব্রত অর্চনায় আদিম মানুষ ব্যক্ত করত বিভিন্ন সুর। স্বভাবতই আদিম মানুষসৃষ্ট সুরই হয়ে উঠল লোকসঙ্গীতের প্রাথমিক স্তর। সমাজ বিবর্তনের ধারায় পরিবর্তিত মৌখিকভাবে গড়ে ওঠা লোকসঙ্গীত প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে লোক মানুষের চাহিদা মিটিয়েছে ভাব ভাষা ও সুরের বৈচিত্র্য নিয়ে। তাই উত্তর বাংলার চোর-চুন্নি পালাগান, ভাওয়াইয়া, চটকা, মেচেনি, জাগ গান, গম্ভীরা গান, রাঢ় বাংলার ভাদু, টুসু, ঝুমুর, তরজা গান, দক্ষিণ বাংলার সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট বনবিবির গান, দক্ষিণরায়ের গান, ভাটিয়ালি, পীরের গান, বয়াতি, জারি,সারি গানে আমরা খুঁজে পাই ব্রত-ভক্তি ভালোবাসা ও প্রতিবাদের নবতর বিন্যাস। সময়ের সাথে সাথে লোকসঙ্গীত দাঁড়িয়েছে সমাজের প্রতিকূল বাতাসের বিপরীতে।

প্রাচীনকালে একসময় পথে বের হতো নানা রকম ‘সঙের’ দল। এই লোকশিল্পীরা মানুষকে জানাতো আঞ্চলিক কোনো অত্যাচার ও নিপীড়নের কথা তাদের গানে। জেলে পাড়া, কাঁসারি পাড়া, চালতা বাগান প্রভৃতি স্থানে সঙ ছিল খুবই জনপ্রিয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ও এমনই এক শ্লেষাত্মক ছড়াগান ছিল সঙের দলের মুখে মুখে। 

আজব শহর কোলকাতা
ওড়ী-বাড়ী-জুড়ী-গাড়ী            মিছে কথার কি কেতা।
হেতাঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে         বলিহারি ঐকতা;
যত বকবিড়ালে বেক্ষজ্ঞাণী            বদমাইসির ফাঁদপাতা
পুঁটে তেলির আশা ছাড়ি            শুড়ী সোনার বেনের কড়ি
খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ী        ভদ্রভাগ্যে ঘোলপাতা।

ইংরেজ বণিকরা এ দেশে আসে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য । ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পরাজয়ের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানরি হাতে দখল হয়ে যায় বাংলার শাসন। দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতা হারালো এ অঞ্চলের মানুষ। লোককবিরা গ্রামে-গঞ্জে পথে-ঘাটে লোকসঙ্গীতের অস্ত্রকে শানিত করেছিলেন তাদের লোকগানে। বয়াতি গানে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রান্তিক মানুষের মনে বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা। সমস্ত কাহিনীকে বিবৃত করেছিলেন এই ভাবে;

কি হইলরে’ জান।
পলাশীর ময়দানে নবাব হারাইলো পরাণ।।
তীর পরে ঝাঁকে ঝাঁকে, গুলি পড়ে র‘য়
একলা  মীরমদন বল কত নেবে সয়ে।।
ছোড ছোড তেলেঙ্গাগুলি নাল কুর্তি গায়
হাঁটু গাইরা মাইরছে তীর মীরমদনের পায়।।
কি হইলরে’ জান।
পলাশীর ময়দানে নবাব হারাইলো পরাণ।।

সমস্ত ভারত দখলের পর শুরু হলো ইংরেজদের অত্যাচার। ফসলের জমিতে নীল চাষে বাধ্য করল গ্রামের অসহায় চাষিদের। শিল্পবিপ্লবের স্বার্থে সমস্ত বাংলাজুড়ে জোরপূর্বক নীল চাষে বাধ্য হওয়া কৃষকরা শিকার হলেন নানা ধরনের অত্যাচার, হত্যা ও অপহরণে। ভেঙে পড়ল তৎকালীন গ্রামীণ অর্থনীতি। প্রতিবাদে মুখর হলো চাষিদের চেতনা। ১৭৭৮ সাল থেকে শুরু হয় বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নদিয়ার বিশ্বনাথ সর্দার, বিষ্ণু চরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর সর্দার। শুরু হয় ইংরেজদের দমন নির্যাতন। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বিশ্বনাথ সর্দারকে। অন্যদিকে শুরু হয় জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার কাজ।

এই পরিস্থিতিতে  জন্ম হলো লোকমানুষের গণসঙ্গীত
জাত মাল্লে পাদ্রী ধরে
ভাত মাল্লে নীল বাঁদরে
ব্যারাল চোখো হাঁদা হেসদো
নীলকুঠির নীল মামদো।।

হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। সেই সময় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় এর প্রতিবাদে প্রবন্ধ ছেপেছিলেন। শুধু তাই নয়, নীলচাষিদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আইনগত লড়াই করতে করতে সর্বস্বান্ত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো সমাজবিপ্লবীরা আজ ইতিহাসের অন্তরালে চাপা পড়ে আছেন। নীলচাষিদের ওপর অত্যাচারের চিত্র চিত্রায়িত করেছিলেন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র।  লিখেছিলেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক । ইংরেজি ভাষায় এ নাটক প্রকাশ করার দায়ে প্রকাশক রেভারেন্ড জেমস লঙকে কারাদ- দেওয়া হয় সেই সময়। আর ঠিক সেই সময়ে কোনো এক লোককবি গাইলেন, 
নীল বাদরে সোনার বাংলা
করলো এবার ছাড়খার।
অসময়ে হরিশ মল
লঙ এর হলো কারাগার।।
প্রজার প্রাণ বাঁচানো ভার।।

১৮৪০ সালে খুলনার কয়েকটি চরে নীল চাষের হুকুম জারি করেছিলেন রেইনি নামের জনৈক ইংরেজ কর্মকর্তা। প্রতিরোধ গড়ে তোলেন কৃষকরা। এই প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন বিশ্বনাথ ঘোষ ও সাদেক মোল্লা। তাদের প্রতিরোধে পিছু হটে ইংরেজরা। এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে তৎকালীন লোককবিদের গানে। 

গুলিগোলা সাদেক মোল্লা
রেণীর দর্প করলো চুর।
বাজিল বিশ্বনাথের ডংকা
ধন্য বাঙলা বাঙালী বীর।।

লোককবি নিবারণ পণ্ডিত ১৯৬০ সালে নীল নির্যাতনের অবস্থা নিয়ে তৈরি করেন অসাধারণ এক জারি গান। গ্রাম থেকে গ্রামে জনমানসে এই জারি গানের মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সৃষ্টি করেন ঘৃণা। জাগিয়ে তোলেন লোকশক্তিকে। কিছু অংশ উদ্ধৃত হলো: 

ধূয়া-হারে ও নীলকরে করলো সর্বনাশ
ধনে প্রাণে চাষিকুল হইলো বিনাশ।
মূল গায়েন-    হায় হায়  রে-
শুনা কথা বলছি ভাইরে শুন দিয়া মন
বহুদিনের কথা এটা অতি পুরাতন
প্রাচীনকাল হইতে বাংলায় হইত নীলের চাষ
নীলচাষ করিয়া চাষির চলতো বারমাস।
হায়, হায় রে--।
কোম্পানীর আমলে নীল সাহেবগুলো এলো
নীলচাষিদের ঘরে ঘরে আগুন জ্বালাইলো
সেই আগুনে পুড়ে দেশটা হইলো আঙ্গার
ছারখার হইলো কত সুখের সংসার।।
---------ইত্যাদি।

দিনাজপুর জেলায় এক রাজার মৃত্যুর পর ইংরেজ কোম্পানি রাজার নাবালক পুত্রের প্রতিনিধি হিসেবে দেবী সিং নামক এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেন। ১৭৮১ সালে সেটেলম্যান্টের সময়  রংপুরের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল দখল করে নেন এবং বিভিন্ন কর আরোপ করেন। কৃষকরা দিশেহারা হয়ে অলংকার, জমিজমা এবং সন্তান-সন্ততি বিক্রি করে করের টাকা শোধ করতে বাধ্য হন। আদালতের দ্বারস্থ হয়েও গ্রামীণ কৃষকরা বিচার বঞ্চিত হতেন। এমন এক পরিস্থিতিতে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এই বিক্ষোভ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে সারা উত্তর বাংলাজুড়ে। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে বাঁকুরা, বিষ্ণুপুর ও বীরভূমেও। প্রজারা দেবী সিং-এর কিছু লেঠেলকে হত্যা করে ঘোষণা দেয় যে তারা আর খাজনা দেবে না। এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ধীরাজ নারায়ণ, শিবচন্দ্র নন্দী, নুরুলুদ্দীন, ইসরাইল খাঁ প্রমুখ নেতারা। এ বিদ্রোহের কথা আমরা খুঁজে পাই রতিরাম দাসের ‘জাগের গানে’। গানটি ছিল এমন,
শিবচন্দ্র নন্দী কয় শুন প্রজাগণ
রাজার তোমরাই অন্ন, তোমরাই ধন।।
রঙ্গপুরে যাও সবে হাজার হাজার
দেবী সিং এর বাড়ি লুট, বাড়ি ভাঙ্গ তার।।
শিবচন্দ্রের হুকুমেতে সব প্রজা ক্ষ্যাপে
হাজার হাজার প্রজা ধায় এক খ্যাপে
লাঠি নিল খন্তি নিল নিল কাঁচি দাও
আপত্য করিতে আর না থাকিল কাও।। ইত্যাদি

১৮৫৫ সাল। বাংলার সর্বপ্রাচীন আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায় অরণ্যের অধিকার ভোগ করে আসছিল হাজার বছর ধরে। ইংরেজ বেনিয়ারা সে অধিকার উচ্ছেদের পাঁয়তারা শুরু করে। ১৭৮৪ সালে  এর বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়ায় সাঁওতাল নেতা বাবা তিলকা মাঝি। ভাগলপুরের কাছে তিলকপুরের জঙ্গলে ইংরেজ সেনাবাহিনী তিলকা মাঝি ও বেশ কিছু সাঁওতালকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে।এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে সাঁওতাল আদিবাসীদের মনে। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন  সাঁওতাল পরগোনার ভাগনাডিহি গ্রামের মাঠে এক জনসভায় সাঁওতাল নেতা সিধু আর তার ভাই কানু এক সাঁওতাল স্বাধীন রাজ্যেও ঘোষণা দেন। প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল এ সভায় স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করে শপথ গ্রহণ করে। ঐ দিনই অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদে দশ হাজার সাঁওতাল রওনা দেন কলকাতার পথে মিছিল করে। লোককবিরা সেই কাহিনী বিবৃত করলেন তাদের গানে এভাবে-

ভাই বলি তাই সভাজনের কাছে
গুভাবাবুর আদেশ পাঁয়ে সাঁওতাল ক্ষেপেছে।
আছে সব জড়ো হয়ে--
আছে সব জড়ো হয়ে, পূর্ব মুখে তির মারিছে গাছে
কতশত কর্মকার সঙ্গেতে এইন্যাছে।
তীরের ফলা বানাইছে।।

এর পরে এলো সিপাহি বিদ্রোহ। আগুন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল। এই যুদ্ধেছড়িয়ে পড়েছেিলন পঞ্চকোটের অন্তর্গত কাশিপুরের জমিদার বা রাজা নীলমোহন সিং বা নীলমণি সিংদেও। এজন্য ইংরেজ সরকার নীলমণি সিংদেও-কে আলিপুর জেলে বন্দি করে। রাঢ় অঞ্চলের ভাদু আর টুসু গানে এই ঘটনার প্রভাব। রাজা নীলমোহন বা নীলমণি সিংদেওকে বাহবা দিয়ে লোকশিল্পীরা গান বেঁধেছেন ভাদু উৎসবে-

হায় একী হইল, সিপাই পল্টন খেপিল 
চারিদিকে মার মার কাট কাটযত সিপাই খেপ্যেছে
কাশিপুরের মহারাজা মহল ছাড়্যে আস্যেছে।
কাশিপুরের মহল ছিলছিল সুখের বিন্দাবন
সে মহলে ঘাস বিরালোকি কইরেছে নীলমোহন।
ভাদু গানেও যেমন,টুসু গানেও তেমনই ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন পুরুলিয়া,মানভূমের সাধারণ মানুষ। তারাও কাশিপুরের রাজা নীলমণি সিংদের বীরত্ব কাহিনী প্রচার করেছেন টুসু গানের মাধ্যমে।
কাশীপুরের মহারাজা ধনী নীলমহন
তুমার কাছে হার মানল রাঙামুখা পল্টন।
সিপাইরা সব লুট করল পুরুল্যার খাজাঞ্চিখানা 
রাঙামুখা সাহেবগুলার হল কিগো লাঞ্ছনা।
পল্টনরা  এগাই আল্য যাবেক রগুনাথপুর 
তুমি তাদের বাধা দিলে হুকুম দিলে করতে দূর।
প্রাণ বাঁচাতে ফিরে গেল যত সাহেব পল্টন
কাশীপুরের মুহারাজা ধন্য নীলমহন।

লক্ষণীয় বিষয় এই যে রাঢ় অঞ্চলে ভাদু বা টুসু গান সাধারণত মেয়েরাই গায়,নিজেরাই গান বাঁধে, নিজেরাই পুজো করে ভদ্রেশ্বরী আর তোষলা দেবীর। তাঁদের মনেও এই বিদ্রোহ আলোড়ন তুলেছিল। ঘরে ঘরে ভাদু বা টুসু উৎসবে গাওয়া হতো এসব লোকগান। এই মহাবিদ্রোহে সারা ভারত জেগে ওঠে। বিদ্রোহের অন্যতম নেতা নানা সাহেব,তাঁতিরা টোপি, ফৈজাবাদেও মৌলভি আহমদুল্লাহ, বিহারের জায়গিরদার কুঁয়র সিং, হরিয়ানার জায়গিরদার রাও তুলারাম, ওড়িশার সুরেন্দ্র, সাই, অসমের মণিরাম দেওয়ান ও পিয়ালি বড়–য়া প্রমুখ। দিকে দিকে ইংরেজের বিরুদ্ধাচারণ শুরু হয়েছিল। আর এই প্রতিবাদী আচারণে বাংলার লোককবিরাও পিছিয়ে থাকেননি। মালদহের গম্ভীরা গানে দেখি এই সার্বিক জনগণের কথাচিত্র-

বুঝি ফিরিঙ্গি দল এবার ভাইদের ধোবে নিলে খাঁটা   
সিপাহী সব মিলে অদের করলে বলির পাঁঠা।
গরু আর শূয়রের চর্বি দিয়ে করলে যে রে টোটা
হিন্দু আর মুসলমানের বুকে মার‌্যা দিল খঁটা। 
জাতি ধর্ম নাই এক ফঁটা।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে প্রজাদের খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে পাবনা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক সমিতি গড়ে ওঠে। ঐ আন্দোলনের সূত্রে অন্যান্য কয়েকটি জেলাতেও কৃষকদের মধ্যে জোট বাঁধার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে যে সর্বব্যাপী কৃষক বিপ্লব শুরু হয় তার জন্য ১৯৮৫ সালে ইংরেজ সরকার শেষপর্যন্ত বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন বিধিবদ্ধ করতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায়, প্রজারা তাঁকে রাজা সম্বোধন করত। এই আন্দোলনে জমিদারি প্রথার বিলোপ হয়নি তবে জমিদারদের অত্যাচার ও ইংরেজদের ক্রমাগত প্রজা-নিপীড়ন,জমি থেকে প্রজাদের উচ্ছেদ করার জমিদারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। ১৮৭২ সাল থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন চলেছিল  ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত। এই আন্দোলনের সপক্ষে লোককবিরা গান রচনা করেজনজাগরণ ঘটিয়েছেন। পাবনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের লেখক রাধারমণ সাহা এই আন্দোলন উপলক্ষে গাওয়া কয়েকটি প্রতিবাদী লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করেছেন।

দৌলতপুরের কালী রায়ের বেটা 
ঈশান রায় বাবু।
ছোট বড় জমিদার রেখেছেন কাবু।
তার নামের জোরে গগন ফাটে
আষ্ট(রাষ্ট্র) আছে জগৎময়।

কৃষক বিদ্রোহের ফলে জমিদাররা পড়েন মহামুশকিলে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অভাবী কৃষকরা মরিয়া হয়ে লুট করেন জমিদারের বাড়ি। ‘সিরাজগঞ্জ বিদ্রোহ’ বলে এর পরিচয়। এই অবস্থারই এক চিত্র ফুটে উঠেছে তৎকালীন লোককবিদের কণ্ঠে।

বঙ্গদেশে কলি শেষে ঘটল বিষম দায়
মনিব লোকের জের  হয়েছে বিদ্রুকের জ্বালায় ।
যত প্রজা লোকে জোটে থেকে জমিদারকে বেদখল দ্যায়
নালিশ করে শান্তি রক্ষা,জুলুম-নিষেধ প্রজার পক্ষে 
তার রাজা হর নিশান (ঈশান) বাবু কালসাফ জমিদার।
গোপালনগরের জমিদারের লুঠল বাড়িঘর। 
নিসান রায়ের হুকুম এ লোক চলে হাজার হাজার...

অনুরূপ আরেকটি গানও তখন খুব প্রচলিত ছিল। লোককবিদের কাছ থেকে এই গণজাগরণের গানের সংগ্রহ করেছেন পাবনার রাধারমণ সাহা। এটি শুধু কৃষকের অবস্থার কথা জানানোই নয়, কৃষকের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের লোকসঙ্গীতও। 

গোপালনগণের জমিদাররা তারা কেঁদে ম’ল
ডেমরা থেকে রাজু সরকার বাড়ী লুটে নিল।
কাশিঁ কাঁদে মহেশ কাঁদে কাঁদে তাহার খুড়ি 
গোলামের ব্যাটা বিদ্রুক আসে লুটল সকল বাড়ী।
বিদ্রুক আসে লুটে নিল গাছে নাইক পাতা 
জংগলের মধ্যে লুকায়ে থাকে ফুচকি মারে মাথা।

স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশজুড়ে উঠেছিল গণজাগরণের ঢেউ। রাজনৈতিক নেতারা তাদের মতো করে আন্দোলন করেছেন, সহিংস সংগ্রামীরাও তাদের আদর্শের অবিচল থেকে সংগ্রাম করে গেছেন।এসবের সঙ্গে গ্রামের খেটে খাওয়া মজুর,কৃষক, এমনকি সাধারণ  নিরক্ষর গ্রাম্য নারীরাও যেভাবে এই স্বাধীনতা যুদ্ধে সামিল হয়েছেন, তা ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। গ্রামীণ কবিওয়ালারা বেঁধেছেন তাদের প্রতিবাদী ভাষায়-

স্বদেশীর গান গামো হামেরা শুন তমেরা
স্বদেশীর গান গামো হামেরা।
হালুয়া না হাল বয়, করে ধানা-পাটা
কত ধনী না পায় আরও চা-বাগানের ট্যাহা।
শুন তমেরা,স্বদেশীর গান গামো হামেরা।
জমিনের খাজনা বিদ্দি শস্য হইল কম 
খাইতে নিতে ধনীগিলার সদায় পরে ফম।

স্বাধীনতা আন্দোলনে গণজাগরণ ঘটাতে বাংলার লোককবিরা এগিয়ে এসেছেন অনেকের মতোই। তার তাদের গান দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন দেশবাসীকে, ইংরেজ শাসনে দেশের দুর্দশার কথা দেকতে পাইএমনি এক লোকসঙ্গীতে...

ইবার শ্ব্যাত ইন্দুরে কইরলো সারা
ভাই রে ধানের বাজার হইল আক্কারা। 
গরু বাছুর,মাইয়্যা মানুষ      
ছাওয়ালপান যুব্বা পুরুষ
একই ভাব হইল হগারা।
যুইদ্ধো  লাইগছে রাজায় রাজায় মধ্য থিকা মইরলো পেরজায়
ন্যাত্যাগো সব ফাটক দিছে,
উচিত কথা কইবে কে?
কইলে পরে জরিমানা গারদখানা ভাতেমারা দ্যাশ ছাড়া                                       
আছে মোগো হুগল জানা।
আবার অ্যাতে ও নাকি সোয়াস নাই বসাইছে কন্টোল 
 (ও বাই) চাউল হইয়্যাছে পঞ্চশ ট্যাহা চৌদ্দ পুরুষ শুনি নাই।
ক্যারেচ ত্যাল পাওয়া যায়না চিনিত চোক্ষেই দেহি না
গেরামের যত বাবু ভূঞা গুড় দিয়া চায়া খায়্যা 
ফুড কমিটি কইরছে খাড়া

অত্যাচারী ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রট কিংসফোর্ডকে বোমা মেরে হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে। কিন্তু ভুলে তাদের বোমার আঘাতে কিংসফোর্ডের পরিবর্তে দুই ইংরেজ নারী নিহত হন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন এবং ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট এবং জেলে তার ফাঁসি হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামেগঞ্জে সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বীর ক্ষুদিরামের বীরত্বব্যঞ্জন কাহিনীর গান।লিখেছিলেন বাঁকুড়া জেলার এক অখ্যাত গ্রামের কবি পীতাম্বর দাস...
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি,
আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি
দেখবে জগৎবাসী 

এদিকে দেশ ভাগের কিছুকাল আগে ১৯৪৩ সালে জন্ম নিলো গণনাট্য সংঘের। শেকড় থেকে নেয়া অফুরান শক্তি নিয়ে পুরণচাঁদ যোশী মূল উদ্যোক্তা হিসেবে সংগঠিত করলেন গণনাট্য সংঘের। আসাধারণ মেধাবী শিল্পীদের সম্মিলন ঘটলো। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হেমন্ত মূখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, শচীন দেববর্মণ, কলিম শরাফি, নিবারণ পন্ডিত, সাধন দাশগুপ্ত প্রমূখ শিল্পীরা ঝড় জাগালেন সুরে। সঙ্গায়িত হলো গণসঙ্গীতের। নানা ধরণের গবেষণা আর আন্তর্জাতিক চেতনার মিশেল ঘটলো শেকড়ের সুর¯্রােতে। 
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেল। ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম হলো ভারত আর পাকিস্তান। এই সব অঞ্চলের লোকগান আলকাপে ঘটল দেশভাগের ফলে সৃষ্ট সমস্যার প্রতিফলন। অনেকেরই আত্মীয়স্বজন দেশভাগের ফলে ভিন দেশের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। এরই প্রতিবাদে আলকাপ শিল্পীরা গাইলেন...
হায়রে হায় কেমনে বাঁচাবো জান
হল হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান 
ভাই রাখেনা ভাইয়ের মান 
কেমনে বাঁচাবো জান। 
মোরা হিন্দু মুসলমান একই মায়ের সন্তান 
ভাইয়ের মুখ দেখতে ভাইকে 
ওনারা সব পাসপোর্ট চান।
হায়রে হায় কেমনে বাঁচবো জান... ইত্যাদি

দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে বহু কবিয়াল পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এসে আশ্রয় নেন এবং বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে গান বাঁধেন। ফরিদপুর থেকে এসে কোলকাতায় আশ্রয় নেয়া সুরেন্দ্র নাথ সরকার বাস্তুহারাদের নিদারুণ দুর্ভোগ নিয়ে গান বাঁধলেন:
এমন  সোনার বাংলা দেশে,
মানুষ বেড়ায় ভেসে ভেসে,
হলাম বাস্তুহারা সর্বহারা---
কার কলমের এক খোঁচায়।
আমরা ক্যাম্পে শুয়ে আজো মাঠে,
আর কত দিন জীবন কাটে,
দেখে মোদের দুঃখ কষ্ট---
শেয়াল কুকুর লজ্জা পায়।

এ হলো দেশ ভাগের প্রতিফলন। এ দেশের  লোককবিরা দেশ বিভাগকে মোটেও মেনে নিতে পারেনি। ইংরেজদের ‘ভাগ করো শাসন করো’ পরিকল্পনার চালাকি তারা বুঝতে পেরেছিলো। তারা শুধু ব্রিটিশ রাজকেই দায়ি করে ক্ষান্ত হয়নি বরং দেশের রাজনৈতিক নেতাদের স্বর্থপরতাকেও তারা মানুষের কাছে উপস্থাপনের চেস্টা করেছেন। গম্ভীরা গানের মাধ্যমে তারা যা গেয়েছিলেন-
দ্যাশের কত যে ন্যাতা
তাদেও বড় বড় কতা
পায়্যা স্বাধীনতা লাড্ডু
কুনঠে হয়া গেল গাড্ডু।
দেখ্যা তাদের স্বার্থপরতা
খাল্যে হামাদের মাতা
শ্যাষে ঘরে আগুন লাগায়া দিয়া
সোনার ভারত কইরলো খান
হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান

তৎকালিন পূর্ববাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের ঝুলুম আর শোষনের যাতাকলে নিমজ্জিত। পরাধীনতার যে শৃংখল বাঙ্গালি বারবার প্রতিহত করতে চেয়েছে তার প্রধান অস্ত্র ছিলো সঙ্গীত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরাই পাকিস্তান সরকারে প্রাধান্য পায়। পাকিস্তান সরকার ঠিক করে উর্দু ভাষাকে সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করা হবে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষার চল ছিলো খুবই কম। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এই সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবীতে শুরু হয় আন্দোলন।

পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে মিটিং-মিছিল বে-আইনি ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ একটি মিছিল শুরু করেন ছাত্র জনতা। মিছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ-এর কাছে এলে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে শহীদ হন আব্দুস সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেকে। এই ঘটনার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই বাগেরহাটের চারণ কবি শেখ সামছুদ্দিন আহমদ “রাষ্ট্রভাষা” নামে রচনা করেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানটি। গানটি-

‘রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনও করিলিরে বাঙলি, 
তোরে ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।
ও বাঙ্গালি ও ওওও।
তোতা পাখি পড়তে আইসা খোয়াইলি পরাণ,
মায় সে জানে পুতের বেদন, যার কলিজার জান।
ইংরেজ যুগে হাটুর নীচে চালাইতো গুলি,
স্বাধীন দেশে ভাইয়ে ভাইয়ের ওড়ায় মাথার খুলি,
তোরা ঢাকা শহর রক্তে রাঙ্গালি।’

১৯৪৮ সালেই শিল্পীসংগ্রামী সত্যেন সেন কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে গড়েছিলেন কবি গানের দল। যা বাংলার বুকে গণমানুষের গণসংগঠন সৃষ্টির ভ্রুণ লুকায়িত ছিলো।

ষাট দশক গণসাংস্কৃতিক আন্দোলন এর জন্য বিশেষ সময়কাল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে। সৃজনি, ছায়ানট, ক্রান্তি এবং উদীচী জন্ম লাভ করে এ সময়কালে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উদযাপনের সূত্র ধরে ছায়ানটের জন্ম । তদানীন্তন পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলছিল। সেই সময় সারা দেশে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। বিশেষ করে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন পাকিস্তান সরকারের কাছে, বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ছিল দেশদ্রোহিতার সমতুল্য। এই পরিবেশের মধ্যদিয়ে রবীন্দ্র-জন্ম-শতবার্ষিকী উদযাপন করেছিলেন এবং দেশে রবিন্দ্র চর্চার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিলেন যা পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে ছিলো এক সাহসী পদক্ষেপ। দেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতি মনুষের লড়াইকে বেগবান করার লক্ষ্যে দেশের সাম্যবাদী চেতনার প্রাণপুরুষ কৃষকনেতা সত্যেন সেন গড়ে তুললেন উদীচী। সময়টি ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর। গণসঙ্গীত তার বিকাশমান রূপ লাভ করে পূর্ববাংলার মানুষের মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে। শিল্পীসংগ্রামী সত্যেন সেন তাঁর গানে বল্লেন-
খেটে খেটে মরলি খালি
অভাবেই দিন কাটালি
দিনে দিনে সব খোয়াইলি
এমনি কপাল পোড়া।
অথবা
মারো জোয়ান হেইয়ো মারো কষে টান
তালে তালে ফেলো বৈঠা নদীতে উজান, 
হো নদীতে উজান।। 
ও মাঝি হাল তোর শক্ত করে ধর
পূব আকাশে গর্জে দেয়া কিসের তাতে ডর
পথের বাধা মানবো না রে, আসুক ঝড় তুফান।। 

এ পৃথিবী মেহনতীর ঘামে পরিচালিত হয় যা কারখানার শ্রমিকেরা উপলব্ধি করতে পারেনা। এ উপলব্ধি জাগিয়ে বঞ্চিত সর্বহারাকে বার বার মনে করাতে চেয়েছেন তার জীবনের সহজ সরল অধিকার আদায়ের কথা এভাবে-
হাতুড়িতে পিটাও লোহা মাকুতে দাও টান
মজদুরেতে দুনিয়াদারী চলছে অফুরান 
রে মজুর রে মজুর রে মজুর রে।। 
গাঁয়ের মায়া ছেড়ে এলাম শহর 
কারখানাতে মোরা বেঁধেছি রে ঘর
মেশিন যন্ত্রপাতি মোদের খেলার সাথী
মোরা একসাথে মিলাইয়াছি হাত হাজার জোয়ান 
রে মজুর রে মজুর রে মজুর রে।। ...

এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য এই যে, সর্বাধিক গানের মাধ্যে আমরা খুঁজে পাই লোকভাষার উপস্থাপন। এভাবেই গণসঙ্গীতের ক্রমবিকাশ মহান স্বধীনতার লক্ষ্যকে নির্ধারণ করে ফেলে। বাঙ্গালির জাতীয়তাবাদী মুক্তির পথকে বিকশিত করে। অসংখ্য গান নির্মাণ হয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। নয় মাসের সাগরসম রক্ত আর সম্ভ্রমের মূল্যে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। অনেক কিছুর প্রয়োজনীয়তা কমে গেলেও গণসঙ্গীতের প্রয়োজন থেকেই গেলো। ৭৫’এর বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে আবার ফিরে এলো পাকিস্তানের উগ্রসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ। ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্রের আকাঙ্খা ধ্বংস করা হলো। উদীচী তার লোকধারাকে নিয়ে পথে নামলো ‘ইতিহাস কথা কও’ গীতিআলেখ্য নির্মণের মধ্যদিয়ে। রচয়িতা ও গণসঙ্গীত শিল্পী মাহমুদ সেলিম গীতিআলেখ্যতে জাতীকে শোনালেন- 

দু:খ গেলো না, স্বাধীন হইলাম মুক্তি পাইলাম না
দু:খ গেলো না, স্বাধীন হইলাম মুক্তি পাইলাম না

গণসঙ্গীত নিয়ে নানা সঙ্গীত রচয়িতা ও সুরকারদের রয়েছে নানা ব্যাখ্যা। কেউ কেউ দেশাত্ববোধক গানকে গণসঙ্গীতের কাতারে ফেলতে চেয়েছেন আবার কেউবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে গান তাকেই গণসঙ্গীত হিসেবে অবিহিত করেছেন। আসলে গণসঙ্গীত আধুনিক কালের শ্রমজীবী মানুষের গান যা ধারণ করে শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিকতাকে এবং তা হলো লোকসঙ্গীতের উচ্চতর বিকাশমান রূপ। গণসঙ্গীতের স্বরুপ নির্ধারণ করতে গিয়ে  যথার্থ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গণসঙ্গীতের সার্থক শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস এর কাছে। তিনি  বলেছেন ‘ স্বদেশ চেতনা যেখানে গণচেতনায় মিলিত হয়ে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতার ভাবাদর্শের সাগরে মিশেল সেই মেহনাতেই গণসঙ্গীতের জন্ম।’ 

মুক্ত জার্মানীর জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা এবং নাট্যকার ব্রেখটের প্রধান মিউজিক কম্পোজার হ্যানস আইসলার বলেছেন, ‘গণসঙ্গীত আধুনিক কালের শ্রমজীবী মানুষের গান। যা ধারণ করে শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিকতাকে এবং তা হলো লোকসঙ্গীতের উচ্চতর বিকাশমান রূপ’।

তাহলে স্পষ্টতই বলা যায় যে লোকসঙ্গীত হলো শেকড় এবং আঞ্চলিকতার বতাবরনে প্রবাহমান। দেশবন্দনার বা দেশাত্ববোধক গান ধারণ করে আছে জাতীয়তাবোধকে আর গণসঙ্গীত অঞ্চল দেশকে ধারণ করে ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীর মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে অর্থাৎ আন্তর্জাতিকতার চেতনায়।
লেখক: চিত্রশিল্পী, সম্পাদক, চলচ্চিত্র ও চারুকলা বিভাগ, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ।

তথ্যঋণ:
১.বাংলার পল্লীগীতি সংগ্রহ
২.গণনাট্যের গান-দিলীপ মুখোপাধ্যায়
৩.প্রতিবাদী বংলা লোক সঙ্গীত- বিমল চন্দ্র চট্টপাধ্যায়
৪.সংগ্রামের চার দশক- উদীচী সম্পাদিত
৫.বাংলর লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ- যতীন সরকার

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত