গণসঙ্গীতের বিদ্রোহী সুরে মুখর উৎসবের দ্বিতীয় দিন
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০১৭, ১২:৩৮
গণসঙ্গীতের বিপ্লবী সুর ও বিদ্রোহী কথার মাধুর্য্যে মুখর হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত “অষ্টম সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা-২০১৭”এর দ্বিতীয় দিন। গত ২৯ মার্চ বিকালে উৎসবের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালা শুরু হয় গণসঙ্গীত বিষয়ক সেমিনার দিয়ে।
প্রাকৃতিক দুর্যেগের কারণে কিছুটা বিলম্বে শুরু হওয়া সেমিনারের শুরুতে ‘সুর-অসুরের দ্বন্দ্ব ও গণসঙ্গীত’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক, লেখক দীপঙ্কর গৌতম। প্রবন্ধে দীপঙ্কর গৌতম বলেন, গণ’র গান, নিপীড়িত গণমানুষের শোষণ মুক্তির গানই এককথায় গণসঙ্গীত। মরচেপড়া সমাজের ভিত নাড়িয়ে দেওয়াই গণসঙ্গীতের অন্যতম প্রধান কাজ। এছাড়া, গণসঙ্গীত মূলত মানুষের সচেতন জীবন সংগ্রামের ফসল। জাতীয় চেতনার ধারা যেখানে আন্তর্জাতিক, মেহনতী মানুষের আন্দোলনের সমুদ্রে মিশেছে সেই সাগর সঙ্গমেই গণসঙ্গীতের উৎপত্তি। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ড. সফিউদ্দিন আহমদ-এর সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রবন্ধের উপর আলোচনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য অধ্যাপক মতলুব আলী, সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম, প্রবীর সরদার, উদীচী’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সম্পাদকম-লী সদস্য প্রদীপ ঘোষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সায়েম রানা। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে।
সেমিনার শেষে জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্যায়ে বিজয়ীদের হাতে সনদপত্র ও স্মারক তুলে দেয়া হয়। উদীচী আয়োজিত জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘ক’ বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছে অঙ্কুর সরকার, দ্বিতীয় নম্রতা বর্মণ সেতু এবং তৃতীয় হয়েছে স্বীকৃতি রাহা। ‘খ’ বিভাগে প্রথম হয়েছে সৌরভ দাস সন্তু, দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে ওয়াজীহা তাসনীম এবং তৃতীয় হয়েছে মায়েশা সুলতানা ঊর্বি। ‘গ’ বিভাগে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে সুব্রত দাস। দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন অরুণ চন্দ্র বর্মণ এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছেন বিজয় চক্রবর্তী। এছাড়া, ‘ঘ’ অর্থাৎ দলীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে উদীচী যশোর জেলা সংসদ, দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে উদীচী সিলেট জেলা সংসদ এবং তৃতীয় হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে উদীচী মাদারীপুর জেলা সংসদ। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম।
সনদপত্র ও স্মারক বিতরণ শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। এ পর্বের শুরুতেই সঙ্গীত পরিবেশন করেন জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় তিনটি একক ও একটি দলীয় মোট চার বিভাগের চ্যাম্পিয়ন প্রতিযোগীরা ও দল। এরপর মঞ্চে পরিবেশনা নিয়ে আদিবাসী যুবকদের গানের দল ‘মাদল’। এরপর দেশবরেণ্য গানের দল ‘জলের গান’ তাদের পরিবেশনা দিয়ে প্রাঙ্গণে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করেন। এছাড়াও, গান পরিবেশন করেন এবারের উৎসবের আমন্ত্রিত অতিথি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত গণসঙ্গীত শিল্পী পূরবী মুখোপাধ্যায় ও অমিতাভ মুখোপাধ্যায়, যাঁরা গণসঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস-এর সঙ্গীতের দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। সঙ্গীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গের গণসঙ্গীত শিল্পী অসীম গিরি।
গত ২৮ মার্চ মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী এ উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট লোক ও গণসঙ্গীত শিল্পী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম কণ্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়। উদ্বোধনী পর্বে প্রকাশ করা হয় উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন রচিত গণসঙ্গীতের অ্যালবাম। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি হাবিবুল আলমের সঞ্চালনায় এ পর্বে অ্যালবামটির মোড়ক উন্মোচন করেন সত্যেন সেন-এর ঘনিষ্ঠ সহচর ও উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ ইদু এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সভাপতি কামাল লোহানী। সত্যেন সেন রচিত ১১টি গণসঙ্গীত স্থান পেয়েছে এ অ্যালবামে। এছাড়াও, সন্ধ্যায় ছিল দেশের খ্যাতনামা গণসঙ্গীত দল ও একক শিল্পীদের পরিবেশনা। এছাড়াও, উদীচীর জাতীয় গণসঙ্গীত পরিবেশনার বিভাগীয় পর্যায়ে যেসব দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ছিল দেশবরেণ্য সঙ্গীত দল বহ্নিশিখা, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, সিনেমা শহর, ধ্রুবতারা প্রভৃতি।
উৎসবের তৃতীয় ও শেষ দিন আগামীকাল ৩০ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান মিলনায়তনে অতিথি শিল্পী পূরবী মুখোপাধ্যায় ও অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের গণসঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন থাকবে। দেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে গণসঙ্গীতকে ছড়িয়ে দেয়া, গণসঙ্গীতের প্রচার ও প্রসার এবং গণসঙ্গীতকে সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনের জন্মদিবস উপলক্ষে প্রতিবছর এই উৎসব আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এবার অষ্টমবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে এ উৎসব ও প্রতিযোগিতা। এবারের উৎসবের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে “আমার লড়াই, আমার গান, উঠবে জেগে সর্বপ্রাণ”।