জীবনানন্দ দাশ: বোধ-এর সন্ধানে

প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১২:৩৮

সাহস ডেস্ক

কবি ও কবিতার নাম এলেই বাঙালিদের মাথায় একটা নামই সবার আগে আসে। যাঁর কবিতার অন্তর্গত ছত্রে ছত্রে রয়ে গেছে যে আশ্চর্য বোধের ছোঁয়া, জীবন সম্পর্কে রয়েছে গভীর ধ্যান, যাঁর স্বপ্ন চলাফেরা করত আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের আড়ালে। যে সব স্বপ্ন, যে সব অনাশ্রিত বেদনা আমরা প্রতিনিয়ত ভুলে যাই, ভুলে থাকার চেষ্টা করতে করতে একসময় ছুঁড়ে ফেলে দেই কাক, কুকুরে ঘাঁটা আবর্জনার স্তুপে। সেই আশ্চর্য বেদনা আর অবহেলার রেশ নিয়েই কেটেছে যাঁর সমস্ত জীবন। বাংলার আধুনিক কবিতার পাঁচ পাণ্ডবের সেই প্রধান পাণ্ডবের নাম জীবনানন্দ দাশ। জীবনভর যিনি করে গেছেন 'বোধ'-এর সন্ধান।

জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলায়। তাঁর ডাকনাম ছিল মিলু। জন্মসূত্রে তিনি হিন্দু ধর্মের হলেও পরবর্তীতে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন করেন। বরিশারে তিনি ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনে অংশ নেন। কবিতার অঙ্গণে আসা মূলত তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশ (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে )-এর প্রভাবে। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্তের কম বয়েসে স্কুলে যাবার বিরোধিতার কারণেই তিনি বাল্যকালে তাঁর মা'র কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতেন। ৩ ভাইবোনের ভেতরে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর এক ভাইয়ের নাম অশোকানন্দ দাশ ও এক বোনের নাম সুচরিতা দাশ।

১৯০৮ সালে তিনি পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর বাংলা এবং ইংরেজি জ্ঞান বিস্তৃত হয়। এছাড়াও ছবি আঁকার দিকেও তাঁর ঝোঁক ছিল। ১৯১৫ সালে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এর দু'বছর বাদেই ব্রজমোহন কলেজ থেকে ঐ একই ফলাফল নিয়ে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

১৯১৯ সালে তিনি প্রসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। ঐ বছরই তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায়। কবিতাটির নাম ছিল 'বর্ষা আবাহন'। ১৯২১ সালে কলকাতা বিকিছুদিন আইনশাস্ত্রও পড়াশোনা করেন। তবে পরীক্ষার ঠিক আগে তিনি ব্যাসিলারি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে ১৯২২ সালে আইনশাস্ত্র অধ্যায়ন ছেড়ে দিয়ে কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।

১৯২৫-বিশ্ববিদ্যায় থেকে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি এর জুনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মৃত্যুবরণ করলে তার স্বরণে জীবনানন্দ দাশ 'দেশবন্ধুর প্রয়ানে' নামক একটি কবিতা লেখেন যা বঙ্গবাণী পত্রিবায় প্রকাশিত হয়। যেটি পরে তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালকে' স্থান পায়। এই কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাশ মন্তব্য করেছিলেন, "এ কবিতাটি নিশ্চয়ই কোন প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা"। ধীরে ধীরে তার কাব্যপ্রতিভার রস আস্বাদন করতে শুরু করল কাব্যরসিকেরা। সে সময়ের অত্যন্ত বিখ্যাত পত্রিকাগুলোতে ছাপা হতে লাগল তাঁর কবিতা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কালি ও কলম, কল্লোল, প্রগতি ইত্যাদি।

১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক' প্রকাশিত হয়। তখনই কবি তাঁর উপাধি 'দাশগুপ্ত'-এর বদলে 'দাশ' লেখা শুরু করেন।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কয়েক মাসের মাথাতেই তিনি সিটি কলেজে তাঁর চাকরিটি হারান। ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে কলেজটিতে ছাত্র অসন্তোষ দেখা দিলে কলেজটির ছাত্রভর্তির হার আশঙ্কাজনকহারে কমে যায়। জীবনানন্দ ছিলেন কলেজটির শিক্ষকদের মধ্যে কনিষ্ঠতম এবং আর্থিক অসুবিধায় পড়ে কলেজ তাঁকেই চাকরিচ্যুত করে। কলকাতার সাহিত্যচক্রেও সে সময় তাঁর কবিতা কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হয়। সে সময়কার প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস পত্রিকায় তার রচনার নির্দয় সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। কলকাতায় করার মতন কোনো কাজ ছিল না বিধায় কবি ছোট্ট শহর বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে ৩ মাস পরেই তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছিলেন। জীবনধারণের জন্যে তিনি টিউশানি করতেন এবং সাথে সাথে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সন্ধান করছিলেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।

বরিশালে তার পরিবার তার বিয়ের আয়োজন করছিল এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৯ই মে তারিখে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায়, ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। বিয়ের পর আর দিল্লিতে ফিরে যান নি তিনি, ফলে সেখানকার চাকরিটি খোয়ান। এরপর প্রায় বছর পাঁচেক সময় জীবনানন্দ কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। মাঝে কিছু দিন ইনশিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন; ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অর্থ ধার করে ব্যবসার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কোনটাই স্থায়ী হয় নি।

১৯৩৫ সালে তিনি তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। সেই সময়েই কলকাতাতে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সমর সেন একটি নতুন কবিতা পত্রিকা বের করবার তোড়জোড় করছিলেন, যার নাম দেওয়া হয় 'কবিতা'। পত্রিকাটির ১ম সংখ্যাতেই জীবনানন্দের একটি কবিতা স্থান করে নেয়, যার নাম ছিল 'মৃত্যুর আগে'। কবিতাটি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেবকে লেখা একটি চিঠিতে মন্তব্য করেন কবিতাটি 'চিত্ররূপময়'। 'কবিতা' পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে তার কিংবদন্তিতুল্য 'বনলতা সেন' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই ১৮ লাইনের কবিতাটি বর্তমানে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এর ফলে দ্বিখণ্ডিত বাংলা হবার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। দেশবিভাগের কিছু আগেই তিনি বি.এম. কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপরে তিনি আর এদেশে ফেরেন নি। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তাঁকে থাকতে হয়েছে জীবনযুদ্ধে অন্তরীণ।

তিনি কবিতা ছাড়াও প্রচুর গল্প উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু একটাও প্রকাশ করে যান নি কি এক অভিমানে। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন নিজের কড়া সমালোচক। এজন্যেই তাঁর অনেক কবিতাও তিনি প্রকাশ করেন নি। তাঁর রচিত কবিতার সংখ্যা প্রায় ৮০০ হলেও মাত্র ২৬২ টি কবিতা প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন।

তাঁর সাহিত্য কর্মের তালিকাঃ

কাব্যগ্রন্থ
জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থসমূহের প্রকাশকাল সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। নিচে কেবল প্রথম প্রকাশনার বৎসর উল্লিখিত।
 ঝরা পালক (১৯২৭)
ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
বনলতা সেন (১৯৪২, কবিতাভবন সংস্করণ)
মহাপৃথিবী (১৯৪৪)
সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)
বনলতা সেন (১৯৫২, সিগনেট প্রেস সংস্করণ)
জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪)
রূপসী বাংলা (১৯৫৭)*
বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)*
সুদর্শনা (১৯৭৪)*
আলো পৃথিবী (১৯৮১) *
মনোবিহঙ্গম*
অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) *

প্রবন্ধগ্রন্থ
কবিতার কথা (১৯৫৫)
জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সমগ্র (১৯৯০, সম্পাদকঃ ফয়জুল লতিফ চৌধুরী)*

উপন্যাস
মাল্যবান (১৯৭৩)*
সুতীর্থ (১৯৭৭)
চারজন (২০০৪: সম্পাদকঃ ভূমেন্দ্র গুহ ও ফয়সাল শাহরিয়ার)*

গল্পগ্রন্থ
জীবনানন্দ দাশের গল্প (১৯৭২, সম্পাদনা: সুকুমার ঘোষ ও সুবিনয় মুস্তাফী)
জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯, সম্পাদনা: আবদুল মান্নান সৈয়দ)
পত্রসংকলন
জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী (বাংলা ১৩৮৫, সম্পাদকঃ দীপেনকুমার রায়)
জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী (১৯৮৬, সম্পাদকঃ আবদুল মান্নান সৈয়দ) )

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্কে বলা হয়েছে যে তাঁর মৃত্যুর মূল কারণ তাঁর আত্মহত্যাস্পৃহা। এর কারণ ও রয়েছে। গত ১০০ বছরে কোলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র এক। আর সেই একজনই হল জীবনানন্দ দাশ। কঠিন বাস্তবের ঠোকর খেতে থেতে, ভালবাসাহীন, সাহায্যহীন জীবনে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই হয়ত তিনি মৃত্যুর কাছে শেষ আশ্রয় চেয়েছিলেন তাঁকে দু'দণ্ড শান্তি দেবার আবেদন জানিয়ে!

তিনি শান্তি পেয়েছেন কি না তা জানা সম্ভব নয় কোনো জীবিত মানুষের পক্ষে, তবে তাঁর কর্ম অন্তত এটুকু বলে দেয় তাঁর মূল্য দেবার যোগ্য আমরা ছিলাম না।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত