চাচনামাহ্

প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১১:২৬

ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের শিকড়ের গভীরে উঁকি দিয়ে খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকের সেই যুগের সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাঠকের সেতুবন্ধনের প্রচেষ্টায় রচিত হয়েছিল এই অনন্য গ্রন্থ।

সিন্ধুর মহারাজা  চাচ্- এর নাম থেকেই চাচনামাহ'র নামকরণ হয়েছে। রাজপুত রাই রাজবংশের সর্বশেষ রাজা সাহাসি রাইয়ের দরবারে নিজ মেধা ও যোগ্যতার বলে প্রধান রাজ-কর্মাধ্যক্ষ হয়ে ওঠেন নিতান্ত দরিদ্র ব্রাহ্মণ সিলাইজের পুত্র চাচ্। রাজা ছিলেন নি:সন্তান এবং মহারাণী সুহান্দি দেবীর প্রতি প্রচণ্ড অনুরক্ত। ইতিহাসে সুন্দরী ও ছলনাময়ী বলে খ্যাত এই মহারাণী সুহান্দি মহারাজের জীবদ্দশাতেই গভীর প্রণয় রচনা করেন মহামন্ত্রী চাচের সঙ্গে। তারপর একদিন অকস্মাৎ রাই সাহাসির অসুস্থতাজনিত মৃত্যু দুজনকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। মহারাণী সুহান্দির প্রণয় ও তার সাথে পরিণয়ের মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতার অন্য অনেক দাবীদারদের বঞ্চিত করে সিংহাসনে আরোহন করেন চাচ্।

রাজা চাচের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠপুত্র দাহার আপন বড়ভাই দাহারসিয়াহ্কে বঞ্চিত করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাজত্ব লাভ করেন এবং জ্যোতিষ বচনের অজুহাতে রাজ্য রক্ষার্থে আপন বোনকে বিবাহ করে প্রাসাদে অন্তরীণ রাখেন। রাজা দাহারের শাসনামলে সিন্ধুর বিখ্যাত দেবল সমূদ্রবন্দরের কাছাকাছি জলদস্যুরা আটটি আরব নৌযান লুণ্ঠন করে এবং সকল নারী-পুরুষ যাত্রিদেরকে বন্দী বানিয়ে দেবলের কারাগারে নিক্ষেপ করে । সারণদ্বীপে ( শ্রীলঙ্কা) তখন ব্যবসায়ের কাজে প্রচুরসংখ্যক আরব বাস করতেন। কয়েকজন আরব বণিকের মৃত্যু হলে সারণদ্বীপের রাজা মৃত বনিকদের স্ত্রী-পরিজনদেরকে আটটি সুন্দর নৌযানে করে আরবে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। জাহাজগুলোতে তৎকালীন আরবের খলিফা ওয়ালিদ এবং বাগদাদের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্যে প্রচুর পরিমাণ মহামূল্যবান ধন-রত্ন ও উপহার সামগ্রী পাঠানো হচ্ছিল। এই দুর্ঘটনার সংবাদ হাজ্জাজের কানে যেতেই তিনি রাজা দাহারের কাছে সকল বন্দীর মুক্তি এবং লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ ফেরত দেবার দাবী জানিয়ে দূত পাঠান। কিন্তু জলদস্যুদের ওপর কোনোরকম কর্তৃত্ব নাই অজুহাতে রাজা দাহার সেই দাবী প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখানের ফলে হাজ্জাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং দাহারকে উচিত শিক্ষা দেবার কঠিন প্রত্যয়ে প্রাথমিকভাবে সিন্ধুর বিরুদ্ধে দুটি অভিযান পাঠান। প্রতিকূলতার কারণে দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয় এবং প্রচুরসংখ্যক আরবীয় বীরসেনা মৃত্যুবরণ করে। অদম্য অকুতোভয় হাজ্জাজ তারপর হিজরি ৯২ সালে খলিফার বিশেষ অনুমোদন নিয়ে আবারও সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে বিশাল এক যুদ্ধ অভিযানের পরিকল্পনা করেন। এই অভিযানের অধিনায়কের দায়িত্ব তুলে দেন তাঁর আপন ভ্রাতুষ্পুত্র সতের বছর বয়সী অপরাজেয় তরুণ বীর মুহম্মদ বিন কাসিমের যোগ্য হাতে। প্রচুর পরিমান রসদ, অসংখ্য লড়াকু যোদ্ধা, আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, প্রকৌশল দক্ষতা সম্পন্ন নিশানাবাজ সহযোদ্ধা এবং মুহম্মদ বিন কাসিমের বিচক্ষণ নেতৃত্বে দূর্গ ধ্বংশকারী 'ছোট্ট কণে' নামক যন্ত্রের সহায়তায় দেবল বন্দর ও দেবল দূর্গ গুড়িয়ে দেয়া হয়।

মুহম্মদ বিন কাসিম এরপর অদম্য তেজে শুধু এগিয়েই চলেছেন। দীর্ঘদিন ধরে দাহারের কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো স্থানীয় জাট্ ও মেড্ সৈন্যগণ। ক্রমে তারাও দলে দলে মুহম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করেন। তারপর নিরুনসহ অসংখ্য দূর্গ শহর দখলে নিয়ে আসেন মুহম্মদ বিন কাসিম । তারপর রাওয়ারে উন্মুক্ত যুদ্ধের ময়দানে অকস্মাৎ নাটকীয় ভাবে ধরাশায়ী হন রাজা দাহার। আরব সৈন্যরা তাঁকে বন্দী করে এবং শিরচ্ছেদ করে। এরপর বিজয়ী বীর মুহম্মদ বিন কাসিম ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণাবাদ, আলোর, মুলতান প্রভৃতি দূর্গ জয়ের মাধ্যমে সিন্ধুতে আরব শাসনের সূচনা করেন। অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শনকারী অসম্ভব রণদক্ষতা সম্পন্ন এই বিজয়ী বীরকে অবশেষে কেন অতি তুচ্ছভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল? চাচনামাহ্ পাঠ শেষে ইতিহাস অধ্যয়নকারীরা নিজেদের জন্য অবশ্যই প্রশ্নটির নিষ্পত্তি করতে সমর্থ হবেন ।

মূল ফারসি : আলী বিন আবু বাকার কুফি ( ১২১৬ খৃষ্টাব্দ)
অনুবাদ : মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, প্রচ্ছদ ও মূল সংগ্রহ :  আশরাফ-উল আলম শিকদার।
প্রকাশ প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০১৪ দ্বিতীয় সংস্করণ : একুশে বইমেলা ২০১৮, অন্বেষা প্রকাশন, বাংলাবাজার, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত