শহর ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৬, ১১:৪১

আহমদ রফিক

শহর ঢাকায় বার দুই আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমবার ১৮৯৮ সালে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে। ঢাকা তখন নিতান্তই এক মফস্বল শহর, রাজধানী কলকাতার তুলনায় ম্লান। নবাবি আমলের সোনারঙ ধুয়েমুছে গেছে। এমনই এক ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বহীন আসা। তবে নিজ গুণে ও তৎপরতায় কিছু গুরুত্ব তৈরি করেছিলেন সন্দেহ নেই।

ছিলেন প্রধান অতিথি রেভারেন্ড কালীচরণ ব্যানার্জি, ডাকসাইটে কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে বুড়িগঙ্গা তীরে তৎকালীন সাহেবপাড়ায়। উপভোগ করেছেন বুড়িগঙ্গায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা। দ্বিতীয় সফরে কথাটা কাব্যভাষায় প্রকাশ করেছেন তিনি।

সম্মেলন শুরু ক্রাউন থিয়েটার হলের সুসজ্জিত মঞ্চে। উদ্বোধন ও সমাপনী সঙ্গীত গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আর নিজ গরজে উদ্বোধক সভাপতি কালীচরণ ব্যানার্জি ও পরবর্তী বক্তাদের ইংরেজি ভাষণ সংক্ষেপে বাংলায় অনুবাদ করে শ্রোতাদের শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তার মতে, জনগণের প্রতিষ্ঠানে কংগ্রেসের নেতাদের বক্তব্য যদি আসে বিদেশি-বিজাতীয় ভাষায়, তাহলে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হবে কীভাবে। বলা বাহুল্য, ওই সফরে রবীন্দ্রনাথ প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন।

তবে তার দ্বিতীয় ঢাকা সফর ছিল সত্যিকার অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। অল্প সময়ে এত আমন্ত্রণ রক্ষা, এত বক্তৃতা ও ভাষণ এবং আলাপচারিতা ও সম্মাননা গ্রহণ বাস্তবিকই ছিল অবিশ্বাস্য। সেবার দ্বিতীয় সফরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি ও নাগরিক সমাজের আমন্ত্রণে ১৯২৬ এর ৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথের ঢাকায় আসা মাত্র এক সপ্তাহের জন্য। সঙ্গী রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, নন্দিনী, দিনেন্দ্রনাথ, কালীমোহন ঘোষ এবং বিশ্বভারতীর তিন বিদেশি অধ্যাপক লিম, ফর্মিকি ও তুচ্চি এবং কবির সেক্রেটারি ফার্সি যুবক হিবজি ভাই মরিস।

বিপুল সমারোহে সমবেত জনতার অভিনন্দনের উষ্ণতায় দলবলসহ রবীন্দ্রনাথের ঢাকার ওয়াইজঘাটে উপস্থিতি এবং ঢাকায় নবাববাড়ির সৌজন্যে বুড়িগঙ্গায় 'তুরাগ' বোটে বিশ্রাম গ্রহণ। তাও স্বল্প সময়ের জন্য। কারণ সে দিনই লালকুঠিতে ঢাকা পুরসভা ও নাগরিক কমিটির উদ্যোগে সংবর্ধনার আয়োজন। জনসমাগম এতই যে, হলঘরের বাইরেও ভিড় রবীন্দ্রনাথকে দেখতে ও তার কথা শুনতে। শহর ঢাকা সেদিন বেজায় আন্তরিক সংবর্ধনা জানিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে।

অভিনন্দন বক্তব্যের জবাবে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ বক্তৃতার মর্মার্থ হলো তিনি সাহিত্যকর্মী। তবু দেশসেবার ব্রত কিছুটা হলেও গ্রহণ করতে হয়েছে। বহুকাল আগে একবার ঢাকায় এসে আত্মশক্তিতে নিজের অভাব, দেশের অভাব দূর করার কথা বলতে হয়েছিল। এখন বিশ্বব্যাপী দুঃখের দিনে মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা শান্তি। সেটাই অর্জন করতে হবে।

লালকুঠির নাগরিক সংবর্ধনার পর বুড়িগঙ্গা তীরে করোনেশন পার্কে গণসংবর্ধনা সুসজ্জিত মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ। তার চোখেমুখে শেষ বিকালের আলো। সে আলোচ্ছটা নদীতীরে বাকল্যান্ড বাঁধজুড়ে উপস্থিত মানুষের মুখেও। এবার অভিনন্দনের জবাবে অভিভূত কবি ওই আলো, ওই নদী ও মানুষের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তার কাব্যিক ভাষায় প্রকাশ করেন।

সে আবেগের দু'একটি কথা বোধ হয় উল্লেখ করা দরকার। তার ভাষায়, 'মনে রাখবেন আপনাদের কবি এই সুন্দর সূর্যাস্তকালে সুন্দর নদী তীরে দাঁড়িয়ে আপনাদের সকলের মধ্যে হৃদয় প্রসারিত করেছিল। ... আজ এই সন্ধ্যাসূর্যের শেষ বাণীর দ্বারাই আমার বিদায় অভিনন্দনকে পূর্ণ করে রেখে দিয়ে গেলুম।' কবির কথা শুনে সেদিন বুড়িগঙ্গায় ঢেউ ছলছলিয়ে উঠেছিল কিনা জানা নেই, তবে উপস্থিত মানুষের চোখ আবেগে সিক্ত হয়েছিল।

সময়ের এমনই নির্মমতা, মানুষের এমনই অন্তহীন লোভ যে ঐতিহ্যবাহী সে 'করোনেশন পার্ক' আজ বিলুপ্ত। রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত করোনেশন পার্ক বাণিজ্যিক লোভের টানে 'মার্কেটে' পরিণত। ঢাকার অনেক ঐতিহ্য, অনেক স্থাপত্য এভাবে নষ্ট হয়ে চলেছে। কী সিটি করপোরেশন, কী পুরাতত্ত্ব বিভাগ কারও নজর নেই এসব স্মৃতি সংরক্ষণের দিকে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যসচেতন মানুষের লেখালেখিতেও কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

দুই.
মাত্র এক সপ্তাহের সফর। কিন্তু আমন্ত্রণের পর আমন্ত্রণ। রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত নন, বরং উদ্দীপ্ত, কিন্তু সেইসঙ্গে ক্লান্ত। দুর্বল শরীর। তুরাগ বোটে বুড়িগঙ্গার বাতাসেও তার ক্লান্তি দূর হচ্ছে না। মন বোধ হয় চাইছিল শিলাইদহ তীরে পদ্মার বাতাস। সে বাতাসের সি্নগ্ধতায় মনের আরাম, প্রাণের আরাম। রবি জীবনের ইতিহাস তেমন সত্যই ধরে রেখেছে।

রবীন্দ্রনাথ নামের মানুষটির দায়িত্ববোধ ও সৌজন্যবোধ ছিল প্রবল। হোন না তিনি রোমান্টিক, কবি ও গীতিকার। তাই কোনো আমন্ত্রণই ফিরিয়ে দিতে চাইছেন না যদিও শরীর দুর্বল, শ্রান্ত, ক্লান্ত। তাই সবার অনুরোধই রাখতে চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয় দিন বিকালে ঢাকার মুসলিম সমাজের বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ রাখতে আহসান মঞ্জিলে (নবাববাড়িতে) চায়ের আসরে যোগ দেন রবীন্দ্রনাথ।

সেখান থেকে শিক্ষাব্রতী (গোপন বিপ্লবী) লীলানাগের আমন্ত্রণে 'দীপালি সংঘ' এর সভায় বক্তৃতা। সভা ব্রাহ্মসমাজ মন্দির প্রাঙ্গণে। সেখানে দুই হাজার মহিলার উপস্থিতি দেখে অবাক রবীন্দ্রনাথ। ঢাকার মতো ছোট শহরের জন্য এ ঘটনা অভাবিত। সংঘের সেক্রেটারি লীলানাগের অভিনন্দনপত্র পাঠের পর রবীন্দ্রনাথ নারীশিক্ষার গুরুত্ব, নারীর দায়িত্ব, কর্তব্য ইত্যাদি নিয়ে যখন উপস্থিত সবাইকে নীতিকথা শোনান তখন কি তিনি জানতেন যে, এই আপাত-নিরীহ লীলানাগ একজন বিপ্লবী?

পরদিন তার গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশে। ওই দীর্ঘ ভাষণে তৎকালীন সমাজ, রাজনীতি, হিন্দু-মুসলমান বিভেদের মতো বিষয় স্থান পায়। এমনকি জাতপাতের অমানবিকতাও তার বক্তব্যে উঠে আসে। শিক্ষাসহ দুটি বিষয়ে তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রথমত, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি, যা পারস্পরিক বৈষম্য নিরসনের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, দেশ ও সমাজ নতুন করে গঠনের কাজে তরুণদের আন্তরিক অংশগ্রহণ। এ বিষয়ে তিনি পূর্ববঙ্গের তরুণদের সম্বন্ধে প্রশংসা বাণী উচ্চারণ করেন। জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) কিন্তু সে স্মৃতি রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বারকয় তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েও এ কাজ সম্ভব হয়নি।

ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ। 'ডাকসু' আয়োজিত সংবর্ধনা সভা কার্জন হলে। সকালে ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনা সভায় যোগ দিয়েছেন এবং জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর আমন্ত্রণে 'বলধা গার্ডেনে'র বিচিত্র উদ্ভিদরাজ্য দেখে মহাখুশি। মুগ্ধ কবির মন্তব্য, 'বাংলাদেশের অনেক স্থানে বেড়িয়েছি, নিজের বাড়িতে এমন সুন্দর বাগান তৈরি করে রাখতে কোথাও দেখিনি।' সরকারি দেখভাল সত্ত্বেও একালে ঐতিহ্যবাহী সে উদ্যানের সমৃদ্ধি ঘটেনি।

সেদিন বিকালে মুসলিম হলে (এসএম হলে) রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন। কার্জন হল থেকে মুসলিম হল পত্রপুষ্পে সজ্জিত। সভাগৃহে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কবির গায়ে পুষ্পবৃষ্টি। ছাত্রদের এ অভিনব সংবর্ধনায় রবীন্দ্রনাথ সত্যিই অভিভূত। সেইসঙ্গে কিছু সরস মন্তব্য। অসাধারণ অভিনন্দনপত্রটি রচনা করেন হলের হাউস টিউটর, 'শিখা' গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবুল হুসেন। এটি পাঠ করেন হল ইউনিয়নের ভিপি সুলতান উদ্দিন আহমদ।

অভিনন্দনের জবাবে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় বিরোধ, সামাজিক বিভেদ ও বৈষম্য, মনুষ্যত্বের অবমাননা ইত্যাদি সময়ানুগ বিষয় নিয়ে তার মতামত তুলে ধরেন। তরুণদের আহ্বান জানান শুভবুদ্ধি নিয়ে সক্রিয় হতে। সভায় কবিকে মুসলিম হলের জীবন সদস্য রূপে গ্রহণ করা হয়। মুসলিম হল থেকে আবার কার্জন হল। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিমাফিক সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা। বিষয় 'দ্য মিনিং অব আর্ট' সভাপতি ভিসি জিএইচ ল্যাভলি। সে রাতে কবি তার বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি এনা দেবীর বাসায় নৈশ আহার শেষ করেন। এনা দেবীর স্বামী তখন ঢাকার সিভিল সার্জন।

দিনের পর দিন ঠাসা অনুষ্ঠানের চাপে কবি অসুস্থ। অগত্যা তুরাগ বোটে বিশ্রাম। দু'দিনের কর্মসূচি বাতিল। বুড়িগঙ্গা থেকে অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ। কিছুটা অসুস্থতা নিয়েই ১৩ ফেব্রুয়ারি আবার কার্জন হলে বক্তৃতা। বিষয় 'দ্য রুল অব দ্য জায়ান্ট' (দানবের শাসন)। অর্থ ও শক্তির দম্ভ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা। অসুস্থতার কারণে জগন্নাথ হলে যেতে পারেননি বলে ছাত্র প্রতিনিধিরা অভিনন্দনপত্রটি সুদৃশ্য আধারে কার্জন হলে এসে কবির হাতে তুলে দেন।

এরপর আবার তুরাগ বোটে। আবার ছাত্রছাত্রীসহ দর্শনার্থীদের ভিড়। একের পর এক অটোগ্রাফ। বুড়িগঙ্গার বুকে পালিয়ে এসেও নিস্তার নেই কবির। এমনই ব্যস্ততায় কেটেছে রবীন্দ্রনাথের ঢাকা সফর। এর মধ্যে গোটা তিনেক কবিতা ও গান লিখে দিতে হয়েছে। যাত্রা শেষের তাগিদে বোট থেকে রমেশবাবুর বাসায়। সর্বশেষ অনুষ্ঠান ১৪ ফেব্রুয়ারি স্নেহভাজন অধ্যাপক অপূর্বকুমার চন্দের বাসায়।

ওই বৈঠকের মুক্ত আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন পরবর্তীকালের খ্যাতনামা একাধিকজন। যেমন কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ ওই অনুষ্ঠানে কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন। গান শোনান দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের এ ঢাকা সফরের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল অমৃতবাজার, আনন্দবাজার, দ্য ইন্ডিয়ান মিরর, দ্য বেঙ্গলি, দ্য মুসলমানসহ প্রবাসী, সবুজপত্র, মডার্ন রিভিউ ও ঢাকা প্রকাশ প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়। ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের এ সফর বাস্তবিকই ছিল নানা মাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই।

লেখক: ভাষা সংগ্রামী ও প্রাবন্ধিক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত