অনুবাদক রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৬, ১১:৪৮

অনির্বাণ রায়

জীবনস্মৃতির ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের পুত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় বাড়িতে আমাদের শিক্ষক ছিলেন। ইস্কুলের পড়ায় যখন তিনি কোনোমতেই আমাকে বাঁধতে পারিলেন না, তখন হাল ছাড়িয়া দিয়া অন্য পথ ধরিলেন। আমাকে বাংলায় অর্থ করিয়া কুমারসম্ভব পড়াইতে লাগিলেন। তাহা ছাড়া খানিকটা করিয়া ম্যাক্বেথ আমাকে বাংলায় মানে করিয়া বলিতেন এবং যতক্ষণ তাহা বাঙলা ছন্দে আমি তর্জমা না করিতাম ততক্ষণ ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিতেন। সমস্ত বইটার অনুবাদ শেষ হইয়া গিয়াছিল। সৌভাগ্যক্রমে সেটি হারাইয়া যাওয়াতে কর্মফলের বোঝা ওই পরিমাণে হাল্কা হইয়াছে।

এই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ কৃত প্রথম অনুবাদ। রামসর্বস্ব পন্ডিত মহাশয় বালক অনুবাদককে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে ম্যাক্বেথ অনুবাদ শোনাবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :

তখন তাঁহার কাছে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বসিয়া ছিলেন। পুস্তকে-ভরা তাঁহার ঘরের মধ্যে ঢুকিতে আমার বুক দুরুদুরু করিতেছিল; তাঁহার মুখচ্ছবি দেখিয়া যে আমার সাহস বৃদ্ধি হইল তাহা বলিতে পারি না। ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা আমি তো পাই নাই; অতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল। বোধ করি কিছু উৎসাহ সঞ্চয় করিয়া ফিরিয়াছিলাম। মনে আছে, রাজকৃষ্ণবাবু আমাকে উপদেশ দিয়াছিলেন, নাটকের অন্যান্য অংশের অপেক্ষা ডাকিনীর উক্তিগুলির ভাষা ও ছন্দের কিছু অদ্ভুত বিশেষত্ব থাকা উচিত।

ম্যাক্বেথ সবটাই অনূদিত হয়েছিল এবং সেটি হারিয়েও গিয়েছিল। ফলে ‘কর্মফলের বোঝা’ ‘হাল্কা’ হয়েছিল বলে পরিণত রবীনদ্রনাথের মন্তব্য। কিন্তু হারিয়ে সবটাই যায়নি। ডাকিনীদের অংশের কিছুটা প্রকাশিত হয়েছিল। (ভারতী/আশ্বিন ১২৮৭)। এখানে তার এক ঝলক :

দৃশ্য/এক প্রান্তর/বজ্র
তিনজন ডাকিনী
১ম ডা – এতক্ষণ বোন কোথায় ছিলি?
২য় ডা – মারতেছিলুম শুয়োর গুলি।
৩য় ডা – দেখ্, একটা মাসির মেয়ে
গোটাকতক বাদাম নিয়ে
খাচ্ছিল সে কচ্মচিয়ে
কচ্মচিয়ে
কচ্মচিয়ে
চাইলুম তার কাছে গিয়ে,
পোড়ার মুখী বোল্লে রেগে
‘ডাইনী মাগী যা তুই ভেগে।’

শেক্শপিয়রের আর-একটি নাটক মার্চেন্ট অফ ভেনিসের পঞ্চম অঙ্ক প্রথম দৃশ্য থেকে একটি চতুর্দশপদী সঙ্গীত নামে অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ; সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ভারতীতে (মাঘ ১২৮৪) :

কেমন সুন্দর আহা ঘুমায়ে রয়েছে
চাঁদের জোছনা এই সমুদ্র বেলায়।
এসো প্রিয়ে এইখানে বসি কিছুকাল;
গীতস্বর মৃদু মৃদু পহুক শ্রবণে!
সুকুমার নিস্তব্ধতা আর নিশীথিনী -
সাজে ভালো মর্ম-ছোঁয়া সুধা-সংগীতেরে।

কেবলমাত্র শেক্শপিয়রই নন, ইংরেজি থেকে আরো অনেকের রচনাই অনুবাদ করেছিলেন তিনি যেমন টমাস মূর, মার্লো, জন ডান, চ্যাটার্টন, শেলী, বার্নস, বায়রন, ব্রাউনিং, টমাস হুড, ক্রিস্টিনা রসেটি, সুইনবার্ন, টেনিসন, এলিয়ট, হুইটম্যান। সরোজিনী নাইডু এবং তাঁর সহোদর হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ইংরেজি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের একটি কবিতার অনুবাদ ‘শেষ উপহার’ নামে সংকলিত হয়েছিল মানসীতে (১২৯৭)। এ বইয়ের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন :

শেষ উপহার-নামক কবিতাটি আমার কোনো বন্ধুর রচিত এক ইংরেজি কবিতা অবলম্বন করিয়া রচনা করিয়াছি। মূল কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করিবার ইচ্ছা ছিল – কিন্তু আমার বন্ধু সম্প্রতি সুদূর প্রবাসে থাকা – প্রযুক্ত তাহা পারিলাম না।

বন্ধুর কবিতার বাংলা অনুবাদের ইংরেজি তর্জমা করেছিলেন পরবর্তীকালে; সেটি পাওয়া যাবে ‘দ্য ফিউজিটিভ’তে (১৯২১)। এখানে অনুবাদদ্বয়ের কয়েক ছত্র করে উদ্ধৃত হলো :

আমি রাত্রি, তুমি ফুল। যতক্ষণ ছিলে কুঁড়ি
জাগিয়া চাহিয়াছিনু আঁধার আকাশ জুড়ি
সমস্ত নক্ষত্র নিয়ে, তোমারে লুকায়ে বুকে;
যখন ফুটিলে তুমি সুন্দর তরুণ মুখে
তখনি প্রভাত এল; ফুরালো আমার কাল;
আলোকে ভাঙিয়া গেল রজনীর অন্তরাল।

I am like the night to you, little flower

I can only give you peace and a wakeful silence hidden in the dark.

When in the morning you open your eyes, I shall leave you to a world a-hum with bees, and songful with birds.

My last gift to you will be tear dropped into the depth of your youth; it will make your smile all the sweeter, and bemist your outlook on the pitiless mirth of day.

শেষের কবিতার সুবাদে জন ডানের কবিতার চারছত্র ‘দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর’ বা এলিয়টের ‘জার্নি অফ দ্য মেজাই’-এর রূপান্তর ‘তীর্থযাত্রী’র কথা সন্ধানী পাঠকমাত্রেরই জানা আছে। তুলনায় হয়তো অনধিক জানা সরোজিনী এবং হরীন্দ্রনাথের কাব্যানুবাদের সংবাদ।

ইংরেজি ভিন্ন আর যে-সব ইউরোপীয় ভাষার কবি ও কবিতার অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ : ইতালি/ দান্তে, পিত্রার্ক; জার্মান/ হাইনে; ফরাসি/ জাঁ পীয়ের ফ্লরিয়াঁ, হুগো। ফ্লরিয়াঁর অনুবাদ-কবিতাটি চারছত্রের এবং মন্ত্রপ্রতিম : প্রেমের আনন্দ থাকে/ শুধু স্বল্পক্ষণ,/ প্রেমের বেদনা থাকে/ সমস্ত জীবন।

ইউরোপীয় ভাষার সূত্রে স্মরণীয় রবীন্দ্রনাথের অভিভাষণ ‘দ্য রিলিজিয়ন অফ অ্যান আর্টিস্ট’ এবং ‘পয়লা নম্বর’ গল্পের কয়েকটি ছত্র।

প্রথমে ‘পয়লা নম্বর’ থেকে কয়েক ছত্র :আমি নিজের চেষ্টায় ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান শিখে নিলুম; অল্পদিন হল রাশিয়ান শিখতে শুরু করেছিলুম। আধুনিকতার যে এক্সপ্রেস গাড়িটা ঘণ্টায় ষাট মাইলের চেয়ে বেগে ছুটে চলেছে, আমি তারই টিকিট কিনেছি। তাই আমি হাক্স্লি-ডারুয়িনে এসেও ঠেকে যাই নি, টেনিসনকে বিচার করতে ডরাই নে, এমন-কি ইবসেন-মেটারলিঙ্কের নামের নৌকা ধরে আমাদের মাসিক সাহিত্যে সস্তা খ্যাতির বাঁধা কারবার চালাতে আমার সংকোচ বোধ হয়।

I myself have tried to get at the wealth of beauty in the literature of the European languages, long before I gained a full right to their hospitality. When I was young I tried to approach Dante, unfortunately through an English translation. I failed utterly, and felt it my pious duty to desist. Dante remained a closed book to me.

I also wanted to know German literature and, by reading Heine in translation, I thought I had caught a glimpse of the beauty there. Fortunately I met a missionary lady from Germany and asked her help. I worked hard for some months, but being rather quick-witted, which is not a good quality, I was not persevering. I had the dangerous facility which helps one to guess the meaning too easily. My teacher thought I had almost mastered the language, which was not true. I succeeded, however, in getting through Heine, like a man walking in sleep crossing unknown paths with ease, and I found immense pleasure.

Then I tried Goethe. But that was too ambitious. With the help of the little German I had learnt, I did go through Faust. I believe I found my entrance to the palace, not like one who has keys for all the doors, but as a casual visitor who is tolerated in some general guest room comfortable but not intimate. Properly speaking, I do not know my Goethe, and in the same way many other great luminaries are dusky to me.

Man can not reach the shrine if he does not make the pilgrimage, so one must not hope to find anything true from my own language in translation.

না, আশা করছি না তাঁর কাছে। কিন্তু সত্য এই যে, তিনি অনুবাদ করেছিলেন প্রচুর পারিমাণে। জাপানি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজির মাধ্যমে। কবির নাম অজ্ঞাত। ‘কোনো জাপানি কবিতার অনুবাদ হইতে’ উল্লেখে কড়ি ও কোমলে ‘বিদেশী ফুলের গুচ্ছ’ বিভাগে মুদ্রিত হয়েছিল এই কবিতাটি :

বাতাসে অশথপাতা পড়িছে খসিয়া
বাতাসেতে দেবদারু উঠিছে শ্বসিয়া।
দিবসের পরে বসি রাত্রি মুদে আঁখি,
নীড়েতে বসিয়া যেন পাহাড়ের পাখি।
(দশ পঙ্ক্তির স্তবক, চার স্তবকের অনুবাদটির প্রথম চারটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত হলো।)

দুই
নূতন ব্রাহ্মণ হওয়ার পর গায়ত্রীমন্ত্রটি রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে জপ করবার চেষ্টা করতেন। সে-বয়সে সংস্কৃত তিনি তেমন জানতেন না। কিন্তু ভালো লেগেছিল মুলাজোড়ে গঙ্গার ধারের বাগানে বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেঘদূত-আবৃত্তি। একবার পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বোটে বেড়াবার সময় পিতার সংগৃহীত ফোর্ট উইলিয়ম-প্রকাশিত গীতগোবিন্দ দেখতে পেয়ে সে-বই পাঠ করেছিলেন। তার অনেক অর্থ ছিল বালক রবীন্দ্রনাথের কাছে অজানা। লিখেছেন তিনি :

আমার মনে আছে ‘নিভৃতনিকুঞ্জগৃহং গতয়া নিশি রহসি নিলীয় বসন্তং’ – এই লাইনটি আমার মনে ভারি একটি সৌন্দর্যের উদ্রেক করিত – ছন্দের ঝংকারের মুখে ‘নিভৃতনিকুঞ্জগৃহং’ এই একটিমাত্র কথাই আমার পক্ষে প্রচুর ছিল। গদ্যরীতিতে সেই বইখানি ছাপানো ছিল বলিয়া জয়দেবের বিচিত্র ছন্দকে নিজের চেষ্টায় আবিষ্কার করিয়া লইতে হইত – সেইটেই আমার বড়ো আনন্দের কাজ ছিল।

অল্প বয়সের এই ভালো-লাগা পরিণত বয়সে হয়তো-বা মুক্তি লাভ করেছিল অনুবাদে। বেদ : সংহিতা, উপনিষৎ, ধম্মপদ, মহাভারত; কালিদাসের কুমারসম্ভব, মেঘদূত, অভিজ্ঞানশকুন্তল; উত্তররামচরিত, বেণীসংহার, নীতিসার, নীতিরত্ন, নীতিশতক, শৃঙ্গারেশতক, অমরুশতক, হিতোপদেশ (রচয়িতা : নারায়ণ পন্ডিত) পালি-প্রাকৃত কবিতা, শিখ ভজন, বিদ্যাপতির কবিতা ইত্যাদি অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রসঙ্গত, চারুচন্দ্র বসু-সম্পাদিত, প্রণীত, প্রকাশিত ধম্মপদংয়ের সমালোচনাসূত্রে রবীন্দ্রনাথ এই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন :

অনুবাদটি মূলের সঙ্গে একেবারে কথায় কথায় মিলাইয়া করিলে ভালো হয় – যেখানে দুর্বোধ হইয়া পড়িবে সেখানে টীকার সাহায্যে বুঝাইয়া দিলে কোনো ক্ষতি হইবে না। অনুবাদ যদি স্থানে স্থানে ব্যাখ্যার আকার ধারণ করে তবে অন্যায় হয়, কারণ, ব্যাখ্যায় অনুবাদকের ভ্রম থাকিতেও পারে – এইজন্য অনুবাদ ও ব্যাখ্যা স্বতন্ত্র রাখিয়া দিলে পাঠককে বিচার করিবার অবকাশ দেওয়া হয়। মূলের যে-সকল কথার অর্থ সুস্পষ্ট নহে অনুবাদে তাহা যথাযথ রাখিয়া দেওয়াই কর্তব্য মনে করি। গ্রন্থের প্রথম শ্লোকটিই তাহার দৃষ্টান্তস্থল। মূলে আছে -

মনোপুববঙ্গমা ধম্মা মনোসেট্ঠা মনোময়া।

চারুবাবু ইহার অনুবাদে লিখিয়াছেন – ‘মনই ধর্মসমূহের পূর্বগামী, মনই কর্মসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এবং ধর্ম মন হইতে উৎপন্ন হয়।’ যদি মূলের কথাগুলিই রাখিয়া লিখিতেন ‘ধর্মসমূহ মনঃপূর্বঙ্গম, মনঃশ্রেষ্ঠ, মনোময়’ তবে মূলের অস্পষ্টতা লইয়া পাঠকগণ অর্থ চিন্তা করিতেন। ‘মনই ধর্মসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’ বলিলে ভালো অর্থগ্রহ হয় না, সুতরাং এরূপ স্থলে মূল কথাটা অবিকৃত রাখা উচিত।

অনুবাদ রীতি/ পদ্ধতি সম্পর্কে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন বটে কিন্তু অনেক সময় আবার নিজেই মান্য করেননি নিজেকে। বলেছেন বিপরীত কথা। বঙ্গদর্শনে (আশ্বিন ১৩০৯) প্রকাশিত, প্রাচীন সাহিত্য গ্রন্থে সংকলিত ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধটি যদুনাথ সরকার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছিলেন, এটি প্রকাশিত হয়েছিল মডার্ন রিভিউতে (ফেব্রুয়ারি ১৯১১) Sakuntala : Its Inner Meaning শিরোনামে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য :

আপনি যেভাবে তর্জ্জমা করিয়াছেন ইহাই আমার কাছে ভাল বোধ হইল। বাংলায় যে সকল অলংকার শোভা পায় ইংরাজিতে তাহা কোনোমতেই উপাদেয় হয় না এইজন্য বাংলা মূলের অনেকটা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। ইংরাজিতে সবর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জ্জিত বক্তব্য বিষয়টির অনুসরণ করিলেই ভালো হয়।

নিজের রচনা নিজেই অনুবাদ করার সময় অনেক ক্ষেত্রে  প্রচুর গ্রহণ বর্জন-সংযোজন করেছেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে -

‘আমার ধর্ম্ম’ অনুবাদ প্রসঙ্গে একটি পত্রে লিখেছিলেন (২৮ অক্টোবর ১৯১৭) : ‘আমার ধর্ম্ম’ প্রবন্ধটা স্বহস্তে ইংরেজিতে তর্জ্জমা করবার জন্যে আমাকে আরো কেউ কেউ অনুরোধ করেচেন। চেষ্টা করে দেখ্ব। আমার মুষ্কিল এই যে, অনুবাদ করতে পারিনে, আমাকে প্রায় নতুন করে লিখতে হয়। কেন না ঠিকমত অনুবাদ করতে গেলে নিজেকে ভুলে লেখা চলে না। নিজেকে না ভুললে আমি কথা ভুলি, ব্যাকরণ ভুলি, স্টাইল ভুলি।

স্নেহলতা সেন রবীন্দ্রনাথের দুটি গান ‘তুমি রবে নীরবে’ ‘ঝর ঝর বরিষে বারিধারা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। অনুবাদ দুটি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখলেন (২৪ বৈশাখ ১৩২১) :

তোমার তর্জমা দুটি পাইলাম। কিন্তু বাংলা হইতে ইংরেজিতে তর্জমা ঠিক Literary হইলে চলে না। বিশেষত বাংলা গান। কারণ গানের সুরটুকুর ত তর্জমা হয়না। সেই অভাব পূরণ করিয়া লইবার জন্য ইরেজিতে অনেকটা বদল করিতে হয় নতুবা বড়ই ন্যাড়া দেখিতে হয়। কাজেই তোমার দুটি তর্জমাই আমাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিয়া লিখিতে হইল।…

… আমি যে কি প্রণালীতে তর্জমা করি তাহাই দেখাইবার জন্য তোমাকে এ দুটি পাঠাইলাম নহিলে আর কোন প্রয়োজন ছিল না। এরূপ তর্জমার যথেষ্ট স্বাধীনতা লওয়ার প্রয়োজন হয় এইজন্য আমি নিজে ছাড়া আর কাহারো উপর এ ভার দেওয়া যায় না।

সহজ কথায়, স্নেহলতা সেনের অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের না-পসন্দ তাই উত্তরের সঙ্গে নিজের অনুবাদ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর-একটা সূত্র এই উত্তর থেকে বেরিয়ে আসে : নিজের রচনা তর্জমায় মূল লেখক ‘যথেষ্ট স্বাধীনতা’ নিতেই পারেন। সেটা কোনো দোষের নয়। দীনেশচন্দ্র সেনকে লেখা আর-একটি চিঠি (১৯ পৌষ ১৩১৯) থেকে জানা যাবে নিজের রচনা নিজে অনুবাদ করার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথের অভিমত :

কথার কবিতা আমি এখানে বসিয়া নিজেই অনেকগুলা করিয়া ফেলিয়াছি। আমি দেখিলাম নিজে না করিলে কোনমতেই সুবিধা হয় না। কারণ, বাংলার ভাষা ও ছন্দের সঙ্গীত ইংরেজিতে যখন আনা সম্ভব নয় তখন কেবল ভাবমাত্রটিকে অত্যন্ত সরল ইংরেজিতে তর্জ্জমা করিলে, তবে তাহার ভিতরকার সৌন্দর্য্যটুকু ফুটিয়া উঠে। এই কাজটি আমার দ্বারা সহজেই হয় – কারণ সরল ইংরেজি ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছু হওয়া সম্ভব নহে, তারপরে নিজের ভাবটুকু অন্তত নিজে যথাসম্ভব বুঝি। সেদিকে ভুল হওয়ার আশঙ্কা নাই। ভাষাটাকে অত্যন্ত না জানার একটু সুবিধা আছে। অল্প জমি একজোড়া গরু জুতিয়াও খুব ভাল রকম চাষ দেওয়া যায় – তেমনি নিজের সঙ্কীর্ণ অধিকারের মধ্যে যেটুকু পারা যায় সেটুকুরই মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখিয়া বারবার করিয়া সেটাকে মাজাঘষা সহজ। যাহা ক্ষমতায় কুলায় না তাহা ছাড়িয়া দিই, যেখানে বাধা পাই সেখানে ঘুরিয়া যাই – নিজের জিনিষ বলিয়াই সেটা করা সম্ভব।

ধ্রুপদী সাহিত্য ছাড়াও সমকালীন কোনো কোনো কবির যেমন দেবেন্দ্রনাথ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কোনো কোনো কবিতা রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মন্ত্রের কবিতা তর্জমা করার মতো তাঁর শক্তির অনুপপত্তি এই মর্মে জানিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরীকে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা-অনুবাদকরূপে নিজের নাম প্রথমটায় প্রকাশে অনিচ্ছুক ছিলেন, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিতে জানিয়েছিলেন :

সত্যেন্দ্র দত্তের দুটো কবিতার তর্জ্জমা করে একজন আমার ডেস্কের উপর রেখে গেছে – কোনোমতেই আত্মপরিচয় দিতে চায় না – সেইজন্যেই তাঁর নাম ফাঁস করতে পারলুম না, মনে দুঃখ রইল। পরে অবশ্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে নামটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘ঠিক ঠাওরাইয়াছেন, অনুবাদক আমি; কিন্তু ঢাক-বাদকের হাতে সে কথাটা সমর্পণ করিবেন না।’ মডার্ন রিভিউতে অনুবাদগুলি ‘Translated by a Poet’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের রচনা নানা সময়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন নানাজন। অনুবাদকদের মধ্যে আছেন অজিতকুমার চক্রবর্তী, অমিয় চক্রবর্তী, আনন্দ কুমারস্বামী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, উইলিয়ম পিয়ারসন, এডওয়ার্ড থম্পসন, ক্ষিতীশ রায়, চার্লস ফ্রিয়ার এন্ডরুজ, ভগিনী নিবেদিতা, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যদুনাথ সরকার, হুমায়ুন কবীর, তারকনাথ সেন প্রমুখ। নিবেদিতার অনুবাদে ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘দান-প্রতিদান’ প্রকাশিত হয়েছিল মডার্ন রিভিউতে। চোখের বালি অনুবাদ করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুরেন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিও অনুবাদ করেছিলেন। পিয়ারসন অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প ‘মণিহারা’ The Lost Jewells নামে। গোরা উপন্যাসটিও পিয়ারসন ওই নামেই অনুবাদ করেন (১৯২৪)। যদুনাথ সরকার অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের এইসব রচনা : ভারতবর্ষের ইতিহাস/The Philosophy of Indian History, শকুন্তলা/ Sakuntala : Its Inner Meaning, সৌন্দর্যবোধ/ Beauty and Self-Control, একরাত্রি/ The Supreme Night, ঘাটের কথা/The River Stairs।

কিন্তু যিনি যা-কিছু করে থাকুন না কেন, রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিছু কম যাননি। গল্প-কবিতা-গান-নাটক-প্রবন্ধ-ভাষণ ইত্যাদি নিজের নানা ধরনের রচনা নিজেই অনুবাদ করেছিলেন। এই সমস্ত অনুবাদ এবং মূল ইংরেজিতে লেখা তাঁর রচনাদি চার খন্ডে The English Writings of Rabindranath Tagore নামে সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে (প্রকাশকাল যথাক্রমে ১৯৯৪, ১৯৯৬, ১৯৯৬, ২০০৭; প্রথম তিনটি খন্ড সম্পাদনা করেছেন শিশিরকুমার দাশ, চতুর্থ খন্ড নিত্যপ্রিয় ঘোষ)। যে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ তাঁকে এনে দেয় নোবেল পুরস্কার, একবার বিদেশযাত্রার মুখে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় শিলাইদহ চলে গিয়ে ‘একটা অনাবশ্যক কাজ’ হিসেবে নিজেই তার অনুবাদ শুরু করে দেন। গীতাঞ্জলি ছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছিলেন বিচিত্রিতা, বীথিকা, বলাকা, ছড়ার ছবি, ছবি ও গান, চৈতালি, চিত্রা, গীতালি, গীতিমাল্য, গীতিমালিকা, কণিকা, ক্ষণিকা, কড়ি ও কোমল, কথা, খেয়া, লিপিকা, মহুয়া, নৈবেদ্য, নবজাতক প্রভৃতির অসংখ্য কবিতা। এগুলি ছড়িয়ে আছে The Gardener, The crescent Moon : Fruit-Gathering, Lover’s Gift and Crossing, The Fugitive, Poems নামক গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথ অনূদিত নাটকের মধ্যে আছে Chitra (Indian Society 1913), Sacrifice and Other Plays (1917), Autumn-Festival (Modern Review 1919), The Trial (Modern Review 1920), The Waterfall (Modern Review 1922). Red Oleanders (Macmillan 1925)।

নিজের লেখা নিজে অনুবাদ করার সময় যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইংরেজি গীতাঞ্জলি মূল বাংলা গীতাঞ্জলির অনুবাদ নয়। অনুবাদের অবলম্বন চৈতালি, কল্পনা, নৈবেদ্য, স্মরণ, শিশু, উৎসর্গ, অচলায়তন, গীতিমাল্যর নানা গান/ কবিতা। ইংরেজি গীতাঞ্জলির ৯৫ সংখ্যক অনুবাদের মূলে আছে নৈবেদ্যর ৮৯ এবং ৯০ সংখ্যক কবিতার অংশবিশেষ। উৎসর্গ-এর ১৪ সংখ্যক কবিতা ‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি/ সেই ঘর মরি খুঁজিয়া’। কবিতাটি দশ পঙ্ক্তি-স্তবকের দশটি স্তবকে গঠিত। এর তৃতীয় স্তবকের শেষ দুই ছত্র, চতুর্থ স্তবক, অষ্টম স্তবকের প্রথম দুটি ছত্র, নবম স্তবকের প্রথম চারটি ছত্র এবং দশম স্তবকের শেষ চারটি ছত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি গড়েছিলেন :

The dumb earth looks into my face and spreads her arms about me.

At night the fingers of the stars touch my dreams. They know my former name.

Their whispers remind me of the music of a long silent lullaby. They bring to my mind the smile of a face seen in the gleam of the first daybreak.

There is love in each speck of earth and joy in the spread of the sky.

I care not if I become a flower, for the flower he takes up in his hand.

He is in the sea, on the shore; he is with the ship that carries all.

Whatever I am I am blessed and blessed is this earth of dear dust.


(পাঠকদের অনুধাবন সহজ হবে মনে করে মূল কবিতাটি এই সঙ্গে রইল)

সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি
সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।
দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি
সেই দেশ লব যুঝিয়া।
পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই -
তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই,
কোথা দিয়া সেথা প্রবেশিতে পাই
সন্ধান লব বুঝিয়া।
ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়,
তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।
রহিয়া রহিয়া নব বসন্তে
ফুলসুগন্ধ গগনে
কেঁদে ফেরে হিয়া মিলনবিহীন
মিলনের শুভ লগনে।
আপনার যারা আছে চারি ভিতে
পারি নি তাদের আপন করিতে,
তারা নিশিদিশি জাগাইতেছে চিতে
বিরহবেদনা সঘনে।
পাশে আছে যারা তাদেরই হারায়ে
ফিরে প্রাণ সারা গগনে।
তৃণে পুলকিত যে মাটি ধরা
লুটায় আমার সামনে -
সে আমায় ডাকে এমন করিয়া
কেন যে, কব তা কেমনে।
মনে হয় যেন সে ধূলির তলে
যুগে যুগে আমি ছিনু তৃণে জলে,
সে দুয়ার খুলি কবে কোন্ ছলে
বাহির হয়েছি ভ্রমণে।
সেই মূক মাটি মোর মুখ চেয়ে
লুটায় আমার সামনে।
নিশার আকাশ কেমন করিয়া
তাকায় আমার পানে সে।
লক্ষযোজন দূরের তারকা
মোর নাম যেন জানে সে।
যে ভাষায় তারা করে কানাকানি
সাধ্য কী আর মনে তাহা আনি;
চিরদিবসের ভুলে-যাওয়া বাণী
কোন্ কথা মনে আনে সে।
অনাধি উষায় বন্ধু আমার
তাকায় আমার পানে সে।
এ সাত-মহলা ভবনে আমার
চির-জনমের ভিটাতে
স্থলে জলে আমি হাজার বাঁধনে
বাঁধা যে গিঁঠাতে গিঁঠাতে।
তবু হায় ভুলে যাই বারে বারে,
দূরে এসে ঘর চাই বাঁধিবারে,
আপনার বাঁধা ঘরেতে কি পারে
ঘরের বাসনা মিটাতে।
প্রবাসীর বেশে কেন ফিরি হায়
চির-জনমের ভিটাতে।
যদি চিনি, যদি জানিবারে পাই,
ধুলারেও মানি আপনা।
ছোটো বড়ো হীন সবার মাঝারে
করি চিত্তের স্থাপনা।
হই যদি মাটি, হই যদি জল,
হই যদি তৃণ, হই ফুলফল,
জীব-সাথে যদি ফিরি ধরাতল
কিছুতেই নাই ভাবনা।
যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে
অন্তবিহীন আপনা।
বিশাল বিশ্বে চারিদিক হতে
প্রতি কণা মোরে টানিছে।
আমার দুয়ারে নিখিল জগৎ
শত কোটি কর হানিছে।
ওরে মাটি, তুই আমারে কি চাস।
মোর তরে জল দুহাত বাড়াস?
নিশ্বাসে বুকে পশিয়া বাতাস
চির-আহবান আনিছে।
পর ভাবি যারে তারা বারে বারে
সবাই আমারে টানিছে।
আছে আছে প্রেম ধুলায় ধুলায়,
আনন্দ আছে নিখিলে।
মিথ্যায় ঘেরে, ছোটো কণাটিরে
তুচ্ছ করিয়া দেখিলে।
জগতের যত অণু রেণু সব
আপনার মাঝে অচল নীরব
বহিছে একটি চিরগৌরব -
এ কথা না যদি শিখিলে
জীবনে মরণে ভয়ে ভয়ে তবে
প্রবাসী ফিরিবে নিখিলে।
ধুলা সাথে আমি ধুলা হয়ে রব
সে গৌরবের চরণে।
ফুলমাঝে আমি হব ফুলদল
তাঁর পূজারতি-বরণে।
যেথা যাই আর যেথায় চাহি রে
তিল ঠাঁই নাই তাঁহার বাহিরে,
প্রবাস কোথাও নাহি রে নাহি রে
জনমে জনমে মরণে।
যাহা হই আমি তাই হয়ে রব
সে গৌরবের চরণে।
ধন্য রে আমি অনন্ত কাল,
ধন্য আমার ধরণী।
ধন্য এ মাটি, ধন্য সুদূর
তারকা হিরণ-বরনী।
যেথা আছি আমি আছি তাঁরি দ্বারে,
নাহি জানি ত্রাণ কেন বল কারে।
আছে তাঁরি পারে তাঁরি পারাবারে
বিপুল ভূবনতরণী।
যা হয়েছি আমি ধন্য হয়েছি,
ধন্য এ মোর ধরণী।

স্বাক্ষর সংগ্রহকারীদের দাবি মেটাতে গিয়ে দু-চার ছত্রের কবিতাকণা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতে হয়েছিল চীনে জাপানে। সেইসব লেখা নিয়ে রবীন্দ্র-হস্তাক্ষরে প্রকাশিত হয় লেখন। এখানে একইসঙ্গে পাওয়া যাবে কবি-অনুবাদককে। কখনো নিজের বইয়ের পাতায় (যেমন Fireflies) অনুবাদ করেছিলেন নিজের কবিতা। একটি উদাহরণ :

পাখির পালক অলস আবেগে/ চুমিছে ধূলি/ আকাশলীলারে গেছে সে ভুলি।

শুধু অনুবাদ করেই ক্ষান্ত দেননি রবীন্দ্রনাথ। ‘১৮৯৬ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত’ অনেকগুলি ‘ছাত্রপাঠ্য পুস্তক রচনা সংকলন ও সম্পাদনা’ করেছিলেন তিনি। এদেরই অন্যতম অনুবাদ-চর্চা (১৩২৪/১৯১৭)। এ বইয়ের ‘নির্বাচিত অংশগুলির অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে ও সম্পাদনায় একাধিক ব্যক্তি করেন’। এমন একজন অনুবাদক সীতাদেবীর স্মৃতিচারণ :

এই সময় তিনি [রবীন্দ্রনাথ] ম্যাট্রিক ক্লাসের ছেলেদের জন্য একটি তর্জমার বই তৈয়ারি করিতে আরম্ভ করিলেন। নিজে নানা ইংরেজি মাসিকপত্র ও পুস্তক হইতে খানিকটা করিয়া জায়গা দাগ দিয়া দিতেন, আমাদের অনেকের উপর ভার ছিল সেগুলি সহজ বাংলায় রূপান্তরিত করা। …

রোজ দুপুরে গিয়া তাঁহাকে লেখাগুলি দেখাইয়া আসিতাম, নূতন কাজও লইয়া আসিতাম। তিনি নিজেও অনেক সময় বাড়িতে আসিয়া কাজ দিয়া যাইতেন। খাতা পাইবামাত্র সেইখানে বসিয়াই সংশোধন করিয়া দিতেন।

এই স্মৃতিচিত্র থেকে অনুমেয় কী গভীরভাবে অনুবাদকর্মকে গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অনুবাদ-চর্চার দ্বিতীয় সংস্করণে (১৩৪০/১৯৩৩) তাঁর দীর্ঘ ভূমিকায় অনুবাদের নানা খুঁটিনাটি বিষয় উদাহরণ সহযোগে বুঝিয়ে দিয়ে গ্রন্থ সংকলন সম্পর্কে তাঁর কথা যে-বইটিতে -

বিবিধ-বিষয়-ঘটিত বিবিধ ইংরেজি রচনারীতির বাক্যাবলী সংগ্রহ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, নানা রকমের প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে ছাত্রদের যেন পরিচয় ঘটে। আমার বিশ্বাস, যদি যথোচিত অধ্যবসায়ের সঙ্গে অন্তত দুই বৎসর কাল এই অনুবাদ প্রত্যনুবাদের পন্থা ধরে ভাষাব্যবহারের অভ্যাস ঘটানো যায় তা হলে ইরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই দখল জন্মানো সহজ হবে।

ভূমিকার শেষ অনুচ্ছেদে এই কথাটাও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ অত্যন্ত দুঃসাধ্য’। তবে ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে অনুবাদ উৎকৃষ্ট উপায়। শান্তিনিকেতন পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অনুবাদচর্চা’ নামক টুকরো প্রবন্ধে তিনি ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদের কলাকৌশল উদাহরণসহযোগে আলোচনা করেছেন। আকর্ষণ করেছেন পাঠক-মনোযোগ : and শব্দটার বাংলা কী হবে; কেমন হবে তার বাংলায় ব্যবহার। যোজক শব্দ  ‘ও’-এর পরিবর্তে ‘আর’ শব্দটাকে কি তার ‘স্বস্থানে’ ফিরিয়ে আনা যায় না! তর্জমা/ অনুবাদ অবলম্বন করেও যে উচ্চস্তরের রসিকতা সৃষ্টি করা যায় তার অদ্বিতীয় নজীর রেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্প-সল্পের অন্তর্গত ‘বাচস্পতি’তে। এই গল্পের অটলদা বাচস্পতিকে অনুরোধ করেছিলেন :

সেদিন যে সাধুভাষা বেরিয়েছিল তোমার মুখ দিয়ে, যার সধ্বংসৃনিত হার্দিক্যে বুদবুধিদের মন তিংতিড়ি তিংতিড়ি করে ওঠে, সেই ভাষার একটু নমুনা আজ এদের শুনিয়ে দাও। যে ভাষায় ভারতের ইতিহাসটি গেঁথেছ, যার গুরুভার হিসেব করে বলেছিলে ডুন্ডুম্মানিত ভাষা, তার পরিচয়টা চাই। শুনে এদের সকলের আন্তারা ফাঁচকলিয়ে যাক।

বাচস্পতি (কয়েকবারে বাধা পেরিয়ে) শুনিয়ে দেন :

সম্মম্রাট সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কটাকৃষ্ট ত্বরিৎএম্যন্ত পর্যূগাসন উত্থ্রংসিত নিরংকরালের সহিত অজাতশত্রু অপরিপর্যস্মিত গর্গরায়ণকে পরমন্তি শয়নে সমুসদ্গারিত করিয়াছিল। বাচস্পতিদের পাড়ায় একবার ছোটোলাট এলে বাচস্পতি তাঁকে এই বুগবুলি ভাষার ইংরেজি তর্জমা শুনিয়েছিলেন। অনুবাদটি এই :

দি হাববারফ্লুয়াস ইন্ফ্যাচুফুয়েশন অব আকবর ডর্বেন্ডিক্যালি ল্যাসেরটাইজট্ দি গর্বান্ডিজম্ অফ হুমায়ুন।

 
রবীন্দ্র-অনুবাদ : কিছু দৃষ্টান্ত
যিনি অগ্নিতে যিনি জলে,
যিনি সকল ভুবনতলে,
যিনি বৃক্ষে যিনি শস্যে,
তাঁহাকে নমস্কার -
তাঁরে নমি নমি বার বার।
যো দেবোহগ্নৌ যোহপ্সু
যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ।
য ওষধীষু যো বনস্পতিষু
তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ
শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ ২.১৭
বৈর দিয়ে বৈর কভু শান্ত নাহি হয়,
অবৈরে সে শান্তি লভে এই ধর্মে কয়
নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তীধ কুদাচনং।
অবেরেন চ সম্মন্তি এস ধম্মো সনন্তনো
ধম্মপদ, যমকবগ্গো
আসুক সুখ বা দুঃখ সুখং বা যদি বা দুঃখং
প্রিয় বা অপ্রিয়, পিয়ং বা যদি বা প্রিয়ম্।
বিনা পরাজয়ে তারে  প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত
বরণ করিয়ো হৃদয়েনাপরাজিতা
মহাভারত, শান্তিপর্ব ১৭৪.৩৯

উত্তর দিগন্ত ব্যাপি/ দেবতাত্মা হিমাদ্রি বিরাজে –/ দুই প্রান্তে দুই সিন্ধু,/ মানদন্ড যেন তারি মাঝে

অস্ত্ত্যত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা/ হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ।/ পূর্বাপরৌ তোয়নিধী বগাহ্য/ স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদন্ডঃ কুমারসম্ভব, ১.১

গগন গরজে ঘন ঘোর,/ কখন আসিবে প্রভু মোর!/ উদিল পঞ্চবাণ,/ এখন বাঁচে না মোর প্রাণ!/ করিব কোন প্রকার?/ যৌবন হইল জীবনের কাল।

গগন গরজি ঘন ঘোর/ (হে সখি) কখন আওত পহু মোর/ উগলন্হি পাঁচোবান/ (হে সখি) অব ন বচত মোর প্রাণ/ করব কওন পরকার/ (হে সখি) জৌবন ভেল জিব কাল  -  বিদ্যাপতি

যদিও বা ত্যজি বিরামের আশা,/ যখন গভীর রাতি,/ হাসি আলাপেতে থাকি নিমগন/ আমোদে প্রমোদে মাতি।/ তবু সে ভগন প্রাসাদের মতো/ লতায় পাতায় পোরা/ বাহিরেতে তার হরিত নবীন/ ভিতরেতে ভাঙাচোরা  -  জর্জ গর্ডন বায়রন

প্রেমের আনন্দ থাকে/ শুধু স্বল্পক্ষণ,/ প্রেমের বেদনা থাকে/  সমস্ত জীবন।  – জাঁ পিয়ের ফ্লরিয়াঁ

বারেক ভালোবেসে যে জন মজে,/দেবতা সম সেই ধন্য,/ দ্বিতীয়বার পুন প্রেমে যে পড়ে,/ মূর্খের অগ্রগণ্য।/ আমিও সে দলের মূর্খরাজ,/ দুবার প্রেমপাশে পড়ি,/ তপন শশী তারা হাসিয়া মরে,/ আমিও হাসি – আর মরি!  – হাইনরিশ হাইনে

 
The Cleanser

A free rendering, from the Bengali, of Satyendranath Datta’s ‘Scavenger’

Why do they shun your touch, my friend

and call you unclean

Whom cleanliners follows at every step.

making the earth and air sweet for

our dwelling, and ever luring

us back from return to the wild?

You held us, like a mother her child,

into freshness, and uphold the truth,

That disgust is never for man.

The holy stream of your ministry carries

Pollutions away and ever remains pure,

Once Lord Shiva had saved the world from

a deluge of poison by taking it himself,

And you save it everyday from filth with

the same divine sufferance.

Come friend, come my hero, give us courage

to serve man, even while bearing

the brand of infamy from him.

‘What of the night?’ they ask.

No answer comes.

For the blind Time gropes in a maze and knows

not its path or purpose.

The darkness in the valley stares like the dead

eye sockets of a giant,

The clouds like a nightmare oppress the sky, and the massive shadows lie scattered like the torn

limbs of the night. …

The Child


রাত কত হল?

উত্তর মেলে না।

কেননা, অন্ধ কাল যুগ-যুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে, পথ অজানা,

পথের শেষে কোথায় খেয়াল নেই।

পাহাড়তলিতে অন্ধকার মৃত রাক্ষসের চক্ষুকোটরের মতো;

স্তূপে স্তূপে মেঘ আকাশের বুক চেপে ধরেছে;

পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমা গুহায় গর্তে সংলগ্ন,

মনে হয় নিশীথরাত্রের ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ;

শিশুতীর্থ, পুনশ্চ

ফাগুন, শিশুর মতো, ধূলিতে রঙিন ছবি আঁকে,

ক্ষণে ক্ষণে মুছে ফেলে, চলে যায়, মনেও না থাকে।

April, like a child, writes hieroglyphics

on dust with flowers,

Wipes them and forgets.

দূর এসেছিল কাছে,

ফুরাইলে দিন, দূরে চলে গিয়ে আরো সে নিকটে আছে।

One who was distant came near to me

in the morning,

and came still nearer

when taken away by night.

আকাশের নীল

বনের শ্যামলে চায়।

মাঝখানে তার

হাওয়া করে হায় হায়।

The blue of the sky longs for the earth’s green.

The wind between them sighs, “Alas”

আলো যবে ভালোবেসে মালা দেয় আঁধারের গলে,

সৃষ্টি তারে বলে।

Light accepts Darkness for his spouse/ for the sake of creation.

লেখন

SHE WENT away when the night was about to wane. My mind tried to console me by saying, ‘All is vanity’.

I felt angry and said, ‘That unopened letter with her name on it, and this palm-leaf fan bordered with red silk by her own hands, are they not real?’

The day passed, and my friend came and said to me, ‘Whatever is good is true, and can never perish.’ ‘How do you know?’ I asked impatiently,  ‘was not this body good which is now lost to the world?’

As a fretful child hurting his own mother, I tried to wreck all the shelters that ever I had, in and about me, and cried, ‘This world is treacherous.’ Suddenly I felt a voice saying – ‘Ungrateful!’ I looked out of the window, and a reproach seemed to come from the  star-sprinkled night, – 

‘You pour out into the void of my absence your faith in the truth that I came!’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত