“ভালো কাজের পরিবেশ তৈরি করা জরুরী”

প্রকাশ : ২৬ মে ২০১৬, ১৫:১২

তাকে অনায়াসেই বাংলা চলচ্চিত্রের রাজ পরিবারের ছোট সম্রাট বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়। নায়ক রাজ রাজ্জাকের ছোট ছেলে খালিদ হোসাইন সম্রাট। বাবা নায়ক রাজ রাজ্জাক আর বড়ভাই একসময়ের অসামান্য জনপ্রিয় অভিনেতা বাপ্পারাজের পথ ধরেই চলচ্চিত্রে পা রাখেন সম্রাট। তারপর একটু একটু করে নিজস্ব মেধা আর ভিন্নধর্মী কাজের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করছেন রাজ পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে। বর্তমান কাজ স্বপ্ন ও হতাশার কথামালা নিয়ে আজকে সাহসের মুখোমুখি খালিদ হোসাইন সম্রাট।

সাহস: কেমন আছেন?
সম্রাট: ইনশাল্লাহ ভালো আছি।

সাহস: আপনার বর্তমান হালচাল নিয়ে কিছু বলুন?
সম্রাট: বর্তমানে সিনেমা আর টেলিভিশন দুই জায়গাতেই কাজ করছি। সে হিসেবে ব্যস্ততায় কাটছে দিনকাল। তবে সিনেমার চেয়ে টেলিভিশন প্রডাকশন নিয়েই বেশি ব্যস্ত।

সাহস: তবে কি সিনেমার কাজ কমিয়ে দিচ্ছেন?
সম্রাট: না আসলে বিষয়টা তেমন না। ঈদের জন্য টেলিভিশনের কিছু কাজ করলাম। টেলিভিশনে আমি মূলত পরিচালনাটা করছি বেশি। টেলিফিল্ম আর সিঙ্গেল নাটক ডিরেকশন দিচ্ছি নিয়মিত। পাশাপাশি শ্যুটার সিনেমার শ্যুটিং করছি। কারণ ভালো গল্প না হলে সিনেমার কাজ করছি না। তবে বছরে একটা কি দুইটা সিনেমা করবো। সিনেমায় কাজ কমিয়ে দেবার অন্যতম কারণ ভালো লাগার মতো গল্পের সঙ্কট। 

সাহস: শ্যুটার সিনেমায় আপনার অভিনীত চরিত্র কোন ধরণের?
সম্রাট: শ্যুটার সিনেমায় আমার চরিত্রটা অনেকটা এন্টি হিরো টাইপ চরিত্র। যেখানে আমি একজন পেশাদার খুনি। খুব রাফ আর এংরি একটা ক্যারেক্টার। আমি এর আগে এ ধরণের চরিত্রে অভিনয় করিনি। আর এই চরিত্রে নিজের ভিন্নধরণের অভিনয়ের কিছু সুযোগ রয়েছে, তাই আমি এই চরিত্রে অভিনয় করাটা উপভোগ করছি। আশাকরি দর্শককে একটি উপভোগ্য সিনেমা উপহার দিতে পারবো। 

সাহস: যদিও এটা আমরা সবাই জানি যে আপনার পরিবার আর বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে সম্পর্কটা অনেক গভীর আর অর্থবহ। কিন্তু আপনার মিডিয়ায় আসার শুরুটা কিভাবে?
সম্রাট: ২০০৬ সালে টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় আমার শুরু। তখন আমার বড়ভাই বাপ্পারাজ নিয়মিত প্রডাকশন করতেন। বাবাও তখন কাজ করতেন। তাদের সাথেই টেলিভিশনে আমার শুরুটা। তারপর একটু একটু করে নিজেকে প্রস্তুত করলাম সিনেমার জন্য। তবে আমি কিন্তু বরাবরই একইসাথে দুই মাধ্যমে কাজ করেছি। 

সাহস: অভিনেতা সম্রাটের উপর নায়ক রাজের প্রভাব কতটুকও?
সম্রাট: প্রভাব তো অবশ্যই আছে। কারণ আমার অভিনয় বা ডিরেকশন যাই বলি সবকিছুরই শুরু আমার বাবার হাত ধরে। তিনিই আমাকে হাতে ধরে সবকিছু শিখিয়েছেন। সেক্ষেত্রে আমার বাবাই আমার চলচ্চিত্র গুরু। আর ছাত্রের উপর শিক্ষকের প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি যতদিন মিডিয়ায় কাজ করবো আমি তার দেখানো পথেই চলবো আর তার স্কুলিংয়ে আমি যা শিখেছি তাই প্রয়োগ করবো।

সাহস: আর অভিনয়ের ক্ষত্রে প্রভাব? 
সম্রাট: না, আমি আসলে এখানটা তে নিজেকে মৌলিক বলবো কারণ আমি সম্রাট হয়েই অভিনয় করি এবং করতে চাই। তবে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বাবাই আমাকে আমার ভুল শুধরে দেয় আমাকে চরিত্র বুঝিয়ে দেয় আর সেই চরিত্র রুপায়নে আমার কি করণীয় সেটা বুঝিয়ে দেয়। বাবা আমার অভিনয়ের ভিতটা গড়ে দিয়েছেন বা এখনো গড়ে দিচ্ছেন কিন্তু কখনোই বলেনি যে তুমি আমার মতো করো। আর আমিও কখনোই চাইনি তার মতো অভিনয় করতে। কারণ তার মতো অভিনেতা হতে চাওয়া আমার জন্য সত্যি দুঃসাধ্য। 

সাহস: বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা অনেকসময় পরিবর্তনের কথা বলি। যেমন কিছুদিন আগেও আমরা খুব উচ্চকিত ছিলাম যে ডিজিটাল সিনেমা আসলে আমাদের চলচ্চিত্র ইতিবাচকভাবে পাল্টে যাবে। আসলেই কি আমাদের চলচ্চিত্র কাঙ্ক্ষিতভাবে পাল্টাচ্ছে?
সম্রাট: না আমার তো মনে হয়না যে এখানে কিছু ইতিবাচক হচ্ছে। কিছুই পাল্টায় নি কারণ যদি সত্যিকারেই চলচ্চিত্র পাল্টাতো তবে তো বছরে মিনিমাম ৫০/ ৬০ টা সিনেমা মুক্তি পেতো। আগে আমাদের সিনেমা যখন সেই ৩৫ মিমি তে ছিলো তখনও তো আমাদের দেশে বছরে ১০০ টা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, সেই সিনেমা ব্যাবসা সফলও হয়েছে। প্রযোজকরা লাভ তুলে আবার লগ্নী করেছে। এখন যারা বলে যে চলচ্চিত্র উন্নয়ন হয়েছে তবে এখন বছরে ২০/২৫ টা সিনেমা মুক্তি পায় কেনো? সেই ২০/২৫ টা সিনেমাও টাকা রিটার্ন আনতে পারেনা কেনো? আমার তো মনে হয় আমাদের চলচ্চিত্র দিনদিন তার বাজার আরও হারাচ্ছে।

সাহস: চলচ্চিত্রে নবীন যারা অভিনয়ে আসছে তাদের কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কি? 
সম্রাট: তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে তাদের মধ্যে কাজের প্রতি ভালোবাসা ও নিজেকে তৈরি করার চেষ্টাটা নেই। এখন যারা অভিনয়ে আসছে তাদেরকে দর্শকরা চেনে না। তাদেরকে বলতে হয় আমি অমুক আমি সিনেমায় অভিনয় করি। অথচ ১০/১৫ বছর আগেও দৃশ্যছিলো অন্য রকম। এসব কিছুর মূল কারণ পেশাদারিত্বের অভাব। 

সাহস: এই কারণেই কি বর্তমান অভিনয় শিল্পীদের মধ্য থেকে রাজ্জাক সাবানা আলমগীর হুমায়ূন ফরিদি বা সুবর্না মুস্তফা তৈরি হচ্ছেনা?
সম্রাট: আরও অনেক কারণ আছে। যেমন ধরেন আগে যেসব গুণী পরিচালক প্রযোজকরা সিনেমা বানাতেন তাদের বেশীরভাগ এখন আর কাজ করেনা। তাই নবীনদেরকে কাজ শেখাবার মতো কেউ নেই। অন্যদিকে নতুন যারা আসছে তারাও রাতারাতি স্টার হবার জন্য উঠেপড়ে লাগছে। কাজের মান বা নিজের অভিনয়কে শক্তিশালী করার চেয়ে তারা বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে সিক্স প্যাক নির্মাণে। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে টাকা দিয়ে টিকিট কেটে দর্শকরা নায়ক নায়িকার চেহারা বা সিক্স প্যাক দেখতে যায়না, দর্শক হলে যায় অভিনয় দেখতে। এভাবেই মানহীন কাজের কারণেই আমরা আমাদের দর্শক হারাচ্ছি।

সাহস: দর্শককে সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনতে কি কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার?
সম্রাট: সবার আগে মানসম্পন্ন সিনেমা হল বানাতে হবে, হলের সাউন্ডসিস্টেম উন্নত করতে হবে। যাতে একজন দর্শক হলে এসে সিনেমা উপভোগ করার একটা সুন্দর পরিবেশ পায়। তারপর ভিজ্যুয়ালাইজেশন ভালো করতে হবে। ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম ভালো করতে হবে। এরপর আসবে কাজের মানের চিন্তা। কারণ ভালো পরিবেশ নির্মাণ করতে না পারলে ভালো কাজ হবেনা। 

সাহস: ভিনদেশী সিনেমা থেকে গল্প চুরি করে সিনেমা নির্মাণের যে হিড়িক পড়েছে এটাকে কিভাবে দেখেন?
সম্রাট: এটা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভিনদেশী গল্প চুরিতে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের নিজস্ব কালচার। প্রতিটা সিনেমার গল্পে সেই দেশের পরিবেশ কালচার আচার আচরণ পোশাক বিদ্যমান থাকে, যারা ভিনদেশী গল্প চুরি করছে সেই গল্প কখনোই আমাদের গল্প হয়ে ওঠে না। বরং সেইসব সিনেমার সাথে এসে যায় সেই দেশিয় কালচার যা আমাদের নিজস্ব কালচারকে নষ্ট করছে। এই কারণে আপনি দেখবেন আমাদের আগের সিনেমাগুলো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতো কারণ সেইসব সিনেমায় আমাদের নিজস্বতা ছিলো। এখন আমরা আমাদের নিজস্বতা হারাচ্ছি।

সাহস: যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
সম্রাট: এখন যেসব চলচ্চিত্র হচ্ছে সেগুলো কি আদৌ যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র? যদি যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র হয় তবে একই চলচ্চিত্র কলকাতায় রিলিজের সময় পোষ্টার বা মূল সিনেমায় আমাদের কলাকুশলী বা পরিচালকের নাম থাকেনা কেনো? সেখানে আমাদের আর্টিষ্টদেরকে কেউ চেনে না। তবে এটাকে আপনি কিভাবে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র বলবেন। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির বেশীরভাগ মানুষ হুজুগে বাঙ্গালী। এক সময় তারা অশ্লীল সিনেমায় ঝাপিয়ে পড়েছিলো আর এখন যৌথ প্রযোজনায় ঝাপিয়ে পড়েছে। ফাইনালি তারা কি বানাচ্ছে বা এতে ইন্ডাস্ট্রির কি লাভ নাকি ক্ষতি হচ্ছে সেই ভাবনা তাদের মাথায় নেই। কিন্তু এসব সিনেমা করে লাভ কি? কারণ সেইসব সিনেমার মধ্যে একটা সিনেমাও কি ব্যবসা সফল হয়েছে? কোন প্রযোজকের কি টাকা রিটার্ন এসেছে? আসেনি। জাস্ট হুজুগ। 

সাহস: অভিনেতা সম্রাটকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি?
সম্রাট: ভালো ভালো চরিত্রে কাজ করতে চাই। মাঝখানে আমি সিনেমা থেকে দূরে ছিলাম কারণ ভালো গল্প আর ভালো চরিত্র পাচ্ছিলাম না বলে। এখন কাজ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। অনেকে ভালো কাজ করছে। ভালো ভালো অফার পাচ্ছি। তাই চলচ্চিত্রে আবার নিয়মিত হতে চাই। তেমন কিছু কাজ করতে চাই যা আমাকে দর্শকের কাছে স্মরণীয় করে রাখবে।

সাহস: বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি?
সম্রাট: বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে স্বপ্ন বাংলা চলচ্চিত্র তার নিজস্বতা দিয়ে মৌলিকত্ব নিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রে একটা সম্মানজনক জায়গা তৈরি করে নিক। 

সাহস: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সাহসকে সময় দেবার জন্য।
সম্রাট: আপনাকে এবং সাহসকেও ধন্যবাদ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত