মহানায়ক হয়েই রয়ে যাবেন সকল বাঙালির হৃদয়ে

প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:১৫

ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলার প্রথম সুপারস্টার হলেন উত্তমকুমার। তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাংলা সিনেমার একজন কিংবদন্তী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক হিসেবে আজও দর্শক হৃদয়ে পাঁকা আসনে অধিষ্ঠিত । শুরুতে অরুণ কুমার নামে কিছু বানিজ্যিক ভাবে অসফল সিনেমা দিয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার সব থেকে জনপ্রিয় নায়ক। তার সময়ে তাকে ম্যাটিনি আইডল বলা হত। সেই সময়ের যুবকেরা উত্তমকুমারের মত হতে চাইতেন, সকল শ্রেণি বয়সের নারীরা উত্তমকুমারের নামে মোহচ্ছন্ন ছিলেন।

৩রা সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে কলকাতার আহিরীটোলায় মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ হয় উত্তমকুমারের। তার পিতৃনিবাস হল কলকাতার ভবানীপুরে। উত্তমকুমারের আসল নাম অরুণ কুমার চ্যাটার্জী। তার পিতা সাতকড়ি চ্যাটার্জী এবং মা চপলা দেবী। তার দুই ভাই হলেই বরুণ এবং তরুণ। শুরুতে সাউথ সাবার্বান স্কুলে পড়াশোনা করে তিনি পরে গোয়েঙ্কা কলেজে উচ্চ শিক্ষার জন্যে ভর্তি হন। সেখানে বিজনেস এবং কমার্সের শাখায় পড়াশোনা করেন। অবশ্য নানান কারণে তার শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকে এবং তিনি কলকাতা পোস্ট ট্রাস্টে ক্লার্কের চাকরী গ্রহণ করেন।

চাকরীর পাশাপাশি সুহৃদ সমাজ নাট্যগোষ্ঠীতে তিনি অভিনয় করতেন। এটি তাদের পারিবারিক নাট্যগ্রুপ হিসেবে খ্যাত। নিতীন বোস পরিচালিত মায়াডোর নাটকে তিনি সকলের নজর আকর্ষণ করেন। এরপর নীতিন বোসের পরিচালনায় দৃষ্টিদান ছবিতে ১৯৪৮ সালে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। এই সময় তিনি নিজের আসল নাম অরুণ কুমার চ্যাটার্জী লিখতেন। পরপর কিছু ছবি ফ্লপ হওয়ার পর যখন তিনি সিনেমা ছেড়ে দেবেন এই রকম ভাবছিলেন সেই সময় ১৯৫৩ সালে নির্মল দের পরিচালনায় সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। এই ছবিতে উত্তম কুমার মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন না, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায় প্রমুখ অভিনেতারাই ছিলেন এই ছবির প্রধান আকর্ষণ। এই ছবি সেই সময় ভীষণ জনপ্রিয় হয় এবং সাধারণ দর্শক উত্তমকুমারকে পছন্দ করা শুরু করেন। 

উল্লেখ্য এই ছবি দিয়েই প্রথম উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনের জুটির যাত্রা শুরু৷ পরবর্তীকালে এই জুটি বাংলা ছবির জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। এই ছবির পর উত্তমকুমারকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মুখ্য ভূমিকায় সাফল্যের সাথে অভিনয় করে গেছেন।

সুচিত্রা সেন-উত্তমকুমার জুটি বাংলা সিনেমার অমর জুটি নামে খ্যাত। তারা দুজন এক সাথে প্রায় ৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এবং সবক'টি চলচ্চিত্রই চুড়ান্ত সাফল্যলাভ করেছে। তাদের অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো - হারানো সুর, অগ্নী পরীক্ষা, প্রিয় বান্ধবী, শাপমোচন, ইন্দ্রাণী, সপ্তপদী ইত্যাদি ৷ এই জুটি প্রায় কুড়ি বছর ধরে সেরার শিরোপা ধরে রেখেছিল।

সুচিত্রা সেন ছাড়াও উত্তমকুমারের সাথে যে নায়িকার জুটি প্রায় সমানে সমানে আলোচিত তিনি হলেন সুপ্রিয়া দেবী। সোনার হরিণ চলচ্চিত্র থেকে তাদের জুটির যাত্রা শুরু। এরপর তারা একে একে উত্তরায়ণ, কাল তুমি আলেয়া, সন্যাসী রাজা, বন পলাশীর পদাবলী, বাঘ বন্দীর খেলা ইত্যাদি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ৷ চলচ্চিত্রের জগত ছাড়াও বাস্তবেও সুপ্রিয়া দেবীর সাথে উত্তম কুমারের এক গভীর সম্পর্ক ছিল। নিজের স্ত্রী এবং বাড়ি ছেড়ে নিজের জীবনের শেষ সতের বছর তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সাথেই কাটিয়েছেন। সুপ্রিয়া দেবীও নিজের স্বামীকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে উত্তমকুমারের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।

উত্তম সুচিত্রা এবং উত্তম সুপ্রিয়ার ক্রেজ শেষ হওয়ার পর শেষ দিকে উত্তমকুমারের সাথে সাবিত্রী চ্যাটার্জীর জুটি খুবই জনপ্রিয় হয়। উত্তমকুমার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সাবিত্রীকে প্রতিভাশালী অভিনেত্রী অ্যাখ্যা দিয়ে এসেছেন। তাদের করা উল্লেখযোগ্য কিছু চলচ্চিত্র হল- হাত বাড়ালেই বন্ধু, দুই ভাই, নিশি পদ্ম, মমের আলো ইত্যাদি। ধন্যি মেয়ে বা মৌচাকের মত কমেডি চলচ্চিত্রে সাবিত্রীর সাথে জুটি বেঁধে উত্তম কুমারের হাসির অভিনয় আজও সকল দর্শকের মন জয় করে।

খুবই অল্প বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৪শে জুলাই ১৯৮০ সালে উত্তমকুমার মৃত্যুবরণ করেন। বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। সেই সময় ওগো বঁধু সুন্দরী সিনেমার শুটিং করছিলেন। শেষ দিনের শুটিং চলাকালীন হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে নেমে আসে এক গভীর শোকের ছায়া। তার অন্তিম যাত্রায় সারা কলকাতা পথে বেরিয়ে আসে। বাংলা সিনেমা যতদিন থাকবে উত্তমকুমার মহানায়ক হয়েই রয়ে যাবেন সকল বাঙালির হৃদয়ে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত