কোথায় যাচ্ছে আমাদের শিল্পমাধ্যম

প্রকাশ | ০৮ মে ২০১৬, ১৬:৩৯

আমাদের চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতশিল্প এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শঙ্কা জাগে যে এগিয়ে যাচ্ছে কোথায়? নকল আর চৌর্যবৃত্তির অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে না তো? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা শিল্প সচেতন প্রতিটি মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। আরও বেশি ভাবিয়ে তুলছে যখন এইসব নকল বা কপি করা কাজ সম্মানিত হচ্ছে দেশীয় বিভিন্ন সম্মাননায়। এই বছরের শুরুতে সবচেয়ে আলোচিত চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ছিলো মুরাদ পারভেজের বৃহন্নলা সিনেমাকে কেন্দ্র করে।

২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এবং সদ্য ঘোষিত ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৪’ তে সেরা ছবি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ‘বৃহন্নলা’র বিরুদ্ধে গল্প চুরির অভিযোগ উঠে। যেই ঘটনা মন্ত্রীসভা অব্দি পৌছায়। সরকারি অনুদানে নির্মিত মুরাদ পারভেজের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ‘বৃহন্নলা’র মূল কাহিনি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোটগল্প ‘গাছটি বলেছিল’ থেকে নেওয়া বলে অভিযোগ উঠেছিলো। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ‘গাছটি বলেছিল’র গল্প চুরি করে ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিযোগে ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও দেবেশ রায়। এছাড়া সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ একাডেমির সচিব সৈয়দ হাসমত জালালও একটি চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু দেশ বিদেশী সমালোচনার মুখে বাতিল হয় বৃহন্নলার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার।

চুরিবিদ্যার পুরস্কৃত হবার দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে নাট্যনির্মাতা আশরাফুল চঞ্চলের ক্ষেত্রে। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। তবে তিনি বনফুল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন বাংলা সাহিত্যে। তার বিখ্যাত গল্প ‘স্ত্রী-চরিত্র’। বনফুল গল্প সমগ্র প্রথম খন্ডের ১৬৯ পৃষ্ঠার গল্প এটি। এই গল্পকে হুবহু নকল করে নাট্যকার আশরাফুল চঞ্চল গেল বছরের রোজা ঈদে তৈরি করেছিলেন নাটক ‘অনিন্দিতা’। নাটকে আশরাফুল চঞ্চল নিজেই ছিলেন চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। নাটকটি বনফুলের গল্পের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। সহজেই অনুমান করা যায়, বনফুল থেকে অনুপ্রাণীত হয়েছেন তিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় ইউটিউবে নাটকটি দেখে কোথাও বনফুলের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে নাটক পাড়ায়। তারও চেয়ে লজ্জার বিষয় হলো, চুরি করা গল্প থেকে ‘অনিন্দিতা’ নাটকের চিত্রনাট্য লিখে ‘মেরিল-প্রথম আলো ২০১৫’ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সেখানে টেলিভিশন সমালোচক ক্যাটাগরিতে সেরা চিত্র নাট্যকার হিসেবে পুরস্কৃত হলেন চঞ্চল! যা নাট্যচর্চা ও নাট্যাঙ্গনের শরীরে অপবিত্র এক কালিমা মেখে দিলো বলেই অভিমত নাট্যকর্মীদের।

নকল ঠেকাতে যখন সবাই একাট্টা হবার কথা তখন নকলবাজদেরকে এইসব পুরষ্কার প্রদান পুরস্কারদাতা প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নিয়ে যেমন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে তেমনি প্রকারান্তরে উৎসাহিত করছে শিল্পে চৌর্যবৃত্তিকে।

পুরষ্কার না পেলেও সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য অন্যের মেধাসত্ব চুরি করছেন নবীন থেকে প্রবীণ অনেকেই। আরেফিন রুমি, ইমরানের মতো নবীন শিল্পীদের মতোই এবার গানের কথা, সুর, মিউজিক চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন ৯০ দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘ডিফারেন্ট টাচ’ এর গায়ক মেজবাহ রহমান।

ফয়সাল রাব্বেকীন এর কথায় আরেফিন রুমির সুর ও সঙ্গীতে ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত ‘তুমি ছাড়া’ শিরোনামে একটি গানের মিউজিক ভিডিও প্রকাশিত হয় কিছুদিন আগে। তবে সেই মিউজিক ভিডিওর কনসেপ্ট সুর মিলে গেছে ভারতের সুপারহিট সিনেমার গানের সাথে। শুধু গানের সুর নয় কথাও হয়েছে অনুবাদ। ভারতের সুপারহিট সিনেমা আশিকি-২ এর তুমুল জনপ্রিয় গান ‘হাম তেরি বিন’ এর হুবহু অনুবাদ এবং সুর পাওয়া গেল রুমি-রাব্বেকীন এর যুগল সৃষ্টিতে। এর আগে কর্ণিয়ার ‘হিরো’ গানটিও তেলেগু নায়ক সিনেমার টাইটেল গান’র হুবহু কথা ও সুরের নকল করে সমালোচিত হন রুমি।

এখানে উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক সময় গায়িকা কণা’র ‘রেশমী চুড়ি’ শিরোনামের গানটির সুর এবং মিউজিক ভিডিও অনুকরণের দোষে সমালোচিত হয়।

ইতিমধ্যে সমালোচনায় জর্জরিত গায়ক ইমরানের নতুন গান ‘ফিরে এসো না’র মিউজিক ভিডিও। রাশিয়ান গানের কনসেপ্ট এবং দৃশ্যায়ন ও পাকিস্তানী গায়ক ‘ফালাক’ এর তুমুল জনপ্রিয় গান ‘ইজাজত’র সুর চুরির সমালোচনায় ইতিমধ্যে বিতর্কিত করেছে নির্মাতা চন্দন চৌধুরীকে। তবে সে রেশ কাটার আগেই নতুন অভিযোগে অভিযুক্ত ডিফারেন্ট টাচের জনপ্রিয় শিল্পী মেজবাহ রহমান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি হচ্ছে গত ৯ এপ্রিল লেজার ভিশন থেকে প্রকাশিত হয় মেজবাহ রহমানের গানের এ্যলবাম ‘তোমার জন্য’। এ্যলবামে মোট গান রয়েছে ৮ টি। যার মধ্যে দুটো গান ‘আমার মরণ জানি’ এবং ‘রাজা যায় রাজা আসে’ নকল হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। যদিও এ্যলবামের প্রচ্ছদে গান দুটোর সুরকার হিসেবে রয়েছে মেজবাহ রহমানের নাম। অথচ লালনের জনপ্রিয় গান ‘আমার ঘরের চাবি’ আর শিলাজিত’র ‘স্বাধীনতা’ গান দুটোর সুর গান দুটোতে হুবহু পাওয়া গেছে। অবশ্য প্রচ্ছদের বক্তব্যে একটা লাইন দেয়া আছে এই বলে যে, ফোক গান দুটোর সুর প্রচলিত। অথচ লালনের এই গানটি বিখ্যাত মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম থেকে শুরু করে হাল আমলের কলকাতার ব্যান্ড মরুদ্যান’র কন্ঠশিল্পী পটা সবাই একই সুরে গেয়েছে। ফলে তা কতটা প্রচলিত বা উৎসহীন তা প্রশ্ন রাখা যেতেই পারে। শুধু তা-ই না। সুর যদি প্রচলিত হয়েও থাকে, তাহলে কথার সাদৃশ্য কিভাবে আসলো সেটাও প্রশ্ন! কারণ লালনের গানে বলা হয়েছে, ‘আমার ঘরের চাবি পরেরও হাতে’, অন্যদিকে মেজবাহ’র গানের কথা হলো, ‘আমার জীবন জানি তোমারও হাতে’। অন্যদিকে ‘রাজা যায় রাজা আসে’ গানটার কিছু অংশ ভিন্ন সুরে গেয়েছেন মেজবাহ রহমান।

আর গত সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র অস্তিত্ব। অনন্য মামুন পরিচালিত এই সিনেমা মুক্তির শুরুতেই সমালোচিত হয় সিনেমার পোষ্টার নকলের অভিযোগে। যেখানে দেখা যাই ভারতীয় ছবির পোষ্টার থেকে ভারতীয় অভিনেতা হৃত্তিক রোশনের মাথা কেটে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে অস্তিত্ত সিনেমার অভিনেতা আরেফিন শুভ’র মাথা। যা বিরক্ত ও বিব্রত করে তোলে সিনেমাপ্রেমী মানুষকে। তরুণদের পাশাপাশি সিনিয়র গায়কের এমন চুরির ঘটনায় বিষ্মিত বাংলা গান ও সিনেমপ্রেমীরা।

বারবার অভিযোগের আঙ্গুল উঠলেও এইসব নির্মাতা আর শিল্পীদের কোন ভাবোদয় হচ্ছে না। তারা একেরপর এক চুরি করেই যাচ্ছে। এই লাগামহীন প্রকাশ্য চৌর্যবৃত্তির বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতপ্রেমীদের সম্মিলিত প্রতিবাদই পারে আমাদের শিল্পমাধ্যমকে রক্ষা করে তাকে মৌলিকত্ব ফিরিয়ে দিতে।