ভয়াল সিডরের দুঃসহ স্মৃতি

আজও স্বজনদের খুঁজেফেরে তাঁরা

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ১২:১৯

মনে হইছেলে এই পানির আত (হাত) দিয়া মোরা আর রক্ষা পামু না। জীবনা মনে অয় (হয়) বানের পানির লগে ভাইসা যাইবে। হের পরও ক্যামনে ক্যানমে জানি বাইচ্চা গ্যালাম। কিন্তু রাইত (রাত) পোয়াইতেই (ভোর হতেই) চাইরদিক (চারদিক) চাইয়া দেহি লাশ আর লাশ, মাইনসের লাশ, গরু-ছাগল মইর‌্যা (মরা যাওয়া) ভাইস্যা ওঠছে। এই কতা (কথা) মনে অইলে আহ-পাও (হাত-পা) সব ঠাণ্ডা অইয়া (হয়ে) যায়। এভাবেই কথাগুলো বলছিল পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর উপজেলার কলারণ এলাকার নুরুল ইসলাম।

আমরা এই সব দু:খ গাঁথা শুনতে শুনতে পৌছে গেলাম একই উপজেলার পূর্ব চণ্ডিপুর গ্রামের জেলে ইব্রাহিম সেখ বাড়িতে। ইব্রাহিমের সাথে কথা বলতেই তাঁর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই শোকগাঁথা।

সন্ধ্যা রাইত অইতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি অইলেও হেরহম কিছু মনে হরি নাই। আর হেইডাই ছিল জীবনের সবচাইতে বড় ভুল। হেই দিন মোর যদি একটু সাবধান অইতাম তয় আর মোর পোলামাইয়া গুলাতে হাড়াইতে অইতো না। কোনো কিছু বোঝার আগেই বইন্যার পানি যখন প্রচণ্ড বেগে আইতে শুরু করলো তখন বউ (জয়নব বিবি), পোলা দুইডা (রাকিব (১), সাকিব (৪) আর মাইয়াডা নাইমকে(১১) লইয়া ঘর দিয়া বাইরাই। কিন্তু কাপালের জোড়ে মোর বউ আর মুই কোন রহম বাইচ্চা গ্যালেও বইন্যা থাইম্যা যাওয়ার দুই দিন পর মোগ বাড়ি দিয়া ১ মাইল দূরে মালবাড়ি পোলের (ব্রিজ) ধারে ধানক্ষেতে মইদ্ধে পোলা-মাইয়া তিনডার লাশ পাই।

পিছনে ফিরে দেখাঃ
২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর সারা দেশের আকাশ ছিল মেঘলা। আবহাওয়াবিদরা প্রথমে ৫ নম্বর সংকেত দিতে থাকেন। রাতে তা ৮ নম্বর বিপদ সংকেতে গিয়ে পৌঁছায়। ১৫ নভেম্বর সকালে ঘোষণা করা হয় সিডর নামের ঘূর্ণিঝড় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলে। দুপুর নাগাদ তা বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করবে। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত।

এই মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া। সচেতন কিছু মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে শুরু করলেও বেশির ভাগ মানুষ থেকে যায় নিজ বাড়িতে। রাত ১০ টার দিকে প্রবল বাতাসের সঙ্গে যুক্ত হলো জলোচ্ছ্বাস। 

ওইদিন (১৫ নভেম্বর) বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হলেও রাত ১১টার দিকে প্রচণ্ড বেগে পিরোজপুরের জিয়ানগরসহ উপকূলে এলাকায় আঘাত হানে সিডর। এ সময় ৮ থেকে ১০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। হাজার হাজার গাছপালা এবং সহস্রাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় গৃহহীন হয়ে পড়ে অসংখ্য পরিবার। চারদিকে নদী বেষ্টিত সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকা জিয়ানগরে সেদিন সিডরের হিংস্র থাবায় নারী, পুরুষ, শিশুসহ ৬৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন শতশত নারী পুরুষ। উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩নং বালিপাড়া ইউনিয়ন। শুধু ওই এলাকায়ই নিহত হয় ৫৭ জন। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা বলা হয় ৩৩৬৩ জন। তবে বেসরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা আরো বেশি।

স্বজন হারানোদের বোবা কান্নাঃ
৪ বছরের শিশু কন্যা চাঁদনিকে হারিয়ে এখনো মূর্ছা যান মা খাদিজা বেগম। সেদিন প্রিয় সন্তানকে হরানোর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে মেয়ের ছবি বুকে জড়িয়ে অঝর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। প্রচণ্ড বাতাস আর জলোচ্ছ্বাসে যখন তার ঘর দুমড়ে মুচড়ে পড়ে তখন মেয়ে চাঁদনিকে নিয়ে নেমে পড়েন বাইরে। কিন্তু রাস্তায় উঠতেই তাদের দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সর্বনাশা পানি। খাদিজা বেগমকে একটি গরুর লেজ ধরা অবস্থায় ভোর রাতে বাড়ি থেকে ১ কি. মি. দূরে পানের বরজ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ধানক্ষেত থেকে ৬ দিন পর একমাত্র মেয়ে চাঁদনির লাশের সন্ধান মেলে। এতো গেলো শিশু চাঁদনির কথা।

অপরদিকে, পূর্ব চরবলেশ্বর গ্রামের দিনমজুর মতিউরের স্ত্রী লালভানু (৩০) তখন ৩ সন্তান নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসে যখন ঘরে থাকার উপায় নেই তখন বাঁচার তাগিদে সন্তানদের নিয়ে পাশের একটি এনজিও অফিসে আশ্রায় নেয়ার জন্য রাস্তায় বের হতেই পানির তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের সবাইকে। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি ৩ দিন পর লালভানুকে ৪ বছরের মেয়ে কুলসুম এবং তার দু বছরের শিশুছেলে সাকিবকে বুকে জড়ানো অবস্থায় বাড়ি থেকে আধা কি. মি. দূরে ধানক্ষেতে তাদের লাশ উদ্ধার করে এলাকাবাসী। 

বাড়িতে অবস্থান না করায় ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে গেলেও স্ত্রী এবং দু’সন্তানকে হারিয়ে আজও নির্বাক মতিউর। সিডরের ভয়ালও থাবা কেড়ে নেয় খোলপটুয়ার হানিফ জোমাদ্ধারের স্ত্রী ও এক সন্তানকে। এভাবেই মাঝের চরের গৃহবধূ ময়না, কুলছুম, পূর্ব চণ্ডিপুর গ্রামের ফয়সাল (৭) ও ১৪ দিন বয়সের হ্দয়ের মতো আরো অনেককে ওইদিন চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে।

পূর্ব চণ্ডিপুর গ্রামের জেলে মনির গাজী সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে বলেন, ‘সেদিন বড় ড্যাগের (পাতিল) মধ্যে করে ভাসিয়ে নিয়ে আমার দুই শিশুর প্রাণ রক্ষা করি।’

একই গ্রামের ১২ বছরের শিশু সোহাগ বলেন, ‘সিডরের সময় আমার বয়স তখন ৫ বছর। বাঁচার জন্য সেদিন আমিসহ আরো ৮ জন শিশু তিন ঘণ্টা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে একটি আম গাছের ডাল ধরে জীবন বাঁচাই।’

এমন আরো হাজারো স্বজনহারাদের শোকগাথা শুনতে শুনতে সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে যাত্রা শুরু করে। আমরাও ফিরে আসি স্বজনহারা মানুষগুলোর ঘুরে দাড়ানোর প্রচেষ্টা এগিয়ে চলুক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত