আবারও সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে যাচ্ছে ইসাবেলা ফাউন্ডেশন

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সোয়াচের উপর এবং পানিতলে গবেষণা চালাবে ইসাবেলার ৪০ জন গবেষক

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:০২

আগামী ১৭ নভেম্বর থেকে ২১ নভেম্বর থেকে পাঁচদিন সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের নীল জলরাশিতে গবেষণা চালাবে গবেষক দল। প্রস্তুত ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের ৪০ জন গবেষক। ইসাবেলার আয়োজনে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহযোগিতায় এবার গবেষকদের দলে সাথে যুক্ত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির জরীপ জাহাজ মীন সন্ধানী।

১৫ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানান ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ার। তারই নেতৃত্বে সোয়াচের নীলজলের উপরিভাগসহ পানির নিচেও গবেষণা ও তথ্যচিত্রের জন্য তিনজন প্রশিক্ষিত স্কুবা ডাইভারও প্রস্তুত।

ইসাবেলার গবেষক দলের প্রধান পরামর্শক ড. আনিসুজ্জামান খান বলেন, গবেষণার জন্য নানান প্রতিষ্ঠানের ১২টি বিভাগের মোট ৪০ জন গবেষক আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে অভিযানে যোগ দিচ্ছেন। সোয়াচে বিস্তর এই গবেষণাকে গণমাধ্যমের মাধ্যমে সারা বিশ্ব জানাতেই এই সম্মেলন।

এর আগে এবছরের মার্চ মাসে ১৩ জনের একটি গবেষক দল সোয়াচের নানা এলাকা ঘুরে গবেষণাধর্মী একটি মানচিত্রের কাজ সম্পন্ন করে এসেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবার পাঁচদিনের এই অভিযাত্রা।

সোয়াচে নিরাপত্তাসহ ইসাবেলার ফাউন্ডেশনের গবেষণার নিজস্ব যন্ত্রপাতির সাথে এবার দৈর্ঘ্য ৩৭ দশমিক ৮ মিটার, প্রস্থ ৯ দশমিক ২ মিটার এবং গভীরতা ৩ দশমিক ৩ মিটারের অত্যাধুনিক মীন সন্ধানী জাহাজ থাকছে। নতুন এই জাহাজটি সমুদ্রের পানিতে ৩৬০ ডিগ্রি অবতলে ২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত জীবিত যে কোনও জলজ প্রাণী চিহ্নিত করতে সক্ষম।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে পূর্বে অভিযান সম্পন্ন করে ইসাবেলার গবেষকরা জানিয়েছিলেন এর (Swatch-of-No-Ground) খাদ আকৃতির সামুদ্রিক অববাহিকা বা গিরিখাত, যা বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানকে কৌণিকভাবে অতিক্রম করেছে। এটি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। গঙ্গা খাদ নামেও এটি পরিচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের আরও কিছু বদ্বীপমুখী খাদ দেখতে পাওয়া যায়, যেমন সিন্ধু নদীর মোহনার অদূরে সিন্ধু খাদ, মিসিসিপি বদ্বীপের পশ্চিম পাশে মিসিসিপি খাদ। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের প্রস্থ ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার, তলদেশ তুলনামূলকভাবে সমতল এবং পার্শ্ব দেয়াল প্রায় ১২ ডিগ্রি হেলানো। মহীসোপানের কিনারায় খাদের গভীরতা প্রায় ১,২০০ মিটার। ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের নিচে কান্দা ও উপ-বদ্বীপ উপত্যকার আকারে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সাগর অভিমুখে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার সম্প্রসারিত হয়ে আছে। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের দিকে মুখ করে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের মোহনার কাছে বালুচর ও শৈলশিরার অবস্থিতি এই ইঙ্গিতই বহন করে যে, এই খাদ দিয়েই পলল বঙ্গোপসাগরের গভীরতর অংশে বাহিত হয়। বঙ্গীয় ডিপ সি ফ্যানের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড অবক্ষেপপূর্ণ ঘোলাটে স্রোত এনে বেঙ্গল ফ্যানে ফেলছে। বঙ্গীয় ডিপ সি ফ্যানের অধিকাংশ পলল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সঙ্গমস্থলে উদ্ভূত। এগুলো যথাক্রমে হিমালয়ের দক্ষিণ ও উত্তর দিক থেকে আসছে। বর্তমান অবস্থায় স্বল্প পরিমাণের ঘোলাটে স্রোত আরবালি সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের মাধ্যমে মহীসোপান থেকে গভীর সমুদ্রে পলল পরিবহণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর জাহাজ করতোয়া থেকে ফিরে ইসাবেলার গবেষক দলের প্রধান ড. আনিসুজ্জামান খান জানিয়েছিলেন বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে গঠিত.‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ বা SONG, যা বিশ্বের ১১টি গভীরতম ক্যানিয়নের মধ্যে অন্যতম, যা এক লাখ ২৫ হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি একটি সামুদ্রিক অভয়ারণ্য। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড নামকরণ করা হয়েছিল কারণ, যেখান থেকে এ অঞ্চলের শুরু সেখানেই হঠাৎ পানির গভীরতা বেড়ে গেছে। তাই ব্রিটিশদের ধারণা ছিল, সমুদ্রের এই খাদের কোনো তল নেই। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডকে স্থানীয়রা বলে ‘নাই বাম’। কারণ, তারা সাগরে ফুট কিংবা মিটারে হিসাব না করে বাম, দশ বাম, বিশ বাম, আর ওই জায়গা নাই বাম, মানে এই জায়গাটির কোনো হিসাব নেই, যা মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মতো। বাংলায় বলে অতলস্পর্শী।

বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে পরিচিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে মাছের পাশাপাশি আছে বিশাল আকারের তিমি, ডলফিন, হাঙর, কচ্ছপ আর বিরল প্রজাতির কিছু জলজপ্রাণী। প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ এলাকাটি বিরল জীববৈচিত্র্যের নিরাপদ প্রজননকেন্দ্র, যা প্রস্তাবিত ব্লু ইকোনমির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। 

সোয়াচ-অব-নো-গ্রাউন্ড বাংলাদেশ সরকার প্রথম মেরিন প্রটেক্টেড অঞ্চল (MPA) হিসেবে ঘোষণা করে। তিমি, ডলফিন, সবচেয়ে বড় ইরাবতী ডলফিন, ইন্দো-প্যাসিফিক ডলফিন ও পাখনাহীন ইমপ্লাইস ডলফিনসহ বহু সামুদ্রিক প্রাণী। সাগরতলের গভীর উপত্যকা বা মেরিন ভ্যালির পানির রং পরিবর্তিত হয়ে নীল আকার ধারণ করেছে।

গবেষক ড. আনিসুজ্জামান খান জানান, সীমিত পরিসরে জাহাজ চলাচল করায় ও ব্যাপকভাবে মাছও আহরণ না করার কারণে সোয়াচ এখনো বাংলাদেশের সাগরে অনাবিষ্কৃত ইকোসিস্টেম হিসেবে কাজ করছে। গত মার্চ মাসে অল্প সময়ের অনুসন্ধানে এমন কিছু প্রাণী দেখা মিলেছিলো যেগুলো বিশ্বে বিলুপ্তির তালিকায় রয়েছে। এটি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ইকোলজিক্যালি, জিওলজিক্যালি, হাইড্রোলজিক্যালি এবং আন্তর্জাতিক বায়োডাইভারসিটি হটস্পটও। 

সোয়াচকে ঘিরে ইসাবেলার ফাউন্ডেশনের গবেষকরা এবারের অভিযাত্রাকে নীল জলরাজ্যের হাতছানিতে বড় গবেষণার একটি সূচনা পর্ব বলছেন।

সাহস২৪.কম/রিয়াজ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত