হবিগঞ্জের সাতছড়িতে বিপন্ন প্রাণী উল্লুক

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০১৮, ১২:২১

বাসস

গাছের মগডাল থেকে হঠাৎ করে কালো বর্ণের একটি প্রাণী লাফ দিয়ে অনেক দূরের আরেকটি গাছে লাফ দিয়ে চলে গেল। কোন ধরনের সমস্যা হলো না। অদ্ভুত ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে প্রাণীটি।

সুন্দর এই দৃশ্যটি দেখতে গেলে চলে যেতে হবে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। আর এই অনিন্দ্য সুন্দর প্রাণীটির নাম উল্লুক। তবে দৃশ্যটি ক্রমশ দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হল এই বনে প্রাণীটি এখন মহাবিপন্নের মধ্যে পড়েছে। আর এই বিপন্নতার পিছনে দায়ী কোন প্রাণী নয়। মানুষের জন্যই আজ তাদের বসবাসের জায়গা বিনষ্ট হচ্ছে। দেখা দিয়েছে তাদের চরম খাদ্য সংকট।

হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং রেমা-কালেঙ্গা জাতীয় উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির বানরের বসবাস। এর মাঝে সবছেয়ে আকর্ষণীয় হল উল্লুক। এক সময় ওই দুই বনে গেলে উল্লুখের দেখা মিলত। সাধারণত উল্লুখ রাতের বেলা গাছের উচু ডালে ঘুমায়। দিনের বেলা খোলা জায়গায় তেমন একটা না আসলেও বনের ট্রেইল দিয়ে গভীরে গেলেই চোখে পড়ে দল বেধে ৩/৪টি উল্লুক একত্রে লাফালাফি করছে এক গাছ থেকে অন্য গাছে। সাতছড়িতে এক সময় অনকে উচু এবং পুরনো গাছ ছিল। এগুলোতেই তারা আবাস গড়ত। আর খাদ্য হিসেবে বনের ডুমুর, বটসহ বিভিন্ন ধরনের কাচা ফল গ্রহণ করত। এখন উঁচু গাছও কমে গেছে। পাকা ফলের গাছ নেই বললেই চলে। ফলে উল্লুকের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে গেছে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম জানান, দেশের বিভিন্ন বনে এক সময় হাজার হাজার উল্লুক ছিল। এখন রয়েছে মাত্র কয়েক শ’। হবিগঞ্জের সাতছড়ি এবং রেমা-কালেঙ্গায় এর আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মত। এখন এর দেখা মেলে কালে ভদ্রে।

উল্লুক ছোটখাটো, বৃক্ষবাসী নরবানর প্রজাতি। মাথাসহ এদের শরীর ৪৫-৬৩ সেমি লম্বা, ওজন ৬-৭ কেজি। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহের বনাঞ্চলে বাস করে। এরা লেজহীন; হাতগুলো পায়ের চেয়ে অনেক লম্বা। শরীর লোমে ঢাকা। কুঁচকিতে দাঁড়ির মতো লোমগুচ্ছ। বয়স্ক উল্লুক লিঙ্গভেদে দু’রঙের হয়। পুরুষ ঘন কালো, স্ত্রী হলুদ/সোনালি বা ধূসর-বাদামি রঙের। এরা ফলভুক, পাকা ফলই এদের পছন্দ। মধ্য-সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে তিন বছর পর পর বাচ্চা প্রসব করে। গর্ভধারণকাল ৩-৪ মাস।

এরা দিবাচর, রাতে উঁচু ডালে ঘুমায়। ভোরের আগে ওঠে এবং সন্ধ্যার অনেক আগেই দিনের কাজ শেষ করে। এরা খোলা জায়গায় তেমন আসে না। দু থেকে পাঁচটি উল্লুক একত্রে থাকে। সাধারণত থে-উ, হু-উ, হো-কো-উ ইত্যাদি স্বরের একটানা ও যৌগিক স্বরে ডাকে আর এজন্যই এদের নাম উল্লুক।

হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. সুভাস দেব জানান. সারাবিশ্বেই উল্লুক একটি বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে এ প্রাণীটি এখন অতি বিপন্নের তালিকায়। খাদ্য ও আশ্রয় সংকটে এই বিপ্নন অবস্থা। এক সময় হবিগঞ্জের বনাঞ্জলে এদের উপস্থিতি ছিলে চোখে পড়ার মত। এখন এর পরিমাণ এমনভাবে কমছে যে কালেভদ্রে এদের দেখা মিলে। রেমা-কালেঙ্গা ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের যদি ডুমুরসহ বিভিন্ন ফলের গাছ লাগানো হয় এবং উঁচু গাছ বিনষ্ট না করা হয় তা হলে আমরা মহাবিপন্ন এই প্রাণিটি রক্ষা করতে পারব।

আই ইউ সি এন এর বন্যা প্রাণী বিশারদ তারিক কবির জানান, রেমা-কালেঙ্গাতে একটি মাত্র উল্লুকের দল অবশিষ্ট আছে। এই দলে একটি অথবা সর্বোচ্চ তিনটি উল্লুক থাকতে পারে। তবে সাতছড়িতে একখনও বেশ কয়েকটি দল উল্লুক রয়েছে।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উল্লুকের উপর পিএইচডি করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান জানান, রেমা-কালেঙ্গা বনে যে কোন সময় উল্লুক শুন্য হয়ে পড়বে। সাতছড়িতে এখনও কিছু আছে। ব্যাপকভাবে বন ধ্বংসের জন্য এই প্রাণী আজ মহাবিপন্ন। উল্লুক সাধারণত মাটিতে নামে না। বনে খাদ্য ঘাটতি এবং এক গাছ থেকে অন্য গাছের দুরত্ব কমে যাওয়ায় এই প্রাণী যখন নিচে নেমে যায় তখন অনেক আধীবাসী এটিকে শিকার করে ভক্ষণ করে। ফলে প্রাণিটি আজ বিপন্ন।

তিনি আরও জানান, সারাদেশে আড়াইশর মত উল্লুক আছে। এর উপকারীতা সাদাচোখে দেখা যায় না। ডুমুর জাতীয় ফল খাওয়ার পর এরা যখন মল ত্যাগ করে তখন এর চারা গজায়। এমনিতে বীজ লাগিয়ে ওই জাতীয় গাছের চাড়া গজানো সম্ভব নয়। বনে পর্যটকরাও এই প্রাণীটি দেখে আনন্দ পায়।

তিনি বলেন, যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। আর যেন বন ধ্বংস করা না হয় সেদিকে আমাদের সবাইকে নজর দিতে হবে।
সাহস২৪.কম/মশিউর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত