এক অনবদ্য সভ্যতার রূপকথা সোমপুর বিহার

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:৫৭

সাহস ডেস্ক

সোমপুরবিহার এক অনবদ্য সভ্যতার রূপকথা। খুঁজে পাওয়া শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে পুরোনাম শ্রী সোমপুর-শ্রী- ধার্মপালদেব-মহাবিহার-ভিক্ষু সঙ্ঘ। এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম বৌদ্ধবিহার। বাংলাদেশে অবস্থিত তিনটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে এই বিহারটি অন্যতম। বাকি দুটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হলো বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।

এক নজরে পাহাড়পুরের ইতিহাস

সোমপুর বিহারের অবস্থান বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত নওগাঁ জেলার, বদলগাছি উপজেলার, পাহাড়পুর ইউনিয়নে। তাই অনেকের কাছেই পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নামে বেশি পরিচিত সোমপুর বিহার। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী প্রাচীন বঙ্গ জনপদে সুদীর্ঘ চার শতক রাজত্ব করেছিল পাল বংশ। মূলত বাংলা ও বিহার কেন্দ্রিক পাল রাজ্য, সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তর পশ্চিমে পাকিস্তানের খায়বার-পাখতুনখওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পাল বংশের রাজারা ছিলেন নিষ্টাবান বৌদ্ধ। ধারণা করা হয় পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপালের সময়ই নির্মিত হয়েছিল সোমপুর বৌদ্ধবিহার। তবে অনেকে এও ধারণা করেন ধর্মপাল নন তার পুত্র রাজা দেবপাল ছিলেন এই বিহারের নির্মাতা কারণ, বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ “পাগ সাম জোন ঝাং” এর লেখক অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০) কর্তৃক সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দিরের উল্লেখ করেছেন। তবে যার সময়ই নির্মাণ হোক না কেন সোমপুর বিহার স্থাপত্য শিল্পে অনন্য এবং আকারে সুবৃহৎ।

মাটির ঢিবির নিচে দীর্ঘকাল চাপা পড়ে থাকা এই প্রকান্ড স্থাপনা দূর থেকে দেখলে পাহাড়ের মতই মনে হতো। পাহাড়পুর ইউনিয়নের নামকরণ কিন্তু সেই থেকেই। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও সুদূর চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে বৌদ্ধরা আসতেন এখানে। খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। মহাপন্ডিত অতীশের জ্ঞানের সুখ্যাতি বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল সুদূর তিব্বতে। প্রচলিত আছে তিব্বতে গিয়ে তিনি সেখানকার পানির সমস্যা সমাধান করে এসেছিলেন। এই মহান পণ্ডিতের বাড়ি ছিল ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে।

এক সময়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম সাধকদের জ্ঞানতীর্থ, এই বিহার মাটির নিচে চাপা পড়েছিল সুদীর্ঘকাল। মোটামুটি ছয়’শ বছর স্মৃতির অতলে হারিয়ে থাকার পর পুনরায় এর হদিস মেলে ইংরেজ আমলে ভূমি জরিপের সময় ১৮০৭-১৮১২ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে । তারপর স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিমহাম ১৮৭৯ দিকে এবং ব্রিটিশ ভারতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯২০ এর দশকে আংশিক খনন কাজ চালায়। অবশেষ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮০ র দশকে এর খনন কাজ পুরোদমে শুরু হয় এবং ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করে।

জেনে নিই পাহাড়পুরের স্থাপত্য শিল্পের হিসাব নিকাশ

প্রায় ২৭ একর জায়গা জুড়ে বিহারটি বিস্তৃত। এতে রয়েছে ১৭৭ টি কক্ষ। মাঝখানে প্রকাণ্ড মন্দিরটিকেই মূলত দূর থেকে পাহাড়ের মত দেখায়। এ মন্দিরের বেইসমেন্ট ক্রুশাকার। প্রতিটি ক্রুশবাহুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১০৮.৩ মি ও ৯৫.৪৫মি। মধ্যবর্তী স্থানে আরও কয়েকটি অতিরিক্ত দেয়াল কৌণিকভাবে যুক্ত এবং কেন্দ্রে দরজা-জানালা বিহীন একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ আছে। এই প্রকোষ্ঠটি মন্দিরের তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলতঃ এ শূন্যগর্ভ প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করেই সুবিশাল এ মন্দিরের কাঠামো নির্মিত। মন্দিরের বর্তমান উচ্চতা ২১ মিটারের মত। তবে ধারণা করা হয় একসময় হয়ত ৩০ মিটারের বেশি ছিল এই মন্দিরের উচ্চতা। অবশ্য নওগাঁ এলাকার স্থানীয়দের মতে দিন দিন ডেবে যাচ্ছে মূল মন্দিরটা, আশির দশকে খনন কাজ শুরু সময়কার উচ্চতা নাকি এখনকার চেয়েও বেশি ছিল। মূল মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটার কাজ দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রকমের মূর্তির আদলে টেরাকোটাগুলো তৈরি করা হয়েছে।

মন্দিরটিকে ঘিরে চারিদিকে ছিল কক্ষগুলো। ধারণা করা হতো দূর দূরান্ত থেকে আগত তান্ত্রিক সাধক ও শিক্ষার্থী ভিক্ষুরা অবস্থান করতেন এই ঘরগুলোতে। কক্ষগুলোর দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৪.২৬ মিটার এবং প্রস্থ ৪.১১ মিটার। মূল মন্দিরকে বর্গ ক্ষেত্রের মতো বেষ্টন করে আছে কক্ষগুলো। উত্তরদিকে এক সারিতে ৪৫টি এবং বাকি তিনদিকে রয়েছে ৪৪টি করে। শুধু সোমনাথবিহার নয় পাল আমলে বাংলা ও বিহারে অনেকগুলো বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল। তিব্বতীয় বর্ণনা অনুসারে সে আমলে পাঁচটি বড় বড় বিহার যাদের মধ্যে সোমপুর একটি বাকি চারটি হল বিক্রমশীলা, নালন্দা, ওদান্তপুত্র এবং রাজশাহীর জগদ্দলবিহার। এই বিহারগুলোর পরস্পরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং অনেকটা এখানাকার দিনের মতো আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কো-লেবোরেশনের মতো।

বিহারটি আকস্মিক ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় বাংলায় ক্ষীয়মাণ বৌদ্ধ শাসন, হিন্দুপ্রধান সেনবংশের উত্থান এবং সর্বোপরি তাদের হারিয়ে বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পর নব্য রাজনৈতিক পটভুমিকায় আস্তে আস্তে বিহারটি লোকশুন্য হতে হতে একসময় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। সেটা প্রায় আজ থেকে আটশ বছর আগের কথা।

প্রায় ১২ শ` বছর আগের তৈরি করা সোমনাথ বিহারের এই ধ্বংসাবশেষ আপনাকে ক্ষণিকের জন্য নিয়ে যাবে সুদূর অতীত। শেষ বিকেলে প্রতিটি ইটের লালাভ উজ্জ্বলতা হয়ত আপনাকে মনে করিয়ে দিতে থাকবে মাটি চাপা পড়া এক সভ্যতার কথা। হয়ত মূল মন্দিরের গা ঘেঁষে উঠতে উঠতে আপনি কল্পনা করতে থাকবেন এককালের কর্মচঞ্চল এই প্রাঙ্গণের প্রতিচ্ছবি। আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে মহাকালের কাছে নশ্বর মানুষ কত ক্ষুদ্র!

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত