যেভাবে দেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু (ভিডিও)

প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪৪ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪৬

অনলাইন ডেস্ক

১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। তিনি পাকিস্তান থেকে প্রথমে লন্ডন যান এবং তারপর দিল্লী হয়ে ঢাকায় ফেরেন। 

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় এক লেখায় বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার ঘটনা তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।  

বাণিজ্যমন্ত্রী লিখেছেন, এখনো আমার স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতপ্রার্থী হাবীব আলীর কথা। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং একই তারিখে ইরান ও তুরস্কের সরকারদ্বয়ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পরদিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যাত্রা করেছিলাম লাহোরের উদ্দেশে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিতে এসেছিলেন কুয়েতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এসেছিলেন লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ওআইসির ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল, তিউনিসিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল আজিজ বুতাফ্লিকা। এই পাঁচজন এসেছিলেন আলজেরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুয়ারে বুমেদীনের বিশেষ বিমান নিয়ে। লাহোর বিমানবন্দরে আমাদের অভ্যর্থনা জানান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চৌধুরী ফজলে এলাহী এবং প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেখানে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রেজেন্টেশন লাইনে যারা দণ্ডায়মান ছিলেন বঙ্গবন্ধু তাদের সকলের সাথে করমর্দন করলেও টিক্কা খানের সাথে করমর্দন করেননি। কারণ টিক্কা খানের হাত শহীদের রক্তে রঞ্জিত ছিল।

তিনি আরও লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে যাওয়ার সময় লাহোরে রাস্তার দু’পার্শ্বে লাখ লাখ লোক দাঁড়িয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে শ্লোগান তুলেছিল: ‘জীয়ে মুজিব, জীয়ে মুজিব’ অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ, মুজিব জিন্দাবাদ। বঙ্গবন্ধু যখন অতিথিশালায় পৌঁছালেন তখন সেখানে স্যুট-টাই পরিহিত ছোটখাটো একজন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করেন। বঙ্গবন্ধুও পরমাদরে তাঁকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন, ‘হাবীব আলী, ইউ আর হেয়ার।’  জানতে পারলাম, এই লোকটির নাম হাবীব আলী। বঙ্গবন্ধু যখন মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দী তখন তিনি ছিলেন সেই কারাগারের প্রিজন গভর্নর। বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপের পরে তিনি আমাদের কক্ষে আসেন এবং আন্তরিকতার সাথে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু মিয়ানওয়ালী কারাগারে কীভাবে জীবনযাপন করেছেন, কীভাবে তিনি মুক্তিলাভ করেছেন সবিস্তারে তার বর্ণনা দেন। গভীর শ্রদ্ধায় স্মৃতি তর্পণ করে একটানা বলে যান, মিয়ানওয়ালী কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর  নয় মাস চৌদ্দদিনের কঠিন কারাজীবনের কথা।

বঙ্গবন্ধুর জবানিতে তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আগের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি আমাদের বলেছিলেন—

‘বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর রাতে মুজিবকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশের পরপরই একটা ট্রাক নিয়ে মিয়ানওয়ালী কারাগারের দিকে যাই। কারা ফটক খুলে তার সেলের কাছে গিয়ে দেখি তিনি একটা কম্বল জড়িয়ে বিছানার উপর ঢুলছেন। এমন সময় সেখানে যারা কয়েদী ছিল তারা শেখ মুজিবকে ফিসফিস করে বলছিল যে, ‘ওরা এসেছে।’ মুজিবও ফিসফিসিয়ে বললেন যে, ‘শেষ পর্যন্ত আমি মাথা নত করবো না।’ তার আগে মিয়ানওয়ালী কারাগারেই সেলের সামনে একটা কবর খনন করা হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কী?’ তখন তাঁকে বলা হয়েছিল যে, ‘যুদ্ধ চলছে এটা বাংকার। শেল্টার নেবার জন্য।’ আসলে ছিল কবর। তখন মুজিবকে একজন কয়েদী বলছিল যে, ‘আসলে এটা কবর। আপনি যদি আজ বের হন আপনাকে মেরে এখানে কবর দেওয়া হবে।’ তখন মুজিব আমাকে বলেছিল, ‘কবরকে আমি ভয় পাই না। আমি তো জানি ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু আমি জানি আমার বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে এবং আমি এও জানি, যে বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে, সেই বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’

আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আরো লিখেছেন, সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করে এই কবরে না, এই লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি— সেই বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’

কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করতে আসার স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি আরো লিখেছেন, যাহোক, ঐদিন ২৬ তারিখে আমি ট্রাকে করে মুজিবকে নেয়ার জন্য মিয়ানওয়ালী কারাগারে আসি। কারণ ইতোমধ্যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে প্রার্থনা করেছিল যে, ‘আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দাও। আমার জীবনে যদি কোনো ভুল করে থাকি তাহলে শেখ মুজিবকে ফাঁসি কাষ্ঠে না ঝুলানো।’ তখন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার নিকট এই মর্মে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন যে, ‘শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে দ্রুত নিরাপদ কোনো স্থানে সরিয়ে ফেলা হোক।’ তখন আমি মুজিবকে মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে ট্রাক নিয়ে কারা ফটকে আসি এবং সেলের মধ্যে গিয়ে শেখ মুজিবকে আমার সাথে যেতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি আমাকে বাধা দেন। তখন আমি তাঁকে বলি, ‘শেখ, আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি আপনাকে এখান থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে এসেছি। কারণ, এখানে কমান্ডো আসতে পারে। তারা আপনাকে হত্যা করবে। আমার উপর আপনি আস্থা রাখুন।’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ফিরে আসার স্মৃতি উল্লেখ করে তোফায়েল লিখেছেন,  তারপর মুজিবকে ট্রাকে তুলে, ট্রাকের মধ্যে লুকিয়ে, আমার চশমা ব্যারাজ নামক বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়েই তিনি একটা টেলিফোন করতে চান। মুজিব আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি কী আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারি।’ তখন আমি তাকে বলেছিলাম, ‘না, আমার একমাত্র কাজ হলো আপনার জীবন রক্ষা করা। আপনি টেলিফোন করতে পারবেন না।’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি কী খবরের কাগজ পড়তে পারি।’ আমার উত্তর ছিল, ‘না।’ এরপর বললেন, ‘আমি কী এক কাপ চা পেতে পারি।’ তখন তাঁকে এক কাপ চা দেয়া হয়। আমার বাড়িতে তিনি দু’দিন থাকেন। 

দিন দুই পরে শেখ মুজিবকে নিয়ে যাই শাহুল্যা নামক স্থানে। যেটা একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেস্ট হাউস ছিল। পিন্ডির থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এই শাহুল্যাতে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মুজিবের সাথে সাক্ষাত্ করতে আসেন। ভুট্টো যখন আসেন তখন একজন কর্নেল এসে মুজিবকে বলছিল, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসবে।’ 

তারপরে সেখানে ভুট্টো এলেন এবং মুজিবকে সালাম দিয়ে বললেন যে, ‘নাউ আই অ্যাম দি প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান অ্যান্ড চীফ মার্শাল ’ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।’ তারপরই শেখ মুজিবের প্রশ্ন ছিল যে, ‘ভুট্টো, টেল মি ফার্স্ট, হোয়েদার আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান অর প্রিজনার।’ তখন ভুট্টো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নাইদার ইউ আর এ প্রিজনার, নর ইউ আর এ ফ্রিম্যান।’ তখন শেখ মুজিব বললেন, ‘ইন দ্যাট কেইস আই উইল নট টক টু ইউ।’ তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো বলতে বাধ্য হলেন যে, ‘ইউ আর এ ফ্রিম্যান।’

বঙ্গবন্ধু আর ভুট্টোর সাক্ষাত সর্ম্পকে তিনি লিখেছেন, এরপর শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। তারপরে সে অনেক রকমের প্রস্তাব দিলেন। কীভাবে একটা কনফেডারেশন করা যায়, কীভাবে একসাথে থাকা যায়, ইত্যাদি। কিন্তু শেখ মুজিব কোনো কথাই বললেন না। চুপ করে থেকে শুধু বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে না পারবো, ততক্ষণ আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভবপর নয়।’ এরপর শেখ মুজিবকে একটা যৌথ ইশতেহার দেওয়া হয়েছিল স্বাক্ষর করার জন্য। মুজিব সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন। পরিশেষে শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি কী এখন দেশে যেতে পারি?’ ভুট্টো বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে পারেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ ভারতের উপর দিয়ে যায় না।’ তখন মুজিব বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাবো।’ এরপর ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।”

তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ এবং ভুট্টোর সাথে কথোপকথনের স্মৃতিচারণ শেষে হাবীব আলী আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা বাঙালিরা গর্বিত ও মহাসৌভাগ্যবান যে, শেখ মুজিবের মতো একজন নেতা তোমরা পেয়েছো।’

এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, সেদিন হাবীব আলীর স্মৃতিকথা ও মন্তব্য শুনে বিস্মিত হইনি, কিন্তু গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। আমরা তো জানতাম আমাদের নেতার ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় সঙ্কল্পবোধের কথা।