মুক্তিকামী সকল মা আজ থেকে বিপুলেরও মা

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:০৭

(১) 
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ একটা অতি ক্ষুদ্র ছাত্র সংগঠন। ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রদল বা ছাত্র শিবিরের অনেক জেলা বা আঞ্চলিক ইউনিট খুঁজে পাবেন যাদের সদস্য সংখ্যা বা কমিটির আকৃতি গোটা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চেয়ে বড়। নাম দেখেই বুঝতে পারছেন, ওদের কর্মকাণ্ড পাহাড়ি ছাত্রদের মধ্যেই সীমিত। পাহাড়ি ছাত্রদের মধ্যেও সকলে যে এই সংগঠনের সদস্য বা সমর্থক তাও আবার না। পাহাড়ি ছাত্র ছাত্রীদের বেশিরভাগই এদের সদস্য না। পাহাড়ি ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যেও আবার অনেকে আছে যারা এই সংগঠনের রীতিমত বিরোধিতা করে।

রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি আর বান্দরবানের বাইরে ঢাকায় আর চট্টগ্রামে ওদের কিছু সদস্য আছে যারা মাঝে মাঝে এইটা দুইটা মিটিং করে বা মানববন্ধন করে। এইসব কর্মসূচির ধরণও আপনারা জানেন। দশজন কি বিশজন পাহাড়ি ছেলেমেয়ে কাঁচা হাটে লেখা লাল নীল সবুজ হলুদ কয়েকটা পোস্টার হাটে নিয়ে শাহবাগে বা শহীদ মিনারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যাস। খুব বড় প্রোগ্রাম হলে হয়তো একটা ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যানার যুক্ত হয়।

হ্যাঁ, ওদের শক্তি বা তাৎপর্য বা গুরুত্ব সদস্য সংখ্যার মধ্যে না। ওদের গুরুত্ব হচ্ছে ওদের আদর্শে ওদের লক্ষ্যে আর ওদের দাবী দাওয়াতে। পাহাড়ের আদিবাসী জনগণের মুক্তির জন্যে ওরা একটা পথকে সঠিক মনে করে। সেই পথকে আমার সঠিক পথ মনে নাও হতে পারে, কিন্তু আমি জানি যে এই সংগঠনটি সৎভাবে বিশ্বাস করে যে সেই পথেই ওদের মুক্তি আর সৎভাবে ওরা সেই লক্ষ্যেই আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

(২) 
এই সংগঠনটির একজন নেতা, সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক, বিপুল চাকমা- ওর সাথে পুলিশ যে আচরণটি করেছে এটার আপনি কি ব্যাখ্যা দিবেন। ছাত্র নেতাদেরকে পুলিশ মাঝে মাঝেই গ্রেপ্তার করে। ছাত্র রাজনীতি যারা করেন ওরা মোটামুটি সকলেই এইরকম গ্রেপ্তার নিপীড়নের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। বিপুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, কেন করেছে, কি অভিযোগে করেছে সেটা পুলিশই জানে। ধরে নিলাম গ্রেপ্তারটা বেআইনি ছিল না।

কিন্তু একটা ছেলে ওর মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে। ক্যান্সার আক্রান্ত মৃতপ্রায় মা। যাওয়ার পথেও নাকি রক্তবমি করছিল। একটা অ্যাম্বুলেন্সে নাকি মাইক্রোবাসে করে ছেলে তাকে নিয়ে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামে। পথে পানছড়িতে পুলিশ গাড়ী থামিয়েছে। বিপুল চাকমাকে গ্রেপ্তার করবে। গ্রেপ্তার করবে তো ঠিক আছে গ্রেপ্তার করবে। ওকে অশ্রাব্য অশোভন ভাষায় গালাগালি করার কি দরকার ছিল। মৃতপ্রায় মায়ের সামনে পুলিশ ওকে ভয়ংকর গালাগালি শুরু করে।

বিপুল বুদ্ধিমান দায়িত্বশীল ছেলে। পুলিশের ওসির নাম জব্বার। জব্বারকে সে অনুরোধ করেছে, ‘এখানে আমার মা আছেন, তিনি অসুস্থ্য, অসুস্থ্য মায়ের সামনে আমাকে এইসব গালাগালি করবেন না। আমাকে অপমান করবেন না।’ ‘গাড়ীতে আছেন আমার বৃদ্ধ পিতা, তার সামনে আমাকে এইভাবে গালাগালি করবেন না। আমাকে অপমান করবেন না।’ এটা কি নিতান্ত অন্যায় অনুরোধ ছিল?

সে তো একথা বলেনি যে আমাকে গ্রেপ্তার করবেন না। সে তো পুলিশকে অন্যায় কোন অনুরোধ করেনি। ন্যায্য একটা অনুরোধ করেছে। টাউট প্রকৃতির কোন ছেলে হলে হয়তো পুলিশকে ঘুষ দিতে চেষ্টা করতো। পরিচত লোকজনকে দিয়ে তদবির করতে চাইতো। এই ছেলে তো সেইসব কিছু করেনি- শুধু বলেছে আমাকে বাবা মার সামনে এইভাবে অপমান করবেন না। আমার অসুস্থ্য মা।

পুলিশ ওর মৃতপ্রায় মায়ের সামনে ওকে ভয়ংকর সব গালাগালি করে টেনে হিঁচড়ে ওকে নিয়ে গেছে। অনেক মারধোরও করেছে ওকে।

(৩) 
আপনাদের অনেকেরই ছেলেমেয়ে আছে। আমার দুই মেয়েই বড় হয়েছে। আপনি কি ভাবতে পারেন আপনার চোখের সামনে আপনার ছেলে বা মেয়েকে যদি পুলিশ গালাগালি করে আপনার কীরকম লাগবে? আপনার চোখের সামনে যদি পুলিশ আপনার জোয়ান সন্তানকে মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় আপনার কেমন লাগবে? কেন এরেস্ট করেছে বিপুলকে? এমনিই। পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেছে- কেন গ্রেপ্তার করছেন? কী মামলা? কোন ধারা? পুলিশ কোন জবাব দেয়নি। আমাকে একজন জানালেন ওর বিরুদ্ধে সেসময় সুনির্দিষ্ট কোন মামলাও ছিল না।

এমনিই ধরে নিয়ে গেছে। পাহাড়ে তো এরকমই হয়। ইচ্ছা হলেই পুলিশ যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে নিয়ে যাবে। মারধোর করবে। যতদিন খুশী আটকে রাখবে। আইন কানুনের কোন বালাই নাই। পুলিশ বিজিবি আর্মি যার ইচ্ছা সে যে কোন পাহাড়িকে যে কোন সময় গ্রেপ্তার করতে পারবে। কোন প্রশ্ন করে কোন লাভ নাই।

বিপুলের মা চট্টগ্রামে হাসপাতালে গিয়ে আর বাঁচেননি। চোখের সামনে পুত্রকে এইরকম লাঞ্ছনা করলে মায়ের বুকে যে আঘাত লাগে সেকি এই মায়ের মৃত্যুকে তরান্বিত করেনি? একটু হলেও নিশ্চয়ই করেছে। এই অন্যায়ের প্রতিকার কী?

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের এই ছেলেমেয়েরা তো এইসব মাথায় নিয়েই সেখানে রাজনীতি করে। ওদেরকে পুলিশে মারে, আওয়ামী লীগ মারে, ছাত্রলীগ মারে, সেটেলাররা মারে, আর্মি মারে- যার যখন ইচ্ছা। এঁর মধ্যেই ওরা নিজ জাতীর মুক্তির কথা বলে।

(৪)
ওরা মায়ের শেষকৃত্যের জন্যে বিপুলকে প্যারোলে মুক্তি দিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে। মোবাইল ফোনে ভিডিও করে সেটা কারা কারা যেন ছড়িয়ে দিয়েছে অন্তর্জালে। মাকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়ার আগে ছেলেটা দাঁড়িয়েছে সমাজের উদ্দেশ্যে কিছু বলবে বলে। পুত্রকে বলতে হয়, এটাই নিয়ম।

দাঁড়িয়ে মাইক হাতে বিপুল সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন ওর মাকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছে বলে। ছেলেটার পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লোহার শিকল দিয়ে কোমরে বাধা। কেন ভাই? এই ছেলে কি চোর? নাকি ডাকাত? ওর পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি কেন? ওর কোমরে শিকল কেন? ওর গায়ে আবার পড়িয়ে দিয়েছে পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।
এক বৃদ্ধা- সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, কুঁজো হয়ে গেছে- এইরকম এক বৃদ্ধা বিপুলকে কোমরে আঁকড়ে ধরে কাঁদছেন অঝোর ধারায়। আর বিপুল উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশ্যে চাকম ভাষায় আর বাংলায় মিলিয়ে বলছে, ‘আমার মা মরেছে আমার দুঃখ নাই, জন্মালে তো মানুষকে মরতেই হয়। আমার দুঃখ মায়ের মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারলাম না, আমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তাতে আমার দুঃখ নেই, জাতীর মুক্তির জন্যে রাজনীতি করি, তার জন্যে জেলে যাওয়া শুধু নয়, যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারি। দুঃখ শুধু মৃত্যুকালে মা আমাকে শেষবার দেখতে পারলেন না।’

বিপুলের গলা কি একটু ধরে আসে? ভিডিওটা আমি মনোযোগ দিয়ে দেখি। বিপুলের চোখে কি এক দুই ফোঁটা জল? আহারে, ছেলেটার মা মারা গেল, আর ছেলেটাকে এনে ওরা হাজির করেছে পায়ে আর কোমরে শিকল বেধে। কেন ভাই? এইটুকু নিষ্ঠুরতা না করলে আমার এই মহান প্রজাতন্ত্রের কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?

দৃঢ় কণ্ঠে বিপুল সকলকে জানিয়ে দেয়, পাহাড়ি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সে আছে, থাকবে। আর মানুষের পাশে থাকলে পাহাড়ের সকল মাই বিপুলের মা। মুক্তিকামী সকল মা আজ থেকে বিপুলেরও মা।

(৫) 
একটা কথা আপনাদেরকে বলি। এই যে পুলিশ বিপুল চাকমার সাথে এইরকম অন্যায়টা করলো তাতে যতটা না দুঃখ পেয়েছি বিপুলকে দেখে তার চেয়ে বেশী আনন্দ পেয়েছি। না, দুঃখ তো পেয়েছিই, ওর ভিডিওটা দেখে চোখ আমারও আর্দ্র হয়েছে। সেই সাথে আনন্দও পেয়েছি।

আনন্দ পেয়েছি কেন জানেন? আনন্দ পেয়েছি এটা দেখে যে আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই এইরকম দৃঢ়চেতা যুবক আছে। এইরকম সংগ্রামী সাহসী আর দৃঢ়চেতা ছেলেমেয়েদের যখনই দেখা পাই- আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের দেখেন- আমার খুব আনন্দ হয় এই ভাবে যে আগামী প্রজন্মকে লড়াইয়ে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষ আছে। বিপুলকে দেখেও ভাল লেগেছে- না, পাহাড়ের তরুণদের মধ্যেও প্রকৃত যৌবন এখনো আছে। আগুন নিভে যায়নি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত