চাইল্ড এবিউজ ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:২৮
১০/১২দিন আগের কথা, পরিচিত এক ভাবীকে বলতে শুনলাম উনি তার বাচ্চাকে আরেক বাচ্চার সাথে মিশতে বারণ করেছেন। আমি জানতে চাইলাম, কারণ কি ভাবী? উনি উত্তর দিলেন আরে বলবেন না, ঐ বাচ্চা ইচড়ে পাকা, এই বয়সেই অসভ্য সব কথা বলে। আমি একটু অবাক হয়ে আবারো প্রশ্ন করলাম, কেমন ধরনের অসভ্য কথা বলে? উনি উনার মাথাটা আমার কানের কাছে নিয়ে এসে বললেন, ওর এক আংকেল নাকি ওর বুকে হাত দেয়। চমকে উঠলাম। বাচ্চাটি অসভ্য? এই দোষ আসলে কার?
চাইল্ড এবিউজ নিয়ে ইদানীং খুব কথা হচ্ছে, লেখালিখি হচ্ছে সেখানে এই ভাবী এমন আচরণ করছেন। কেন করছেন, সেটা জানেন? কারণ ঘটনাটা তার মেয়ের সাথে হয়নি। আমরা সবাই সব সময় নিজের সাথে কোন ঘটনা সম্পৃক্ত না হলে এমন চুপ থাকতেই ভালোবাসি। ভাবি অযথা এইসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কি লাভ! এইটা ভাবি না যে, ঐ বাচ্চাটি যদি আমার বাচ্চা হতো! অথবা আমার বাচ্চাটির সাথেও যদি এমন হয়! আসলে আমরা সবাই স্বার্থান্ধ। ভাবীকে বললাম, বাচ্চাটার মা'র সাথে কথা বলেছেন? উনি বললেন, দরকার কি! ওদের ঝামেলা ওরাই মেটাক। বাচ্চাটির মায়ের সাথে আমি পরিচিত নই, তবুও আমিই যেচে গেলাম উনার সাথে কথা বলতে। একে তো আমি পরিচিত নই, দ্বিতীয়ত বিষয়টা এমন যে হুট করে কিভাবে বলবো তাও ভেবে পাচ্ছিলাম না। যাই হোক, এই কথা সেই কথার পর বললাম, আপনার মেয়েটি আপনার সাথে সব কথা শেয়ার করে? উনি বললেন, ওর আর কি কথা? ওকে যা বলি শোনে। বেশি শাসন করতে হয় না। লক্ষী বাচ্চা। আমি আরো গভীর পানিতে পড়লাম যেন। কিন্তু আমাকে তো জানাতেই হবে ব্যাপারটা। আবার এই সেই বলে বললাম, বাচ্চা কি তার আংকেলের খুব ভক্ত? উনি একটু অবাক হয়ে বললেন, হ্যা, আগে খুব ভক্ত ছিলো। এখন আর ধারে কাছে যায় না। কি হয়েছে তাদের চাচা ভাস্তির, আল্লাহই জানে! এবার আমি বলেই ফেললাম কথাটা। শোনার পর উনার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করলো। আমার দুহাত আঁকড়ে ধরে বললেন, আমি এই ঘটনা জানি। বাচ্চার বাপকেও বলছি। উনি বলছেন, আমি দেওরকে এই বাসায় রাখতে চাই না তাই বাহানা করতেছি। এরপরে যদি আর কিছু বলি, তাইলে আমাকে বাপেরবাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। আপনিও কাউকে কিছু বইলেন না। এরপরেই উনার খেয়াল হলো আমি বোধয় এটা সম্পর্কেই বলতে এসেছি। আমি সরাসরি হ্যা বললাম। উনাকে জানালাম, বাচ্চা তার বান্ধবীর সাথে ঘটনা শেয়ার করেছে। উনি আমার হাতেপায়ে পড়তে বাকী রাখলেন, কাউকে কিছু না বলার জন্য। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। উঠে চলে আসলাম। মনে পড়ে গেলো আমার পরিচিত দুইবোনের কথা। ছোটমেয়েটি আমাকে বলেছিলো তাদের ঘটনা। ঐ মেয়ে দুটিও তাদের চাচার দ্বারা এবিউজড হতো। মেয়ে দুটোর মাবাবা দুজনেই জানতেন ব্যাপারটা। তবুও সেই মাও প্রতিবাদ করতে পারেনি সেভাবে। আর তাদের বাবাও কোনদিন কিছু বলেননি। বাবা একদিন উনার ভাইকে ডেকে হালকা একটু ধমকে দিয়েছিলেন। দিনের পর দিন এভাবেই নির্যাতিত হওয়ার এক পর্যায়ে ছোট মেয়েটি একদিন বলেছিলো, হয় ঐ কুত্তা এই বাড়িতে থাকবে, নয়তো আমি। কোন লাভ হয়নি। বড় বোনটা ছিলো চুপচাপ স্বভাবের। সেও তেমন প্রতিবাদ করতে পারেনি। চক্ষুলজ্জা, লোকলজ্জা সর্বোপরি বাবার উপর ক্ষোভ, অভিমান তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিয়েছিলো। এরপরে কেটে গেছে বহুদিন, এখন বড়মেয়েটির বাসায় চাচা বেড়াতে গেলে সে হাসিমুখে চাচা চাচির সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে আপ্লোড করে। ছোটমেয়েটি তার বাসায় চাচা চাচীরা বেড়াতে আসলে চাচাতো ভাইবোনের পছন্দমত খাবার রান্না করে খাওয়ায়। মেয়ে দুটোর বাবা আগেও উনার ভাইয়ের প্রতি স্নেহান্ধ ছিলেন, এখনো আছেন। এটা আমার খুব কাছে থেকে জানা গল্প। চাইল্ড এবিউজিং এর পারিবারিক গল্প গুলো শতভাগই এরকম। এবিউজড বাচ্চারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের থেকেই এই যৌন নির্যাতন ভোগ করে থাকে। এবিউজিং শুধুমাত্র মেয়ে সন্তানের সাথে নয় ছেলে সন্তানের সাথেও হয়ে থাকে। এই সব ক্ষেত্রে পারিবারিক সম্মান, সামাজিক ভাবে অপদস্থ হওয়ার ভয়, অন্ধ স্নেহ, বাচ্চাকে বাচ্চা ভেবেই আন্ডারস্টেমেট করা এইসব কারণেই অভিভাবকেরা মুখ বন্ধ করে রাখেন। কেউ ভাবে না, এই কারণে বাচ্চাটির মনের জগতে যুদ্ধের খবর। কেউ ভাবে না শুধুমাত্র এ কারনেই ভবিষ্যতে বাচ্চাটির দাম্পত্য জীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারে। তার নিজের ভিতরের অসহায়ত্ব বোধ আর অন্যকে বিশ্বাস করতে না পারাটা তারজন্য কতোটা ক্ষতিকারক হতে পারে সেই সম্পর্কেও কেউ ধারনা রাখে না।
এটুকুই বলতে চাই
নিজের সন্তানের জন্য যদি সুস্থ্য স্বাভাবিক পরিবেশ চান তাহলে, চাইল্ড এবিউজিং ঠেকাতে হলে সোচ্চার হতে হবে আপনাকেই। আপনি আমি মিলেই তো আমরা। স্বামী স্ত্রী দুজনেই দুজনের সম্পর্কের উপর ভরসা রাখুন। কেউ অকারণে কারো আত্মীয়ের উপর অভিযোগ করবেন এই ভাবনা থেকে সরে আসুন। ছেলে বা মেয়ে সন্তানকে যথা সম্ভব বাবা-মা'র তত্ত্বাবধানেই রাখুন। ছেলেমেয়েকে ব্যাড টাচ সম্পর্কে ধারনা দিন। বাচ্চাদের সাথে ফ্রি সম্পর্ক গড়ে তুলুন যেন তারা সবকিছুই আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারে। কারো প্রতি অন্ধবিশ্বাস রাখবেন না। সন্তান যেই আত্মীয়ের সঙ্গই উপভোগ করুক না কেন, লক্ষ্য রাখুন। প্রতিটি সম্পর্ক হোক সুস্থ্য স্বাভাবিক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুন্দর সম্পর্কের মাঝে বেড়ে উঠুক এইটুকুই আমাদের প্রত্যাশা। সচেতন হোন। সচেতন হয়ে ওঠার এটাই উপযুক্ত সময়।