‘বিবর্তন’ ও সেন্সর বোর্ডের দেউলিয়াপনা

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৩২

আনন্দ কুটুম

যেদেশের ফুললেন্থ সিনেমাই দর্শক ঠিকঠাক দেখে না, সেই দেশে একটা শর্ট ফিল্ম কতজন দর্শকের কাছে পৌছতে পারে?

‘বিবর্তন’ ৫ মিনিটের একটি শর্ট ফিল্ম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় দাবী করে, সেন্সর বোর্ড সিনেমাটি আটকে দিয়েছে।

আমার কথা হল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষার দায়িত্ব সেন্সর বোর্ডকে কে দিয়েছে? সেন্সর বোর্ডের দায়িত্ব হল, তার নীতিমালার অণুচ্ছেদের উপর নির্ভর করে জবাব দেওয়া। ঢালাও ভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে সংগতিপূর্ণ না’ বলেই তো সে খালাস পেতে পারে না। তাকে অবশ্যই বলতে হবে, (নীতিমালার ওমোক অনুচ্ছেদের সাথে এই চলচ্চিত্র সাংঘর্ষিক)।

বিবর্তন বাতিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে সেন্সর বোর্ডের সচিব মুন্সী জালাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এ ছবির কাহিনী প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী রূপ ধারণ করেছে। এছাড়া এতে ইতিহাসের বিবর্তন সুনির্দিষ্ট নয় এবং বক্তব্যও অস্পষ্ট।

সেন্সর বোর্ডের চিঠিতেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সেন্সর বোর্ড চিন্তা চেতনায় কতোটা দেউলিয়াপনায় ভুগছে। যেখানে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিবর্তন সুনির্দিষ্ট নয় এবং বক্তব্য স্পষ্ট নয়। সেখানে আবার বলা হচ্ছে, এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং চেতনা বিরোধী।
এখন কথা হল, 
(১) সেন্সর বোর্ডের কাছে যখন সিনেমাটির বক্তব্য স্পষ্টই না, তখন তারা কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে এটা মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থি?
(২) সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের যদি মনেই হয়ে থাকে যে, এই সিনেমায় ইতিহাসের বিবর্তন সুনির্দিষ্ট নয়, তবে কি করে তা স্বাধীনতা চেতনার পরিপন্থী হয়? যেখানে নিদৃষ্ট করে বা স্পষ্ট করে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সেখানে সেন্সর বোর্ড সেই অস্পষ্ট বা অনির্দিষ্ট বিষয়টিতে কি করে সিদ্ধান্তে আসে? 

যদিও ছবিটির ঠিক কোন কোন জায়গায় এমন অস্পষ্টতা বা স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী বক্তব্য আছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেনি সেন্সর বোর্ডের কেউই। এদিকে একটি অনলাইন পত্রিকার সংবাদে দেখলাম বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ডের সচিব জনাব মুন্সী জালাল উদ্দিনের বিবৃতি দিয়েছেন- “এখানে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মতো বিষয়কে মাত্র ৫ মিনিটে দেখানো সম্ভব নয় এবং এ কারণে জনগণ তা নাও বুঝতে পারে। এর বক্তব্য জনসাধারণের কাছে বোধগম্য হবে না এবং এর মাধ্যমে ভিন্নভাবে বার্তা দেয়ার সুযোগ আছে।”

আমার প্রশ্ন জনাব মুন্সী জালাল উদ্দিনের কাছে, মুক্তিযুদ্ধকে ৫ মিনিটে দেখানো সম্ভব কি সম্ভব নয়, এই সিদ্ধান্ত কে নেবে? আপনি? তাহলে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের উপরে সিনেমা নির্মান করতে চাইলে তা কত মিনিটের হবে সেটাও আপনারা ঠিক করে দিতে চান? তাহলে পরিচালকরা কেন আর তবে সিনেমা বানাবে? সিনেমাটা সেন্সর বোর্ডের আমলারাই নির্মান করুক। জনসাধারণ সিনেমার ম্যাসেজ বুঝবে কি বুঝবে না, সেই দায় তো সেন্সর বোর্ডের না। এটা সেন্সর বোর্ডের এখতিয়ারের মাঝেও পড়ে না। জনগণকে এতো বোকা ভাবার কারণটা কি একটু স্পষ্ট করে বলবেন? সিনেমার বক্তব্য জনসাধারণের কাছে বোধগম্য হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত জনগণকেই নিতে দিন। জনগণকে সিনেমা বোঝানোর দায়িত্ব নিশ্চই সেন্সর বোর্ডের না।

সেন্সর বোর্ডের ইতিহাস ঘেটে দেখলে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে, সেন্সর বোর্ড বারবার তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সিনেমাকে রক্তাক্ত করেছে। যদি কোন সিনেমার মাধ্যমে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভুল তথ্য দেওয়ার সুযোগ থাকে, তবে সেটাও তো সেন্সর বোর্ডকে নির্দিষ্ট করে বলতে হবে। সেই উপনিবেশিক আমলে নির্মিত এই সেন্সর বোর্ডের আমুল পরিবর্তন চাই। এভাবে চলতে পারে না। শিল্পী ১ মিনিটের সিনেমা বানাবে না, ৫ মিনিটের সিনেমা বানাবে সেটা তার শৈল্পিক স্বাধীনতা। সেন্সর বোর্ডে মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনায় কাঁচি চালাতে পারেন না। সেন্সর বোর্ডের বিরোধিতা করে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে, এক মাসের ভেতরে তার সুরাহা করার দাবী জানাই। মাসের পর মাস ধরে এই সব সিনেমাকে নির্বিচারে আটকে রাখার ঘোর প্রতীবাদ জানাই।

পরিশেষে আরো কিছু প্রশ্ন- ৫ মিনিটের একটা ছবি ‘বিবর্তন’ মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কি এমন বাণী দিতে পারে যে পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেতে পারে? সেন্সর বোর্ডের এই স্বৈরাচারী আচারনকে কি বলব? এটা কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষার নাটক? নাকি সুকৌশলে এদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতার পায়ে বেড়ী পড়িয়ে মুক্তধারার স্বদেশী চলচ্চিত্রকে চিরততে মুছে ফেলার নীলনকশা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত