হ্যালো ‘অ্যাঙরি থার্টি’

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০১৭, ১২:৫২

হ্যালো ‘অ্যাঙরি থার্টি’
শুভেচ্ছা ও সংহতি জানবেন। 

জানি এই অসম্ভব বাস্তবতার যুগে অবসর পাওয়া বড়ই কঠিন। তারপরও লিখছি- একটু সময় করে এই লম্বা চিঠিটা পড়ে নেবেন একবার। হ্যাঁ, আপনাকেই লিখছি। আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এবং আপনি শিক্ষার্থী অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সেদিন সিনেট ভবনের সামনে আক্রান্ত হলেন। 

বেশ কয়েকদিন ধরে অনলাইনে-অফলাইনে তুমুল ঝড় বয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। যার রেশ চলছে এখনো। সাবেক ছাত্র হিসেবে আপনাদের মতো নাহোক অন্য অনেকের মতো আমারও জীবনের স্মৃতিতে নানাভাবে আষ্টেপিষ্টে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধূলোবালি-আলো-বাতাস। কাজেই চুপ করে থাকা গেল না আর। ভাবছি, আপনাকেই উদ্দেশ্য করে একখানা খোলা চিঠি লিখবো। 
অমন ঝড় বিরল না হলেও নানাবিধ অনুষঙ্গ নিয়ে এটা একটা একক মাত্রা পেয়েছে। অনলাইন পরিসরের স্ট্যাটাস বা লেখাপত্র আর মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ-অপ-সংবাদ, মতামত-অপ-মতামত দৃষ্টি এড়োয় নি। 

শুনেন, একটা ছোট্টগল্পের কিঞ্চিৎ বলি। 
স্থানটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবের গেইট-ঘেঁষা ফুটপাত। সকাল-দুপরের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে পূর্বনির্ধারিত শান্তিপূর্ণ এক মৌন-মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলাম। গেইটের অংশটা শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য খোলা রেখেই দুইদিকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমরা। ভেতরে-বাইরে নীল আর সাদা- এই দুই রঙের কয়েকটা লিফলেট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। লিফলেটগুলোতে শিক্ষকদের নির্বাচনী অঙ্গীকার থাকে। দাবি থাকে। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার কথা লেখা থাকে। আওয়ামী লীগ-বামপন্থী শিক্ষকরা নীল আর সাদাটা বিএনপি-জামাতপন্থীদের। ক্লাবের ভেতরে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হচ্ছে। গেইট দিয়ে স্যারেরা ভেতরে যাচ্ছেন, বের হচ্ছেন। টের পাওয়া যাচ্ছে না কোন শিক্ষক নীল আর কোন শিক্ষক সাদা দলের; কেননা স্যারদের গায়ে তো ইউনিফর্ম পড়া নাই বা ওইরকম কিছু নাই। তবে কয়েকজন পদস্থ শিক্ষকদের চেনা যায়। যাইহোক, বোঝা যাচ্ছে সবারই চোখে পড়ছে বিষয়টা। কেউ কেউ ভালো উদ্যোগ বলছেন। কেউ কেউ বলছেন এখানে কেন, অন্যদিকে জায়গা নাই? কেউ কেউ চুপচাপ দেখে চলে যাচ্ছেন। কেউ বলছেন টাফ, হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই’ লেখা এক প্ল্যাকার্ডের দিকে তাকিয়ে মুখটা কুঁচকে নাক সিটকানো ভঙ্গিতে ক্রূরহাসি দিলেন একটা। আর কী যেন বলতে বলতে ক্লাবের ভেতরে ঢুকে গেলেন। ২০১২ সনের একটা দিনের কিছু মুহূর্তের ঘটনা এটা।  

সেদিন আমরা পেলাম শিক্ষকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে থাকা এক শিক্ষকের মুখ কুঁচকানো ক্রূরহাসি। 

এর আগে, ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ডাকসু ভবনের দেয়ালে লেপ্টে থাকা একুশে ম্যূরালের সামনে খোলা আকাশের নিচে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সাধারণ শিক্ষার্থী আর বামধারার আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত শিক্ষার্থীদের মিলিত চেষ্টায় প্লাটফর্মটি গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সক্রিয় সেই যুথবদ্ধ আন্দোলনের লিটারেচার ঘাঁটলে আপনি ওই সময়টার আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পাবেন অনেক কিছুই। 

জানিয়ে রাখি, প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি হওয়ার আগে বর্তমানে উপাচার্য গোলটেবিলে-পত্রপত্রিকায় ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেন। উনি বলেন যে দায়িত্ব পেলে (উপাচার্য) ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। আমি তখনকার খবরের কাগজে পড়েছি, আরো নানাভাবে শুনেছি। সত্যতা যাচাই করতে চাইলে ওই সময়কার পত্র-প্রত্রিকা একটু ঘেঁটে দেখতে পারেন।  যাইহোক, এরপর আপনি দেখেছেন যে উপাচার্য হওয়ার পর স্যারের টোন যায় বদলে। 
 
পরে, আন্দোলনের শুরুতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আহবান জানান হলো। এ দাবিতে স্মারকলিপি দেয়া হলো। উনি নানানভাবে বললেন, ডাকসু নির্বাচন দেয়া সম্ভব না। ক্যাম্পাসে ‘অস্থিতিশীল পরিবেশ’ তৈরি হবে। নব্বইয়ের পর কয়েকটা নির্বাচন ঘটে গেছে দেশে। কোটি কোটি মানুষের নির্বাচন হয়েছে। তাইলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে সমস্যা কোথায়? 

বিভিন্ন বিভাগের ২৫ শিক্ষার্থী অচিরেই নির্বাচনের দাবি জানিয়ে ‘ডাকসু নির্বাচন কেন হবে না’ জানতে চেয়ে সাত দিনের উকিল নোটিশ পাঠালেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর। প্রশাসন কোনো জবাব দেয়নি। এরপর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ওই শিক্ষার্থীরা। হাইকোর্ট দুইমাসের সময় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জবাব দেয়ার জন্য রুল জারি করেন। দুই মাসের শেষ পর্যায়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সময় চাওয়া হয় জবাব দেওয়ার জন্য। হাইকোর্ট সময় বাড়িয়ে দেন মাস খানেক সম্ভবত, কমও হতে পারে। এরপর এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আজো সেই রুলের জবাব দেয়নি। ঐ পর্যন্তই শেষ। 

যাইহোক, কর্মসূচির বাইরে ক্যাম্পেইন চলতে থাকে। ক্যাম্পাসের কয়েকটা রাস্তায় পেইন্টিং চলতে থাকে। প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে। হলে হলে ক্যাম্পেইন হয়, মিছিল হয়, ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। বিভাগে বিভাগে ক্যাম্পেইন চলতে থাকে। স্বাক্ষর গ্রহণ, জরিপ চলতে থাকে। পোস্টার, লিফলেট, বুলেটিন প্রকাশিত হয়। আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে। আরো অধিক নতুন নতুন শিক্ষার্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকে কয়েক মাস।

ধারাবাহিক আন্দোলন চলাকালে ফিরে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ বডি বলে বিবেচিত সিনেট নির্বাচন। শিক্ষার্থীরা ওইদিন বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা করলেন সিনেট ভবনের সামনে। ওই বিক্ষোভের আগেরদিন সন্ধ্যা আটটা-নয়টার দিকে প্রক্টর শিক্ষার্থীদের সিনেট ভবনের সামনে বিক্ষোভ করতে নিষেধ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, বিক্ষোভকারীরা কতজন থাকবেন? উত্তরে বলা হলো, ৫শ’ও হতে পারে আবার ৫ হাজারও হতে পারে। বলেলন, না না না, এতো না! এটা করা যাবেনা! শিক্ষার্থীরা জানালেন, তাদের যৌক্তিক দাবি তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যেমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তথা শিক্ষকদের জানিয়ে দেবেন। বিক্ষোভ চলবে। বিক্ষোভ চলেছিল। মাথা খারাপা! ৫শ’/৫ হাজার শিক্ষার্থী আসবে আন্দোলনে এতো তাড়াতাড়ি! শিক্ষার্থীরা বোধহয় মস্করাই করেছিলেন একটু! 

পরদিন বিক্ষোভ মিছিল অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে ক্যাম্পাস ঘুরে সিনেট ভবনের দিকে। ক্যাম্পাস শ্যাডো পেরিয়ে যেতেই মলচত্ত্বরের মহুয়া-কৃষ্ণচূড়া-জারুল-কড়ই গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দাঙ্গা পুলিশ! সঙ্গে প্রক্টর-শিক্ষকও! বাহ! কী সৌভাগ্য! প্রক্টরিয়াল বাহিনী শত শত পুলিশ ভাইদের নিয়ে হাজির সিনেট ভবনের গেটের সামনে! বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুলিশ নিয়ে আমাদের ন্যায্য দাবির মিছিলে মুখোমুখি হবে! 

মিছিল আরো গতি পেল মলচত্ত্বরের এঁকোবেঁকো পথ দিয়ে। সিনেট ভবনে যেতে যে স্বাস্থ্যবান লোহার মূলফটকটা দেখেন এখন; ওটা তখন হালকা-পাতলা ছিল। তো মিছিল সেই আধমরা গেট ঠেলে (ভাঙা লাগেনি) ভেতরে যাচ্ছে। সামনে প্রক্টরের দল, দলের পেছনে দাঙ্গা-পুলিশ। কী যেন বলতে বলতে তেড়ে এসে মিছিলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন প্রক্টর। স্লোগান চলছে বোঝা গেল না কী বলছিলেন উনি। শিক্ষক-সহকারী প্রক্টরেরা একধাপ এগিয়ে এসে ধাক্কা দেয়া শুরু করলেন। মিছিলের সামনে যারা ছিলেন তারা প্রক্টরদলের অনবরত ধাক্কা খেতে লাগলেন। ম্যাট্রিক্স ছিনেমার ভিলেন সদৃশ একজন শিক্ষককে দেখা গেল অন অ্যাকশনে। ঐরকম কালো চশমা ছিল চোখে; এইজন্যই। না দেখলে মিস করবেন। সময় নিয়ে পারলে দেখবেন- ছিনেমার ঐ ভিলেনের অবয়ব আর এ ভিলেন-সদৃশ লোকটির অবয়ব একেবারেই সেম। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং কিন্তু। 

কোনো কথাই শুনছেন না তারা। মিছিল ঠেকাবেনই। এক পর্যায়ে এক প্রক্টর ধরলেন আমার মুষ্ঠিবদ্ধ বাম হাত, আর এক প্রক্টর ধরলেন আমার ডান হাত আর একজন ধরলেন আমার গলা। তাতে লাভ হয় নি। বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা মিছিল এগিয়ে নিয়ে যায়। দাবি আদায়ের সেই মিছিলটি সিনেট ভবনের সামনে পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল, যে পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল। 

পরে টের পেলাম আমার প্রিয় একটা ফতুয়ার একটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে। বন্ধু-বান্ধব জিজ্ঞেস করত বোতাম লাগাস না ক্যান? তাগো কইতাম বোতাম নাই, চিলে নিয়ে গেছে। তো ব্যাপার না। এরচেয়ে আরো কত তুখোর আন্দোলনের ফাইটার ছিলাম ২০০৭ সালের অগাস্টে! এইসব কি ভোলা যায়! যাইহোক, ভাবনা-চেন্তা বাদ দিলাম। জীবনানন্দ দাশ বলছেন- সময়ই সবচেয়ে গভীর বিপ্লবী। সো লেট ইট ফাইট...। অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলেছিল, চলবে।  

সেই শিক্ষক ক্লাবের সামনে মুখ কুঁচকানো ক্রূরহাসি একধাপ উঁচুতে মাত্রা পেল সিনেট নির্বাচনের দিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন (সঙ্গে পুলিশ) শুধু মিছিলের গতিরোধ করেই দাঁড়াচ্ছে না বরং নিজে শিক্ষক হয়েও শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির শান্তিপূর্ণ মিছিলে ধাক্কাধাক্কি করছে। মানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরো বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠছে দমনের জন্য।

সেদিন আপনারা যে আক্রমণের শিকার হলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দ্বারা তার সঙ্গে এই ঘটনার মিল খুঁজে পাবেন খানিকটা। এরপরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়তো কামান-জলকামান নিয়ে আপনাদের ন্যায্য মিছিলের গতিরোধ করে দাঁড়াবে। এতে কেন আশ্চর্য হবেন না, বলছি। 

বলে রাখি, ২০১২ সালে শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের প্ল্যাটফর্মে গড়ে উঠা আন্দোলনটি প্রথমবারের মতো অগণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে। মঞ্চের পাশাপাশি ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোও স্বতন্ত্রভাবে ডাকসু নির্বাচনের দাবি তোলে।
 
২০১২ সনের ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট পালন করে শিক্ষার্থীরা। ছাত্র সংসদের দাবিতে ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে ক্লাসকার্যক্রম সবকিছু বন্ধ ছিল। এরপরে উপাচার্য ‘বহিরাগত’ বা ‘অছাত্র’ বলে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। আরো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেছেন ক্যাম্পাস ‘অস্থিতিশীল’ করার পাঁয়তারা চলছে। 

‘বহিরাগত’ বা ‘অছাত্র’ বলায় শিক্ষার্থী তাদের আইডি কার্ড দেখিয়ে তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছেন। উপাচার্য জেনে-শুনে-বুঝে ‘বহিরাগত’ বা ‘অছাত্র’ বললেন কেন? ‘অস্থিতিশীল’ বললেন কেন? কারণ আছে। পরে বলছি।  

এর আগে যখন ছাত্র সংসদের দাবিতে হল থেকে বিভিন্ন শিক্ষার্থী কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছিলেন, তখন তাদের হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়া হলো। যারা ফার্স্ট ইয়ার-সেকেন্ড ইয়ারে পড়ত সে সময়ে হলে সিট ধরে রাখার জন্য কর্মসূচিতে ঠিক ওইভাবে আর অংশ নিতে পারছিলেন না। 

আমাদের সামনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বাধাগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগল। যে প্রশাসনে ব্যক্তিরা আগে মুখে মুখে ডাকসু নির্বাচনের কথা বলত তারা নানাভাবে ঠেকাচ্ছে। যারা মানে ক্যাম্পাসের প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছে, তারাও পরোক্ষভাবে ঠেকাচ্ছে। যদিও তারা তখন মিডিয়ায় শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকির বিষয়টা অস্বীকার করেছে। এ দ্বি-চারিতা ভাবালো।  

আন্দোলন তার নিজের গতিতে চলছে। প্ল্যান-কর্মসূচি ছিল আস্তে আস্তে কালরঙ দিয়ে ডাকসু ভবন (ম্যূরালচিত্র বাদে) ঢেকে দেয়া হবে। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অবিকল থাকবে। কোনো শিক্ষার্থী চাইলে তার হাতের ছাপ এই ভবনে রেখে দিতে পারবেন। শিক্ষার্থী অধিকারের জীবন্ত মনুমেন্ট হবে এই ভবন। পাশাপাশি ডাকসু ভবনের সামনে বিকেলে প্রতিদিন সাংস্কৃতিক আয়োজন চলতে থাকবে- এই রকম একটা প্ল্যান। এর মধ্যে আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকব ছায়া নির্বাচনের। ডাকসুর সংবিধান (যদিও আপডেটের প্রয়োজন রয়েছে) অনুযায়ী নিয়ম-কানুন মেইনটেইন করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হবে কাজটা। এরও পাশাপাশি থাকবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুধু ছাত্র সংসদের দাবিতে একটা যৌথ প্লাটফর্ম গঠন করার উদ্দেশ্যে যোগাযোগ। এভাবে ডাকসু ভবনের সামনে প্রতিদিন গানা-বাজনা-ডকুমেন্টারি প্রদর্শন চলতে থাকলো। পাশাপাশি সামনের অংশটায় পেইন্টিং শুরু করে দিয়েছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। আস্তে আস্তে সাধ্য অনুযায়ী ডাকসু ভবন কালরঙ করা হবে। এভাবে কয়েকদিন চলতে থাকলো। এই কর্মসূচি চলা অবস্থায় একদিন খবর এলো যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছে। প্রতিবাদে তরুণেরা দিকে দিকে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। আর কই যায়.. লেটস গো টু শাহবাগ। রঙতুলি-গিটারসমেত শিক্ষার্থীরা শাহবাগে, গণজাগরণে। ৫ ফেব্রুয়ারি।  

কাজেই, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি হুট করে অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসে নি। মুক্তজ্ঞানচর্চার ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা নিভু নিভু করে হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জারি ছিল। আছে। থাকবে। সুতরাং কেউ যদি বলে ‘বিশেষ দিনে ডাকসু নির্বাচন চাওয়ার দাবির পেছনে ষড়যন্ত্র আছে’ তাহলে সেটা ধোপে টেকে না। এই কিসিমের কথাবার্তার মধ্যে একটা বিশেষ বার্তা আছে। পরে বলছি কী সেই বার্তা।

ন্যায্য মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে গলাধাক্কা দেওয়া বা ওড়না ধরে টান দেয়া খুব ভালোভাবে প্রমাণ করে যে তারা ছাত্র সংসদ স্বীকার করেন না, শিক্ষার্থী অধিকার স্বীকার করেন না। বরং ঠেকানোর অপপ্রয়াসে লিপ্ত আছেন তারা। এটা স্পষ্ট হয়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়া ঠেকাবে বলেই হাইকোর্টের রুলের জবাব দেয়নি প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকদের অবস্থান ছাত্র সংসদ তথা শিক্ষার্থীদের অধিকারের সম্পূর্ণ বিপরীতে। কেন? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাহলে কী জিনিস? বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা জায়গায় ছাত্র-সংসদ যেখানে ‘এক্সট্রাকারিকুলার এক্টিভিটিজে’র মধ্যে, যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেও বেশ করে দেয়া আছে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন ঠেকাচ্ছে? এতো বৃহৎ অবয়বের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক সিনেট কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিহার্য অংশ শিক্ষার্থীদের মতামতের জায়গা কোথায়? ২৫ জন নির্বাচিত রেজিস্ট্রার্ড গ্রাজুয়েটদের জায়গা কোথায়?  সারা দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় অর্থায়নের একটা বৃহৎ অংশ থাকে রেজিস্ট্রার্ড গ্রাজুয়েটরা। আরো নতুন অর্থায়নের সোর্সের সুযোগ করে দেন রেজিস্ট্রার্ড গ্রাজুয়েটরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অর্থায়নের সুযোগ কোথায়?
 
উত্তর খুব স্পষ্ট।
 
আচ্ছা, শুনুন। একটা স্বৈর-ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরের মানুষের সংস্কৃতিচর্চা কেমন হয়? ঐ একরোখা চর্চার মনস্তাত্ত্বিক বলয় সেখানে কিভাবে তৈরি করা হয়? কী উদ্দেশ্যে সেটা করা হয়? এর একটা ব্যাখ্যা পাবেন আপনি ফ্রাঞ্জ ফানোনের ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’ বইতে। মনো বিশ্লেষণ ও মন:সমীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে (উপনৈবেশিক) ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে ‘সাদা’দের সংস্কৃতি ‘কালো’দের মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করে। শত শত বছর ধরে উপনিবেশিক কায়দায় আলজেরিয়ার মানুষেরা হেয় হতে হতে নিজস্ব সংস্কৃতি খুঁইয়ে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য সাদাদের অনুসরণ করতে শুরু করল। ‘সাদা’রাই বুঝি সভ্যতার উন্নয়নের কাণ্ডারি। সাদারাই বুঝি উন্নত মানুষ। সাদারাই বুঝি ইশ্বরের আর্শীবাদপুষ্ট। একপর্যায়ে তারা একদিনের জন্য হলেও ‘সাদা’ হওয়াটা পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করতে থাকলো। এমনি করে তাদের জাতীয় উৎসবের দিনে ‘সাদা’ মুখোশ পড়ে দলে দলে রাস্তায় নামা শুরু করলো কালো-আলজেরিয়াবাসী। তৈরি হতে থাকল কালো চামড়ার একদল ‘সাদা’ মানুষ। এভাবে কালোদের দেশে সাদামানুষ এবং ইউরোপিয়ানদের সংস্কৃতির জগত তৈরি হয়। সাদা মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতি কালোদের স্বকীয়তা খোয়াতে বাধ্য করে। ফলে এ ধরনের একরোখা ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে যেমন ব্যাক্তিসর্বস্ব ভোগবাদী প্রবণতাকে উস্কে দেয় অন্যদিকে শেকলপ্রেম বা দাসত্বপ্রীতি শেখায়।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কোনো শেষ নেই। এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহও নেই। এবার আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক ইতিহাসের দিকে তাকান যেটা একান্ত বেদনার এবং মর্মান্তিক হয়ে আছে। দেখেন, আপনার পূর্বপূরুষের হাত ধরে ভাষা আন্দোলন, দেশস্বাধীন হয়েছে। স্বৈরাচারদের পতন হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়িয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কত সুপরিকল্পিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে, পঙ্গু করা হয়েছে জাতিকে। সে ক্ষত আজীবন পূরণ হবার নয়। এর ধারাবাহিকতায় যারাই মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে চেয়েছেন তাকেই হত্যা করা হয়েছে। কোপ খেতে হয়েছে। আজ তার বিস্তৃতি আপনি সারাদেশে দেখতে পাচ্ছেন একের পর এক। সর্বশেষ চলে এসেছে ৫৭ ধারা। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন সব।
   
আপনি দেখবেন, যে গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘গণতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনল দেশে, নব্বইয়ের পরে সেই শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চার জায়গাটাই সুকৌশলে নাই করে দেয়া হলো। কেন ‘নাই’ করে দেয়া হলো? বলা হলো (এখনো বলা হচ্ছে) যে ক্যাম্পাসে খুনোখুনি, অস্ত্রের ঝনঝনানি বা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে। নব্বইয়ের পরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটে যায় ক্যাম্পাসে। এইসব খুনোখুনির ঘটনায় কারা জড়িত ছিল? আপনি দেখবেন যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের এই সন্ত্রাসী অংশের উৎপত্তি বেশ আগেই। ষাটের দশকে কিংবা তারও আগে। জাতীয় রাজনৈতিক দল বলে বিবেচিত সংগঠনগুলো তাদের ছত্রছায়ায় স্ব স্ব ক্ষেত্রে একদল করাপ্টেড বাহিনী তৈরি করল। ছাত্রদের হাতে টাকা-পয়সা ধরিয়ে দিল, অস্ত্র তুলে দিল। কেন? জাতীয় রাজনৈতিক দলের কী দায় এখানে? কারণ স্পষ্ট ছিল। এখনো আরো জোরালো। বলছি একটু পরে।   

আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক চর্চার দিকে একটু দৃষ্টি দেন। র‌্যাংকিং-ফ্যাংকিং বাদ দেন। ওইসব ভুয়া জিনিস। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পৃথিবীর মহাকাল নির্মাণ করে চলেছে। সুতরাং এটা তিনদিন কিংবা এক বছর বা পাঁচ বছরের হিসেবে চলে না বা এর মানদণ্ডে টেকে না। যাইহোক, ভেতরের ক্ষয় আরো গভীর হয়। একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে আপনি কিভাবে চেনেন? সারা দুনিয়া কিভাবে চেনে? বিশ্বমানের শিক্ষক, বিশ্বমানের শিক্ষার্থী, গবেষণা-প্রকাশনা এবং গবেষণায় বরাদ্দ- এই চারটি বিষয়ের দিকে তাকিয়েই আপনি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়কে চেনেন বা জানেন। 
   
বাদ দেন বিশ্বমান। আপনি নিজের দিকে, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন। দেখবেন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এখন (২০১১ সন) পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা গ্রন্থের সংখ্যা ১৬৯ টি। এর মধ্যে অনূদিত গ্রন্থ ৩টি। ৬৭ বিভাগের (২০১১ পর্যন্ত) মধ্যে বিভাগীয় জার্নাল আছে মাত্র ২/১ টির। বিভাগ থেকে আজ পর্যন্ত নিয়মিত কোনো জার্নাল বের হয়েছে বলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি বলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার বাইরে থেকেও তো শিক্ষকেরা-গবেষকরা বইপত্র করেন, লেখাজোখা করেন; তাহলে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনাদের ব্যবধানটা আরো সুদূরপ্রসারী গভীর হবে। আপনি দেখেন, অনুষদভিত্তিক ৫/৬টি জার্নাল আছে; যেগুলোর মান নিয়ে খোদ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রশ্ন আছে। এছাড়াও গোটা পঞ্চাশের বেশি গবেষণা সংস্থা আছে যেগুলো চলে টেনে-হিঁচড়ে। যে বরাদ্দ থাকে তা দিয়ে ওই সংস্থারই ব্যয় সংকুলান হয় না; আর গবেষণা যাবে কই! খারাপ কী! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা বগল বাজাব এই ভেবে যে ১০০ টির চেয়েও বেশি গ্রন্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে! 

সেমিস্টার সিস্টেমের দিকে তাকিয়ে দেখেন, ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে এটা প্রবর্তন করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিনের সেশনজট শূণ্যের কোটায় চলে আসে। কিন্তু হয়েছে কী? শিক্ষক-শিক্ষার্থী এখন দৌড়ের উপর থাকেন। ফলত কাজের কাজটা হয় না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই খোদ ক্লাসে এই সেমিস্টারের ম্যালফাঙশনিং নিয়ে কথা বলেন।
  
আপনি আরো দেখবেন যে, ছাত্র সংসদ বন্ধ করে দেয়ার পর থেকে হলে হলে যে বৃহদাকার অডিটোরিয়ামগুলো ছিল তাতে মাকড়শার জাল বুনতে শুরু করে। যে মঞ্চগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলত সেখানে অচিরেই আগাছা জন্মাতে শুরু করে। কোথাও কোথাও দেখবেন ওই একেকটা মঞ্চের কোণে একেকটা টেলিভিশন সেট জায়গা করে নিয়েছে। এভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব সুকৌশলে তৈরি করে দেয়া হয়।   

‘দুনিয়াবাসী’ মেনে নিয়েছে, উপাচার্যরা রাজনৈতিক হন। নব্বইয়ের পর সব উপাচার্যই রাজনৈতিক দলের লোক ছিলেন (নব্বইয়ের আগের উপাচার্যরা এখানে অপ্রাসঙ্গিক)। কী কথা! রাজনৈতিক লোক হয়েও উনারা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চার মেরুদ- ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা করেন না! সমস্যা কোথায়?

উপাচার্যগণ অসীম উদারতায় আপনাকে আগলে রাখেন বলে রাত্রি ৩টা পর্যন্ত উপাচার্যের বাংলো খোলা থাকে, সমস্যা নিয়ে যাইতে পারেন, যখন ইচ্ছে ফোন দিতে পারেন, ট্রিপের পয়সা চাইয়া উপকৃত হতে পারেন। মোটকথা, উপাচার্যরা সযতনে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছেন আপনার। কিন্তু ছাত্র সংসদের দাবি করলে আপনি পাচ্ছেন তিরস্কার, লাঞ্ছনা, প্রহসন। কেন? সমস্যা কোথায়? 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলো ক্রিম। এদের হাতে অসীম ক্ষমতা। যা ইচ্ছে করতে পারেন যখন-তখন। ইতিহাস বলে, তারা অন্যায়-অবিচার সহ্য করে না। ৯০ এ রাষ্ট্রক্ষমতা এনে দিয়েছিল একটা দলকে। ২০০৭ এর ২০-২২ অগাস্ট ঘটিয়ে শিক্ষার্থীরা আবার একটা দলকে ক্ষমতায় এনেছে। মাঝখানে আর এক দলীয়-নিপীড়ক উপাচার্য শামসুন নাহার হল ছাত্রী নির্যাতনের (২০০৩) দায় নিয়ে ভেগেছেন। 
সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রিপে রাখা রাষ্ট্রের, জাতীয় রাজনৈতিক দলের এবং উপাচার্যের মূল এজেন্ডা। উপাচার্যরা উনার রাজনৈতিক দলের ভালো চান সবসময়, যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকেন। উপাচার্যগণ রাজনৈতিক দলের এজেন্ডাকে জাতীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এজেন্ডা হিসেবে জ্ঞান করে বিশ্ববিদ্যালয়কে ওই লাইনে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় থাকেন। তাই শিক্ষার্থীদের ভিন্নমতের প্রয়োজন পড়ে না তাদের। তাই শিক্ষার্থীদের সংগঠিত হওয়ার বা গণতান্ত্রিক চর্চার জায়গাগুলো নষ্ট করে দেন। এইজন্যই আপনি দেখবেন যে ক্যাম্পাসে আড্ডা দেয়ার জায়গাগুলো, শিক্ষার্থীদের মিথস্ক্রিয়ার জায়গাগুলোও সপাটে নাই করে দেয়া হয়েছে। দেয়ালের পর দেয়াল তুলে দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সবকিছু সঙ্কুচিত করে, মেরুদ- ভেঙে উপাচার্যগণ তাই অধিক রাত পর্যন্ত তার বাংলো খোলা রাখেন। ভয় পাবেন না, এরপর আপনি দেখবেন ওই বাংলো ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকবে। শিক্ষার্থীরা যাবেন আর প্রেসক্রাইবড্ হয়ে বেরিয়ে আসবেন। আধিপত্যবাদী ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের মাতৃদল (মাদার অর্গানাইজেশন অর্থে) মনোনীত উপাচার্যগণকে এবং ক্যাম্পাসকে ছায়ার মতো পাহারা দিয়ে থাকেন। 

তো আপনি কী দেখলেন? ৯০ এর পর থেকে সুপরিকল্পিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে করা হলো রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের দাস তৈরির ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। উপাচার্যগণ এই ফ্যাকাল্টির মহান নেতা। কথা বলার জায়গা, ছাত্রদের যে মেরুদ- সেটা ভেঙে দিয়ে আরামে রাজনৈতিক দাস উৎপাদন করতে থাকলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একরোখা স্বৈরতান্ত্রিক প্রশাসন। 

নির্বাচন না দিয়ে এতগুলো উপাচার্য তার পদে টিকে থাকলো কী করে? ঐ যে উপাচার্যের উন্মুক্ত বাংলো, উন্মুক্ত অফিস যে অবারিত সুশীতল ছায়ার দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভুলিয়ে দিয়েছেন ছাত্র সংসদের অস্তিত্ব। মেরুদ-হীন শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ডে উপাচার্যগণ পরম মমতায় রাষ্ট্রের মলম লাগিয়ে দিয়ে সে ব্যথা-যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিলেন। তাদেরকে বলা হলো তোমরা ভালো, সুস্থ্য হয়ে উঠেছ। তোমরা বিশ্বমানের গ্রাজুয়েট। যুগের পর যুগ ধরে সেই অচল-চর্চারই যথাযথ প্রোপাগান্ডা-প্রোডাকশন আপনি সহজে দেখতে পাবেন আপনাদের সেদিনের আন্দোলনের পরে। 
 
সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকেদের ওই মুখ কুঁচনো ক্রূরহাসি, পুলিশসমেত ধাক্কাধাক্কি এবং আপনাদেরকে সেদিন লাঞ্ছিত করা। কারণ এরা ছাত্র সংসদ চায় না। এটা পরিষ্কার। তাই, ওদেরকে ভালোভাবে জানিয়ে দেয়া বড়ই প্রয়োজন যে মানুষ হওয়ার শিক্ষা আকাশ থেকে আসে না... গণতান্ত্রিক চর্চা ও বোধের মধ্যদিয়ে তৈরি হয়।  
 
ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে, ছাত্র সংসদ আন্দোলনের একজন সাবেক কর্মী হিসেবে আমার যোগাযোগ পাঠের এই খণ্ডিত ও আংশিক গল্পটি শেষ হলো। 

ডাকসুর মূলকথা শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা। ছাত্র সংসদের মূলকথা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা। জয় আপনাদের হবেই। ভালো থাকবেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত