জমির মালিকানা হারিয়েছেন জুমিয়ারা

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০১৬, ১৭:৫৪

পপেন ত্রিপুরা

১.
তিন পাহাড়ে চলছে এখন জুম চাষের মৌসুম। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমিয়ারা কেউ বীজ বপনে, কেউ নিড়ানীতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন এখন। জুমিয়া নারীরা প্রতিদিন ভোর রাতে উঠে রান্না-বান্না সেরে ভাত-তরকারি কলাপাতায় মুড়িয়ে নিয়ে খাংগ্রা(কাল্লোং) পিঠে করে জুমে চলে যায় প্রথম সকালে।

ঘরে ফেরে শেষ সন্ধ্যায়। বলা হয়ে থাকে এ সময় জুমিয়াদের পায়ের পানি শুকাতে সুযোগ পায় না।

সাধারণত চৈত্র মাসে কাটা জঙ্গল পোড়া দেওয়ার পর বৈশাখ মাস থেকে অবিরাম জুমে কাজ করা ধুম পড়ে যেত। কিন্তু এ বছর সময় মত বৃষ্টি না হওয়ায় বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে ধান বপন করতে পারেনি জুমিয়ারা। ফলে এখনো অনেক জুমিয়া ধান বপন করছেন। তবে, পুরো আষাঢ় মাস জুমে বীজ বপন করা সম্ভব বলে জুমিয়ারা জানান। তবে, এতে ফসল ভাল উত্‍পাদন হয় না বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
 
কিন্তু অনেক বছর আগেই জুম জমির মালিকানা হারিয়েছেন জুমিয়ারা। যা অনেকেই জানতেন না যে, তাঁরা বাঙালিদের কবুলিয়ত প্রাপ্ত জমিতে জুম চাষ করেছিলেন এতদিন।

এবার, চূড়ান্ত জুম চাষ বন্ধের অশনি সংকেটে জুমিয়ারা তাঁদের জীবিকা নিয়ে আশংকা করছেন। আর এ অশনি সংকেট হলো পাহাড়ের মালিকানা পরিবর্তন ও নির্বিচারে 'সেগুন' গাছ রোপন। চাকরিজীবী পয়সাওয়ালা, ব্যবসায়ী পয়সাওয়ালা ও কবুলিয়ত জমির মালিক বাঙালিরা লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করছে সেগুন বাগান গড়ে তোলায়। গরীব জুমিয়াদের অভাবকে পুঁজি করে তাঁদের জুমজমিগুলো স্বল্প পয়সায় কিনে নিয়ে তাতে হাজার হাজার সেগুন বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। চারদিকে সেগুনের ব্যাপকতা দেখে জুমিয়ারা আশংকা করছেন আরো কয়েক বছর পর জুমচাষ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কোনো দায়িত্বশীল অধিদপ্তরে জুম চাষের তথ্য, জুমিয়াদের সংখ্যা না থাকলেও এখনো শতে অর্ধেকের বেশিই পাহাড়িদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম জুম চাষ। একটি তথ্য বলছে, ২০১১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা শতকরা ৮০ পরিবার জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। অন্য একটি সমীক্ষার হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ সালে জুমচাষ হয়েছে, খাগড়াছড়িতে ২,২৭২ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ৫১৬ মেট্রিক টন। রাঙামাটিতে ৬,৬১৫ হেক্টর জমিতে জুম চাষে করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১.২ মেট্রিক টন। বান্দরবানে চাষ হয়েছে ৮,৯৩৭ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪.১ মেট্রিক টন। জুমচাষীদের সংখ্যা দেখানো হয়েছে খাগড়াছড়িতে ১৪ হাজার পরিবার, রাঙামাটিতে ১২ হাজার পরিবার ও বান্দরবানে ১৪ হাজার পরিবার। যদিও এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২.
জুমচাষের প্রথম অশনি সংকেত নিয়ে আসে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড(পাচউবো)। জানা যায়, তত্‍কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড' গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই তত্‍কালীন ভূমি সংস্কার, বন, মত্‍স ও পশু পালন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত রাঙামাটি সফরে এসে স্থানীয় জনগণের এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের একটি প্রজ্ঞাপনমূলে(প্রজ্ঞাপন নং ২১।২।৭৬) 'পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড' নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর অধ্যাদেশ(অধ্যাদেশ নং ৭৭) জারি করে বর্তমান 'পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড' গঠন করেন। এই উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারিভাবে রাবার চাষ শুরু হয় ১৯৭৯-৮০ সালে। 'পার্বত্য চট্টগ্রাম উচ্চভূমি বন্দোবস্তিকরণ' প্রকল্পের মাধ্যমে আট বছর বত্‍সর মেয়াদী এই উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। শুরু হয় আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জীবিকার মাধ্যম জুমচাষভিত্তিক লোক-সংস্কৃতির পরিবর্তে রাবার চাষ সংস্কৃতি। 

পাহাড়িদের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সংগঠনের অভিযোগ, স্বয়ং রাষ্ট্র কর্তৃক পাহাড়ে ভূমি বেদখল হয়েছে এবং হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(পিসিজেএসএস) কর্তৃক ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রকাশনার হিসাবমতে, সামাজিক বনায়নের নামে সরকার ১৯৮৯ সালে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার ৮৩ মৌজার ২ লাখ ১৮ হাজার একর জমি অধিগ্রহন করে। একই সঙ্গে বান্দরবানে আর্টিলারি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনের জন্য সাড়ে ১১ হাজার একর জমি অধিগ্রহন করা হয়। ২০০৫ সালের দিকে রুমা সেনানিবাস সম্প্রসারঞের জন্য ৯হাজার ৫৬০ একর ভূমি অধিগ্রহন করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। সমসাময়িককালে সরকার নতুন সেটলারদের জন্য ২৮ হাজার রেশন কার্ড বিতরণ করার উদ্যোগ নেয়। 

অন্যদিকে, ৬৫ হাজার বহিরাগত পরিবারকে সাজেকসহ বিভিন্ন এলাকায় বস্তি স্থাপনের জায়গা প্রদানের কার্যক্রম পাকাপোক্ত করা চেষ্টা করা হয়। ২০০৫ সালের ২৩ জুন, বিডিআর সদস্যদের উদ্যোগে সাজেকের বিভিন্ন এলাকা থেকে জুমচাষীদের ঘর-বাড়ী ভেঙ্গে দিয়ে বিতারণ করা হয়। একটি সমীক্ষার হিসাবমতে, চুক্তি উত্তর এ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক ভূমি বেদখল হয়েছে ৭১,৮৭৭.৪৫ একর। এর মধ্যে, বান্দরবানের সুয়ালকে গোলনদাজ ও পদাতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য ১১,৪৪৫.৪৫ একর। সুয়ালক গোলন্দাজ ও পদাতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য প্রক্রিয়াধীন ১৯,০০০একর।
 
রুমা সেনানিবাস সম্প্রসারণের জন্য ৯,৫৬০একর। বান্দরবানে ব্রিগেড সদর দপ্তর সম্প্রসারণের চুড়ান্ত প্রক্রিয়াধীনে রয়েছে ১৮১ একর। টংকাবতিতে ইকোপার্ক ও সেনাবাহিনীর পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৫,৫০০একর। বান্দারবান লামা বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রক্রিয়াধীন ২৬,০০০ একর। বান্দরবান-রুমার পলি মৌজায় বিজিবি হেডকোয়ার্টারের জন্য ২৫ একর। দীঘিনালা বিজিবি হেড কোয়ার্টারের জন্য ৪৫ একর। বান্দরবান সদরে হ্লাপাইক্ষ্যং মৌজায় বিজিবি হেড কোয়ার্টারের আওতায় ১৩ একর। মাটিরাঙা ওয়াসু মৌজায় বিজিবি ক্যাম্পের জন্য ৮ একর।

মাটিরাঙার পলাশপুর বিজিবি ক্যাম্প সম্প্রসারণের জন্য ১০০ একর। বহিরাগতদের হাতে প্রদত্ত ইজারা ও জবরদখলে রয়েছে ৪০,০৭৭ একর জমি। এর মধ্যে, বান্দরবান সদরে রাবার বাগানের নামে ৯১টি প্লটের ২,২৭৫একর ও হর্টিকালচারের জন্য ১১৯টি প্লটের ২,৮৫৫একর। লামায় রাবার বাগানের নামে ৮৩৫টি প্লটের ২০,৮৭৫একর ও হর্টিকালচারের নামে ১৭৭টি প্লটের ৪,৫০০একর। আলিকদমে রাবার বাগানের নামে ১৯৪টি প্লটের ৪,৮৪৭একর ও হর্টিকালচারের নামে ৬২টি প্লটের ১,৫৫০একর।
 
নাইক্ষ্যংছড়িতে রাবার বাগান করার নামে ১১২টি প্লটের ২,৮০০একর ও হর্টিকালচারের নামে ১৫টি প্লটের ৩৭৫একর জমি। অন্যদিকে, বনবিভাগ রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নামে দখল করেছে ১,১৮,০০০একর জমি। তার মধ্যে আলিকদমে ৩টি মৌজায় ৫,৭৫৪.৯৮ একর। নাইক্ষ্যংছড়ির ৩টি মৌজায় ৪,৮৪০ একর। লামায় ৫টি মৌজার ২,৭৮০.৯৯একর। বান্দরবান সদরে ৫টি মৌজায় ১৫,৭৫০একর।

রোয়াংছড়ির ১০টি মৌজা ৪৫,৯৫০ একর। রুমার ৫টি মৌজার ১১,৫০০ একর। থানচির ৪টি মৌজায় ৭,৫০০একর। ৭টি উপজেলার ৩৫টি মৌজায় ৯৪,০৬৬.৯৭একর জমি বনবিভাগের দখলে রয়েছে। এছাড়াও প্রজ্ঞাপন বহির্ভূত কিন্তু বনবিভাগের দখলে রয়েছে ২৩,৯৩৩.০৩একর। এদিকে, পর্যটনের নামে দখল করা হয়েছে ১,৭০১একর জমি। এতে ২৬টি গ্রামের ৬৯৬পরিবার আদিবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যে, বান্দরবান সদরে কাপ্রু ম্রো পাড়াস্থ নীলগিরি পর্যটনের নামে ৭৬একর দখল করা হয়েছে। এর ফলে ছয়টি গ্রামের ২০০ পরিবার ম্রো ও মারমা জনগোষ্ঠী উচ্ছেদ হয়েছে। একই উপজেলার জীবন নগর সেপ্রু পাড়া এলাকার ৩টি গ্রামের ৬০০একর দখল করায় ১২৯ ম্রো পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে। একই উপজেলার নীলাচলে ৩টি গ্রামের দখল হয়েছে ২০একর। এতে ১০০পরিবার ত্রিপুরা, তঞ্চংগ্যা ও মারমা জনগোষ্ঠী উচ্ছেদ হয়। আলিকদম ও থানচি উপজেলার ডিমপাহাড়(ক্রাউডং) এলাকার ৫০০একর দখল করায় ১২টি গ্রামের ২০২ ম্রো পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে। রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেকের রুইলুই পর্যটনের জন্য দখল করা হয়েছে ৫একর জমি। এতে ২টি গ্রামের ৬৫ পরিবার ত্রিপুরা ও লুসাই জনগোষ্ঠী উচ্ছেদের হুমকিতে রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু লুসাই পরিবার ভারতের মিজোরামে পাড়ি দিয়েছে বলে জানা যায়।

এছাড়াও, বান্দরবান সদরস্থ চন্দ্র পাহাড়ে দখল হয়েছে ৫০০একর জমি।

৩.
কয়েক বছর আগে থেকে পাহাড়ের জুম আবাদে যোগ হয়েছে সেগুনসহ নানান বনজ ও ফলদ চারা রোপন। কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর শুধু দীঘিনালা উপজেলায় সেগুন চারা বিক্রি হয়েছে প্রায় দুই কোটি। এ বছরও দীঘিনালায় পৌনে দুই কোটি চারা বিক্রি হয়েছে বলে ধারণা করেন সেগুন চারা ব্যবসায়ী হাবিব ও ইউসুফ আলী। সেগুন চারার নার্সারির কৃষক ফজর আলী জানান, এই মৌসুমে দীঘিনালার বাজারগুলোতে অন্যান্য পণ্য থেকে সবচেয়ে বেচাকেনা হয় সেগুন চারা। তিনি জানান, প্রতিটা সেগুন চারার দাম পাঁচ-সাত টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ হিসেবে প্রতি বছর ১০-১২ কোটি টাকার সেগুন চারা বিক্রি হয়। বিক্রেতারা অধিকাংশ বাঙালি আর ক্রেতাদের বেশির ভাগ পাহাড়ি। আর সেগুন চারা বেশি বেচাকেনা হয় দীঘিনালা উপজেলায়। এখানে অন্যান্য উপজেলা থেকেও চারা আমদানি করতে হয়। 

এ হিসেবে খাগড়াছড়ির নয়টি উপজেলায় গড়ে দেড় কোটি সেগুন চারা বেচাকেনা হলে প্রতি বছর ১৩ থেকে সাড়ে ১৩ কোটি চারা রোপন হয়েছে। এ ধারা চলে আসছে প্রায় ১০ বছর ধরে। 

৪.
এছাড়াও, আট-নয় বছর আগে জুমে হলুদ আবাদ শুরু হওয়ায় মাটির উপরিভাগ ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। এক বছর বাজারে হঠাত্‍ হলুদের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জুমিয়ারা ব্যাপকহারে হলুদ চাষ করতে থাকে জুমে। বাণিজ্যিকভাবে জুমে হলুদ চাষ শুরু হওয়ায় জুমিয়ারা বাদ দেয় জুমের আদি ফসল তিল ও তুলা। কারণ, তিল গাছের নিচে হলুদ চাষ সুবিধে না হওয়ায় অনেকেই তিল ও তুলা আবাদ করা একেবারেই বাদ দিয়ে দেয়। এতে করে জুমের আদি ফসলের বীজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য আরো অনেক বছর আগে অনেক আদি ধান বীজ বপন বাদ দিয়েছে জুমিয়ারা। ইতোমধ্যে আবাদ কমে গেছে গেলোং, বেদি, মাইওয়াসা, মাইমি ওয়াতলাক ইত্যাদি ধানের। হলুদ বপন করা হয় দা দিয়ে আর উত্তোলন করা হয় কোদাল দিয়ে। আর হলুদ উত্তোলনের পরপরই গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হতে থাকে। বৃষ্টিপাতে পাহাড়ের মাটি ধূয়ে যাওয়ায় জুম জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়েছে।

৫. 
এবার জুমে সেগুন চারা রোপনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে জুমচাষ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিগগির। জুমে ফসল বীজ বপনের আগে পাহাড়ের মালিকদের জন্য সেগুনসহ নানান ফলদ-বনজ চারা রোপন করতে হচ্ছে জুমিয়াদের। আর জুমচাষের পাহাড়ে বাগান গড়ে উঠায় পাহাড়ে আর পরেরবার জুম চাষ করা যাচ্ছে না। কারণ, জুম চাষের জন্য কমপক্ষে ৫-৬ বছর অনাবাদি রাখতে হয়। কিন্তু স্থায়ী বাগানগুলো নিয়মিত পরিচর্যায় সেই পাহাড়ে কোনোমতে প্রাকৃতিক গাছপালা জন্মাবার সুযোগ থাকে না। যে জুমে একবার বাগান গড়ে উঠে সেখানে দ্বিতীয়বার আর জুম চাষ করা যাবে না। 

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার ভৈরফা পাড়ার নিরুপন ত্রিপুরা জানান, এ বছর তিনি আড়াই আড়ি(এক আড়ি=১০কেজি) ধানের জুম কেটেছেন। তবে, পাহাড়টি নিজস্ব নয়। পাহাড়টি পাশের গ্রামের সেটেলার বাঙালি মো. আসাদুলের। এখনো ধান বপন করা হয়নি। পাহাড়ের মালিক আসাদুল সেগুন চারা লাগাচ্ছে।

৬.
শদাব্দির পর শতাব্দি কাল ধরে পাহাড়িরা সামাজিক মালিকানাধীনে জুমচাষ করার সুবাধে জুমজমি তাঁদেরই ছিল। কিন্তু এখন আর তাঁদের নেই। চুক্তির পর পাহাড়ে স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে বাঙালিরা পাহাড়ের মালিক হয়ে যায়। পাহাড়িদের জুম চাষকৃত পাহাড়গুলোর মালিক এখন বাঙালি। এ পাহাড় সেটেলার বাঙালিরা জিয়াউর রহমান সরকারের কাছ থেকে কবুলিয়ত হিসেবে পেয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, ১৯৮০-৮১ সালে সমতল থেকে কয়েক লাখ বাঙালি এনে বসতি স্থাপন করানো হয় জিয়াউর রহমান সরকার। বস্তি স্থাপনকারীদের প্রত্যক পরিবারকে দেয়া হয় ৫একর পাহাড় জমি আর ২৩ শতক বসতভিটা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের আগে পরিস্থিতি বাঙালিদের অনুকুলে না থাকায় সে সময় পাহাড়গুলো দখল করতে পারেনি তাঁরা। 

'৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর 'পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি' স্বাক্ষরের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেটেলার বাঙালি প্রত্যাহারতো হয়ইনি উল্টো কবুলিয়তে প্রাপ্ত পাহাড়গুলো দখলে নিতে পথ সুগম হয়ে যায় বাঙালিদের।

এদিকে, চুক্তির পর পাহাড়িদের মধ্যে চুক্তি বিরোধী সংগঠন সৃষ্টি হওয়ায় প্রতিপক্ষের ভয়ে অনেক পাহাড়ি জঙ্গলে যেতেও সাহস পায়নি। এই সুযোগে সংশ্লিষ্ট এলাকার সেটলার বাঙালিরা সরকার থেকে প্রাপ্ত কবুলিয়তের জমি দখলে নিয়ে নিতে থাকে।

জুম চাষ এক সময় জুমিয়া পাহাড়িদের স্বয়ংসম্পূর্ণ বাজার ব্যবস্থার একটি চাষাবাদ ছিল। যেখানে শতাধিক ফসল, শস্য ও ফুল একসাথে ফলানো যেতো। বলা হয়ে থাকে, কেবল জ্বালানী তেল আর লবণ ছাড়া কোনো পণ্যই বাজার থেকে কিনতো না পাহাড়িরা। পাহাড়িদের কাঙ্খিত সব খাদ্য ও পণ্য দ্রব্য উত্‍পাদন হতো জুমে। 

ধান, তিল, তুলা, শসা, দরমাই(মারফা), কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ঢেঁড়শ, বেগুন, ঝিঙা, চিচিঙা, ধুন্দল, বানা(সাবারাং), ধনিয়াপাতা, লাউবানা, বরবটি, কচু, আলু, আখ, গাঁদাফুল, মোরগঝুটি ফুল, ওল, কাউন(কাকন), আদা, হলুদ প্রভৃতি ফুল, ফল, ফসল, শাক-সবজি, মসলা আবাদ হতো। 

৭.
কিন্তু বর্তমানে যতটুকু পাহাড়ে আবাদ হচ্ছে তা পুরোপুরি জুম চাষ নয় বলে কৃষিবিদদের মত। ফলদ ও বনজ বাগান বা রাবার বাগান পরিস্কার করে তাতে ধানসহ অন্যান্য শাক-সবজি চাষ করা হচ্ছে। কৃষিবিদরা জানান, কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় এ চাষ পদ্ধতিকে এ্যাগ্রো-ফরেস্ট্রি বলা হয়। পুঁজি নিয়ন্ত্রণমুক্ত বাজার ব্যবস্থা আবাদ জুম চাষ একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে কেবল জুমভূমি হ্রাসের ফলে।

লেখক: সংগঠক ও অধিকার কর্মী।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত