নায়ক না খলনায়ক? (ভিডিও)

প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০১৬, ১৩:৩০

তিনি অতিকায়। তিনি বৃহৎ, সুবৃহৎ। পোপ তো সাংগঠনিক নেতা তাঁর কথা আলাদা, কিন্তু সমস্ত ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় বিশ্বজুড়ে অন্তত: দশ কোটি ভক্তের দাবী (তার আবার বড় একটা অংশ বাংলাদেশী) আর বোধহয় কেউই করতে পারেন নি। সংখ্যাটা তিনি খুব তৃপ্তিভরে বলেন এবং তৃপ্তিটা তাঁকে মানায়। অনেক কষ্ট করে অনেক পড়েছেন তিনি, অসংখ্য কিতাবের অসংখ্য তথ্য তিনি মাথায় রাখেন। লোকে তাঁর বক্তৃতা পছন্দ করে কারণ তিনি অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে অবিশ্বাস্য সংখ্যায় উদ্ধৃতি দিতে থাকেন। এটা খুবই চমকপ্রদ এবং মানুষ চমক পছন্দ করে। মানুষ প্রায় কখনোই তাঁর দেয়া উদ্ধৃতিগুলো বই খুলে মিলিয়ে নেয় না। ভক্তদের এটাই স্বভাব।

তিনি ড: জাকির নায়েক। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে বিতর্কিত নন এমন মুসলিম নেতা বোধহয় নেই। এমন যে বড়পীর জিলানী সাহেব তাঁকেও কাফের ফতোয়া দিয়েছিল ইমাম হৌজ-এর নেতৃত্বে হাজারো ইমাম (তাঁর বক্তৃতার সংকলন 'ফতহুল গয়ব'-এর ভূমিকা)। তাই দশ কোটি ভক্তের নায়ক তিনিও এমনকি অনেক ইমামের কাছেও খলনায়ক। না, আশ্চর্য্য নয়। একদিকে আমাদের ইতিহাসটাই এমন, তার ওপরে তিনি তেমন কিছু সুযোগ দিয়েছেনও।

হ্যাঁ, তিনি ইসলাম নিয়ে বেশীর ভাগই ভালো কথা বলেন। তিনি মাজার পূজার বিরোধী, নারীদের মুখঢাকা নেকাবের বিরোধী, তিন-তালাকের বিরোধী যাতে অনেক নারীর জীবন ধ্বংস হয়, তখাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রকে তিনি শুধু অনৈসলামিক-ই বলেননি বরং জোরালো ভাবে ইসলাম-বিরোধী দাবী করেছেন ইত্যাদি। কিন্তু তিনি আবার পরিবার ও শিশু সহ হযরত ইমাম হোসেনের হত্যাকারী ইয়াজিদকে 'রাযিয়াল্লাহু আনহু' বলে কোটি মুসলিম ও আলেম-ইমামদের ক্ষেপিয়ে দিয়েছেন। এজন্য উত্তর ভারতের শিয়া-সুন্নী মওলানার একাট্টা হয়ে তাঁকে সেখানে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে, সেটা বোধহয় এখনো বলবৎ আছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় টিভিতে তাঁর সাক্ষাৎকারে দেখেছি তিনি কথাটা তো ফিরিয়ে নেনই নি, বরং দৃঢ়ভাবে নিজেকে সমর্থন করেছেন।

উনি বলেছেন বর্তমানে "মুহাম্মাদ (স)-কে মেনে চলা (উর্দুতে 'মান্ না') হারাম", এতেও ইমাম আলেম সহ কোটি লোক ক্ষেপেছে। কিন্তু উনি বলতে চেয়েছিলেন বর্তমানে "মুহাম্মাদ (স)-র কাছ থেকে কিছু চাওয়া (উর্দুতে 'মাংনা') আমাদের জন্য হারাম"। এটা বিতর্কিত বিষয়, বর্তমানে "মুহাম্মাদ (স)-র কাছ থেকে কিছু চাওয়া যাবে কি যাবেনা তা নিয়ে ইমামদের মধ্যেই প্রবল বিরোধীতা আছে। যাহোক, পরে দেখেছি তিনি আরেকটা ভিডিওতে ‘মাংনা'-র জায়গায় 'মান্ না' বলার জন্য দু:খ প্রকাশ করে বলেছেন – 

"আমার এক অনিচ্ছাকৃত বিবৃতি -'বর্তমানে মুহম্মদ (স)-কে মানা হারাম' - শোনার পরে আমার মত খাঁটি মুসলমান, যে আল্লাহ ও রসুল (স)এর ওপরে ঈমান রাখে, এমন কথা বলিতেই পারি না। এবং ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ কখনো বলিব না। এই অনিচ্ছাকৃত ও মুখ ফসকাইয়া বলার জন্য আল্লাহ সুবহানাওয়াতালা'র নিকট তওবা করিতেছি এবং আমার কথা ফিরাইয়া লইতেছি।....... বক্তৃতার শুরুতেই আমি বলিয়াছিলাম আমার উর্দু দুর্বল।...ইংরেজী বক্তৃতায়ও মুখ ফসকাইয়া যায় কেননা আমি তো মানুষই ..…. আমি আমাকে আলেম-এ দ্বীন বা মুফতি মনে করি না, দ্বীনের প্রচারক (মুবাল্লেগ) মনে করি।"

নিজের ভুলের জন্য "স্যরি" বলার সাহস অনেকে থাকেনা, এর জন্য তাঁর প্রশংসা প্রাপ্য। বয়সের মুরুব্বী যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে সুবিশাল ভারতবর্ষের অসংখ্য মাওলানাদের শ্রদ্ধাপুরুষ মওলানা ওয়াহিদ উদ্দিন। ড: নায়েককে নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে বিশ্বময় বহু মুসলিম ও ইমাম তাঁকে কাফের ফতোয়া দিয়েছে সেটাও ঠিক হয়নি, বলেছেন এই বর্ষীয়ান নেতা:- 
 

ইন্টারনেটে তাঁর অনেক সমালোচনা আছে যার কিছু যৌক্তিক কিছু নয়। এরকম একটা হলো "৫ মিনিটে ২৫টি ভুল"।

এর ওপর তাঁর সংগঠন থেকে বক্তব্যে পেশ করা হয় যাতে সৎভাবেই দেখানো হয় কিছু জায়গায় তাঁর আংশিক বা পুরোটা ভুল হয়েছে বাকি সব সঠিক। আরেকটা মারাত্মক ভিডিও আছে তাঁর যাতে যিনি ইসলামে বন্দীনি-ধর্ষণ সমর্থন করেছেন হাস্যকর কুযুক্তিতে। (এটা মৌদুদীও করেছেন তাঁর 'তাফহীমুল কুরআন' বইতে সূরা নিসা আয়াত ২৪-এর ব্যাখ্যায়)। তাঁর ভিডিও :- 
 

স্পষ্টতঃই, তিনি ঐ ধরণের আয়াত অতিক্রম করে কোরান কি পদ্ধতিতে দাসত্ব উচ্ছেদ করেছে সেখানে পৌঁছন নি। এখানেই তাঁর সীমাবদ্ধতা। তিনি বক্তা ও তার্কিক, দার্শনিক নন। এবং সাধারণত: তর্কটাও তিনি করেন সাধারনেরই সাথে। ড: উইলিয়াম ক্যাম্বেল-এর সাথে তর্কে তিনি চটকদারভাবে কোরানে 'ওয়াটার সাইক্ল' "প্রমাণ" করেছেন অজস্র আয়াত আউড়িয়ে যা হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। 'ওয়াটার সাইক্ল' দেখানো কোরানের কাজ নয়, কোরানের কাজ হেদায়েত করা। ইসলাম বিরোধী তিনজন বিখ্যাত লোকের মধ্যে আছেন ড: আলী সিনা যিনি আয়াতুল্লা মোতাহহেরী সহ অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞের সাথে বিতর্ক করেছেন। তিনি ড: নায়েককে বিতর্কের প্রস্তাব করেছিলেন লেখালেখির মাধ্যমে। ড: নায়েক রাজী হয়েছিলেন এক শর্তে, বিতর্কটা হতে হবে উন্মুক্ত কোনো মিলনায়তনে দর্শকের সামনে। অর্থাৎ উনি ঝড়ের বেগে অজস্র উদ্ধতির বন্যায় প্রতিপক্ষকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন আর দর্শক (যারা তাঁরই মন্ত্রমুগ্ধ ভক্ত) হাততালির সাইক্লোনে ছাদ ফাটাবেন যা হয়েছিল ড: ক্যাম্বেলের ক্ষেত্রে। অথচ নিরাপত্তার জন্য ড: সিনা গোপন কোথাও বাস করেন এবং স্মৃতিশক্তি কোনো শক্তিই নয়, যেজন্য আজকাল পরীক্ষাও হয় ওপেন বুক, সামনে বই খুলে রেখে। এজন্যই শেষ পর্যন্ত বিতর্কটা হয়নি, হলে ভালো হতো।

ভারত সরকার উনার টিভি বন্ধ করেছে, পেছনে পোঁ ধরেছে আমাদের সরকার। এই ইন্টারনেটের যুগে কি একটা অদ্ভুতুড়ে সিদ্ধান্ত! ইউ টিউব, ফেসবুক সহ অন্যান্য মাধ্যম আছে না? বরং এই হঠকারী সিদ্ধান্তে উনার প্রচার আরো বেশী হল, উনি নিশ্চয় অট্টহাসি হাসছেন!! তিনি সম্প্রতি ১০টি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের কাছে মানহানীর নোটিশ পাঠিয়েছেন। শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাসে তিনি সতর্ক, খুব সতর্ক। তাই তাঁকে জঙ্গী সংক্রান্ত আইনে ফেলা যাবে না। ওদিকে "জাকির নায়েকের মুন্ডুচ্ছেদ করলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা হিন্দু নেত্রীর"-এই “নেত্রী” এখনো জেলের বাইরে কেন? 
 

ড: নায়েক নায়ক নাকি খলনায়ক সে প্রশ্ন অবান্তর কারণ সব নেতাই ভক্তের কাছে নায়ক ও বিরোধীদের কাছে খলনায়ক। তিনি রাজনৈতিক ইসলামের সমর্থক, এখানেই তাঁর সাথে আমাদের সংঘাত। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা এক প্রচণ্ড শক্তি কিন্তু তা শুধু বক্তৃতা বিতর্ক হাততালিতে আটকে আছে। অথচ তা দিয়ে তিনি মুসলিম সমাজের অনেক অনাচার অত্যাচার দুর করতে পারতেন কিন্তু করেন নি। এ যেন, আপনি সাঁতার জানেন কিন্তু চোখের সামনে একটা বাচ্চা পানিতে ডুবে মরছে কিন্তু আপনি তাকে বাঁচালেন না। যেমন, বাংলাদেশে অনেকেই জানেন না ভারতে তাৎক্ষণিক তালাকের শিকার হন অসংখ্য নারী। এ নিয়ে মুসলিম নারীরা আন্দোলন করছেন, টিভিতে নিয়মিত জোরালো টক শো হচ্ছে কিন্তু তাদের ঘাড়ে চেপে আছে "সর্বভারতীয় মুসলিম পারিবারিক আইন বোর্ড"-এর কিছু স্বঘোষিত মোল্লা-মুফতি। তারা ঐ আইনীকেই ইসলামী বলে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এটা উচ্ছেদের তীব্র বিরোধীতা করছে। এদিকে সরকারও মুসলিম ভোট হারানোর ভয়ে এ আইনে হাত দিতে চায় না। তিনি তো তাৎক্ষণিক তালাকের বিরোধী, সেই তিনি যদি এর শিকার কোনো নারীকে মঞ্চে কিংবা টিভিতে এনে বার কয়েক জোরালো প্রতিবাদ করতেন তাহলে ইসলামের নামে এই দানব উচ্ছেদ হয়ে যেত কিংবা অগ্রগতি হত। তাঁর সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ঐ মোল্লা-মুফতিদের নেই।

তথ্য যদি তত্বে উত্তীর্ণ না হয়, তত্ব যদি জ্ঞানে উত্তীর্ণ না হয় এবং জ্ঞান যদি কর্মের মাধ্যমে সমাজের মঙ্গল সাধনই না করল তবে সে তথ্যে লাভ কি?

লেখক: সদস্য – ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস উপদেষ্টা বোর্ড সাধারণ সম্পাদক- মুসলিমস ফেসিং টুমরো- ক্যানাড

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত