‘শাহবাগের শিক্ষা ভুলে গেলে বিপদে পরবেন’

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০১৬, ১১:৫০

(১) 
খসড়া আইনটা দেখেছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬এর খসড়া। আমার তরুণ বন্ধু নির্ঝর মজুমদার খসড়া আইনটি দিয়েছেন। নির্ঝর আপনি এই খসড়া আইনটি দিয়ে আমার ছুটির দিনের সকালটার বারটা বাজিয়ে দিলেন। আমি বুঝতে পারছি না- আমার কি এখন ক্রুদ্ধ হওয়া উচিৎ? হতাশ? বিরক্ত? নাকি অসহায় বোধ করার সময় চলে এসেছে?

যারা জেনোসাইড ডিনায়াল প্রতিরোধে আইন চেয়েছেন, আপনারাও মেহেরবানী করে খসড়াটা দেখে নেন। এই যে খসড়া আইনটা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, এই আইনটা দিয়ে আপনার দাবী পূরণ হচ্ছে না। ১৯৭১ সনে জেনোসাইড অস্বীকার করলে, বা জেনসাইডের ধরন প্রকৃতি বা আকৃতি নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে বা এগুলিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করে তাইলে যেন একটা শাস্তি হয় এই বিধানই তো আপনি চেয়েছেন? নাকি? মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ্য শহীদের সংখ্যাটিকে যদি কেউ অস্বীকার করে তার জন্যে এই আইনের অধীনে সরাসরি বিশেষ কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি।

আমি আপনাকে বলে দিই- কেউ যদি বলে যে ‘হ্যাঁ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, অবশ্যই সেটা মুক্তিযুদ্ধ ছিল, মহান ব্যাপার, কিন্তু সেখানে মৃতের সংখ্যা লাখ খানেকের বেশী হবেনা’, এই আইনের অধীনে সেই ব্যাক্তির কোন অপরাধ হবে না। কেউ যদি একটু আক্যদা করে বলে যে, ‘না, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কোন নারীর উপর উল্লেখযোগ্য সেরকম কোন অত্যাচার হয়না’ সেই ব্যক্তি এই আইনের অধীনে কোন অপরাধ করলেন না।

সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার যেটা- কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতন বা এইসবের ধরন প্রকৃতি এইগুলি নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বিশাল গ্রন্থ রচনা করে বা খবরের কাগজে প্রবন্ধ লেখে বা বক্তৃতা দেয় সেক্ষেত্রে এই আইনের কোন প্রয়োগই নাই। এই আইনের প্রয়োগ কেবল ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত কথার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

(২) 
দিন তিনেক আগে আমি আমার বন্ধুদের ফেসবুকে আনন্দের প্রকাশ দেখেছি। যেই বন্ধুরা জেনোসাইড দিনায়াল আইন চেয়ে আন্দোলন করেছেন, দুঃখিত। এই আইনে আপনার জন্যে কিছুই নাই। আপনি ভুল করে আনন্দিত হয়েছেন।

আগে দেখেন আইনটাতে কি আছে। খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৫(৫) ধারায় বলা হয়েছেঃ “কোন ব্যক্তি যদি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিষয়াবলী বা জাতীর পিতার বিরুদ্ধে যেকোন প্রকার প্রোপাগান্ডা, প্রচারণা বা তাহাতে মদদ প্রদান করে” তাইলে সেই ব্যক্তি ডিজিটাল বা সাইবার সন্ত্রাসী অপরাধে অপরাধী হবে।

জাতীর পিতার প্রসঙ্গ আলাদা করে বলি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিধানগুলি দেখেন। অপরাধ হবে কখন? যখন কোন ব্যক্তি-
- ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে 
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা 
- আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিষয়াবলী নিয়ে 
- যেকোন প্রকার প্রোপাগান্ডা, প্রচারণা করে বা তাতে মদদ প্রদান করে 

এখানে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলি আলাদা করে ডিফাইন করা হয়নাই।

তাইলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? ঐ যে উপরে কয়েকটা উদাহরণ দিয়েছি- একজন ব্যক্তি খবরের কাগজে লিখে বা বই ছাপিয়ে যা ৭১এর জেনোসাইড সম্পর্কে যা খুশী তাই বলতে পারবে। অপরাধ হবে না। আর এই প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা এইসবে মানে কি? সেটা বলে দিতে হবে না? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আওতায় কি পড়বে আর কি পড়বে না সেগুলির একটা নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য বলে দিতে হবে না?

আমার তো ধারনা সরকার আসলে ডিজিটাল সিকিউরিটি সংক্রান্ত আইনে ইচ্ছা করেই এই বিধানগুলি অস্পষ্ট আকারে ঢুকিয়ে দিয়েছে যেন এইসব আইন দেখিয়ে আপনাকেও বোকা বানানো যায় আর ইচ্ছা মত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে ওদের হেনস্থাও করা যায়।

(৩)
সরকার এটা ইচ্ছা করেই করেছে। মনে রাখবেন সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে লেজিসলেটিভ উইং নামে একটা উইং আছে। সেখানে একজন সচিব সহ বেশ বড়সড় একদল দক্ষ আমলা আছেন, যারা লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং জানেন। এদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং বা আইন কিভাবে মুসাবিদা করতে হয় সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। এই উইং এর বাইরেও জজ সাহেবদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এরা উত্তমরূপে জানেন কিভাবে আইন লিখতে হয়।
আইন লিখতে গেলে প্রথমেই খেয়াল রাখতে হয় কি বিষয় বা পরিস্থিতি প্রস্তাবিত আইনটির আওতায় আনা হবে আর কি কি বিষয় এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হবে। দেখতে হয় দেশে বর্তমানে প্রচলিত যেসব আইন আছে, সেইসব আইনে একইরকম বিষয়ে কোথায় কি আছে। সেইসব আইনের কোনটা সংশোধন করতে হবে কিনা বা বাতিল করতে হবে কিনা। এইসব নানান দিক বিবেচনা করে আইনটা যখন লেখা হবে তখন লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আইনের প্রতিটি শব্দ সুস্পষ্ট হয় এবং সুনির্দিষ্ট হয়।

আইনের সুনির্দিষ্ট হওয়া আর সুস্পষ্ট হওয়া জরুরী। একজন নাগরিক যখন আইনটি পড়বে যে যেন বুঝতে পারে তার কি করা জায়েজ আর কোনটা জায়েজ না। সাধারণ নাগরিক যদি নাও বুঝে, একজন উকিল যেন আইনটা পড়ে তাকে সুনির্দিষ্টভাবে পরামর্শ দিতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত যখন আইনটা জজ সাহেবদের সামনে যাবে, তখন জজ সাহেবেরা যেন স্পষ্ট করে বুঝতে পারেন আইন প্রণেতারা আসলে কি চাইছেন। আইন লেখার এই যে সাধারণ কতোগুলি নিয়ম এটা সকল উকিল সাহেবেরাও জানেন। সরকারের যারা আইনের মুসাবিদা করেন উনারাতো আরও ভাল করে জানেন, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের উদাহরণসহ বিস্তারিত জানেন।

(৪) 
সুতরাং এই আইনটা যে জেনোসাইড ডিনায়াল ঠেকাতে পারবে না এই কথাটা উনারা বুঝতে পারেন নাই সেরকম ভাবার কোন কারণ নাই। যুক্তিসঙ্গত অনুমান হচ্ছে সরকার ইচ্ছা করেই এইরকম একটা অস্পষ্ট বিধান ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কেন? সম্ভবত সরকার চাইছে যে সাপন যেন না মরে আর লাঠিটাও যেন অক্ষত থাকে। তাইলে লাঠি দেখিয়ে সাপকে সব সময় ভয় দেখানোও যাবে আর আমরা যারা সাপের ভয়ে ভীত আমাদেরকেও আশ্বস্ত করা যাবে।

জেনোসাইড ডিনায়াল রোধে যদি আইন করতে চান, তাইলে স্পষ্ট করে সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা একটি আইনে এর বিধানাবলি প্রণয়ন করেন। ডিজিটাল এনালগ ইলেকট্রিকাল ইলেক্ট্রনিক যে কোন ক্ষেত্রেই যে এই আইনের প্রয়োগ হয়। আবার সেই সাথে সতর্কতাও রাখতে হবে। এই আইন যেন ইন্টেলেকচুয়াল রিসার্চ বা সদুদ্দেশ্যে পরিচালিত স্টাডি না আলোচনা বিঘ্নিত না করে। স্বাভাবিক মতবিনিময়, প্রকৃত কৌতূহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপন সেগুলি যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। রিসার্চ স্টাডি আলোচনা প্রশ্ন এইসবে পথ খোলা রাখতে হবে।

ভুললে চলবে না। বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা, স্টাডি, আলোচনা প্রশ্ন ইত্যাদি আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়ের সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনাগুলি সম্পর্কে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে আমদের অহংকার আমাদের শোক আমাদের ক্রোধ আমাদের ভালোবাসা আমাদের ঘৃণা এইসব কিছুই আমাদের পর আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে যাবে সেখান থেকে ওদের ছেলেমেয়েদের কাছে। আপনি যদি কঠিন আইন করতে গিয়ে চর্চাই বন্ধ করে ফেলেন তাইলে তো সেই পথ বন্ধ করে দিলেন।

পৃথিবীর অন্য দেশের জেনোসাইড ডিনায়াল আইনগুলি দেখেন। ওদের আইনের সীমাবদ্ধতা জানেন। সেইসব আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে ওদের কি অভিজ্ঞতা হয়েছে সেই শিক্ষাটা জানেন। এরপর আলাদা করে একটা আইন করেন। কতদিন লাগবে? তিন মাস? ছয় মাস? নয় মাস? আমরা অপেক্ষা করবো। কিন্তু মেহেরবানী করে আমদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না।

এই প্রজন্মকে আপনি নয় ছয় দিয়ে বুঝাতে পারবেন না। শাহবাগের শিক্ষা ভুলে গেলে বিপদে পরবেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত