বঙ্গবন্ধু অনেক বড় মাপের জিনিস

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০১৬, ১০:৪৫

(১) 
ভাই আওয়ামী লীগ করেন ভাল কথা। আওয়ামী লীগ করা কোন অপরাধ না। আওয়ামী লীগের ভাল মন্দ যে কোন কাজকেই সমর্থন করার পণ করেছেন, সেটাও ভাল কথা আপনার ইচ্ছা, আপনি করেন। আওয়ামী লীগের কোন সমালোচনা করলে প্রতিবাদ করেন, সেটাও ভাল, আপনি দলের ইয়ে হয়েছেন, করবেনই তো। কিন্তু কথা বার্তায় খানিকটা তো যুক্তি বুদ্ধি থাকতে হবে আরকি। থাকতে হবে না?

এই যে খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বঙ্গবন্ধুর সুনাম রক্ষার উদ্দেশ্যে একটা বিধান ঢুকিয়েছে সরকার, এই বিধানটা তো মন্দ। খুবই মন্দ। এইটাকে যখন আমরা মন্দ বলি আপনারা আপনার তেড়ে আসেন- জাতীর পিতার বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াবে আর আমরা ছেড়ে দিব? কেউ কেউ আবার ইমোশনাল কার্ড খেলেন। বড় বড় চোখে ছলছলে ভেজা দৃষ্টি এনে ধরা গলায় বলেন- পিতাকে অপমান করা হবে আর আমরা সন্তান হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখব?

ভাইসব, বঙ্গবন্ধুকে কেউ অন্যায্য কটূক্তি করে যাবে সেটা তো সহনীয় কথা না আরকি। এইখানে আমি আপনাদের অনুভূতিটা বুঝতে পারি। কিন্তু আপনি কি আইনের খসড়াটা পড়ে দেখেছেন? আইনটা পড়লে তো মতলবটা ভাল ঠেকে না। খসড়াটা দেখেছি। এই খসড়া আইনের ১৫(৫) ধারায় বলা হয়েছেঃ "কোন ব্যক্তি যদি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিষয়াবলী বা জাতীর পিতার বিরুদ্ধে যেকোন প্রকার প্রোপাগান্ডা, প্রচারণা বা তাহাতে মদদ প্রদান করে" তাইলেই তাকে ১৪ বছর পর্যন্ত জেলে রাখা যাবে।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অংশের কথা ভিন্ন পোস্টে বলেছি। বঙ্গবন্ধুর অংশটা দেখেন। বলা হচ্ছে 'জাতীর পিতার বিরুদ্ধে যেকোন প্রকার প্রোপাগান্ডা, প্রচারণা বা তাহাতে মদদ প্রদান' হলেই নাকি অপরাধ।

(২) 
এইটা কোন কথা হলো? বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে কোন প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা করলেই সেটা অপরাধ হয়ে যাবে? আপনারা যে বলছেন কুৎসা কটূক্তি অবমাননাকর কথাবার্তা ইত্যাদি সেইসব শব্দ থাকলেও না হয় বুঝতাম। কিন্তু আইন তো বলছে 'যে কোন প্রোপাগান্ডা'। ভাই প্রোপাগান্ডা মানে কি? প্রচারণা মানে কি? এইসবও তো ডিফাইন করা নাই।

এই আইনটা যে কত ভয়াবহ হতে পারে আপনি একবার ভেবে দেখেন। শুদ্ধ রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণেও এই আইনের অধীনে যে কোন লোককে সাজা দেওয়া যাবে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর পক্ষের লোকেরাও এই আইনের অধীনে জেলে যেতে পারে। উদাহরণ দিই। নিজের উদাহরণই দিচ্ছি।

আমি নিজে বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী। আমার ছোট ভাই ফিরোজ আহমেদ এইস যেদিনও খোঁচা দিয়ে বলেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে নাকি অনেক জ্ঞানী ব্যাক্তিও বঙ্গবন্ধুর দোষ দেখতে পায়না। আমি কিছু বলিনাই। ভেবেছি আচ্ছা থাক, বলুক। (অন্ধ বললেও আগে জ্ঞানী তো বলেছে হাঃ হাঃ হাঃ)। কিন্তু আমি নিজেও বঙ্গবন্ধুর অনেক সমালোচনা করি। গালি দেওয়া বা কটু বাক্য বলা নয়, শ্রদ্ধার সাথেই রাজনৈতিক মতপার্থক্য। বাকশালের সময় খবরের কাগজ বন্ধ করে মানুষের কথা বলার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া- এটা আমার একটা সমালোচনার জায়গা।

এখন আমি যদি ফেসবুকে বলি যে বাকশালের সময় খবরের কাগজ বন্ধ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু কেবল রাজনৈতিক ভুলই করেননি, তিনি মানুষের অধিকারেও হস্তক্ষেপ করেছেন, তাইলে কি হবে? মনে করেন প্রচারণা আকারেই বললাম। এই আইন পাস হলে এই কথাটির জন্যেই তো আমার ১৪ বছর জেল হতে পারে। তাইলে? কাজটা ঠিক হবে? বলেন।

(৩) 
এইরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। কোন ছেলে যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা কার্টুন পোস্ট করে তাইলেও জেল। কেউ যদি টেলিভিশনে বলে যে ৭১এর মার্চের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর ইউনিলেটারেল ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স দিয়ে দেওয়া দরকার ছিল, তাইলে?

আমাদের দেশে একটা গ্রুপ আছে যারা আওয়ামী লিগেরই সমর্থক, বঙ্গবন্ধুর প্রতি ওদের আনুগত্য কম নাই, কিন্তু ওরা মনে করে যে তাজউদ্দীন আহমেদকে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে বঙ্গবন্ধু ভুল করেছেন এবং দেশেরও ক্ষতি করেছেন। এই ধরনের কথাবার্তা আপনি ফেসবুকে মাঝে মাঝেই দেখবেন। এদেরকে ধরে ধরে জেলে নিয়ে যাবেন?

আরেকদল লোক আছে যারা মনে করে যে মওলানা ভাসানিকে আমরা জাতী হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছিনা। ওরা মাঝে মাঝেই বঙ্গবন্ধু আর মওলানা ভাসানির সাথে তুলনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নানারকম কথা বলে। কথাগুলি ভুল বটে, কিন্তু এগুলি ওদের সৎ রাজনৈতিক মতামত। ওদেরকে জেলে নিয়ে যাবেন?

আমার তো সমালোচনার অধিকার আছে। খোদ প্রফেটকেও কেউ সমালোচনা করতে পারে। সেইসব ওঠা বাদই দিলাম। এমন আইন করেছেন, যেখানে ভাল কথা বললেও জেলে যেতে হবে- শুধু 'বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে' গেলেই হবে। এইটা কি ভাই? আপনি এই আইন সমর্থন করেন? পছন্দ করেন? এই আইন হয়েছে বলে উল্লাস করবেন?

(৪)
আরে ভাই এই আইন দিয়ে তো আপনারা বঙ্গবন্ধুকে আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দেবেন। চিন্তা করেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যদি কিছু বলা না যায় তাইলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষেও ভবিষ্যতে লোকে কিছু বলবে না। বঙ্গবন্ধু আলমারিতে ধুলার নিচে ঢাকা পরে যাওয়া অপাঠ্য ইতিহাস বইয়ে আটকে থাকবেন। মনে রাখবেন, যাকে নিয়ে আলোচনা করা যায়না তাঁকে মানুষ মনে রাখে না। কেউ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই লিখবে না। কেননা কেবল স্তুতি করে তো আর বই লেখা যায় না। আর যদি স্তুতিবাক্যে ভরে বই লেখেনও, সেটা কেউ পড়বে না। গবেষণা হবে না, আলোচনা হবে না। কেননা 'বিরুদ্ধে' কিছু বললে জেলে যেতে হতে পারে এইরকম ইস্যু নিয়ে কে গবেষণা করবে?

আবার বলি, সবিনয়ে জোর হস্তে বলি- মেহেরবানী করে বঙ্গবন্ধুকে নিচে নামাবেন না। বঙ্গবন্ধু অনেক বড় মাপের জিনিস। তিনি আপনার আমার চেয়ে অনেক অনেক অনেক শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছেন। জীবিত কালেও বঙ্গবন্ধুর বা বাংলার মাটির গভীরে প্রোথিত ছিল, এখনো আছে। বাঙালীর হৃদয়ে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হতে পারে, বঙ্গবন্ধু কখনো হারাবেন না। বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করবে সেই ক্ষমতা ঈশ্বরেরও নাই। এইসব হাস্যকর আইন কেন বানাচ্ছেন? বৈরি প্রোপাগান্ডা থেক বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে হবে এই আইডিয়া আপনাদের মাথায় কি করে এলো? আপনারা রক্ষা করবেন বঙ্গবন্ধুকে? হাহ। এইসব কথা ভুলে যান। বঙ্গবন্ধুই আপনাদেরকে রক্ষা করছেন।

বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দেবেন না। বঙ্গবন্ধু জনগণের নেতা ছিলেন, জনগণের নেতা আছেন। জনগণ ওদের নেতাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে, সমালোচনা করবে, বিরোধিতা করবে। এইগুলি সবই জীবনের অংশ।

(৫) 
আর এইরকম একটা উদ্ভট আইনের যারা সমরহতন করছেন এবং এতে উল্লাস প্রকাশ করছেন। প্লিজ, একটু ভাবনা চিন্তা করেন। আপনি যেকথা ভাবছেন- কটুবাক্য কুৎসা ইত্যাদি- সেসবের জন্যে ই আইন হয়নি। দৃশ্যতই এই আইন হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম থেক রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করার জন্যে।
পড়েন, পড়ে বলেন। নিতান্ত ইয়ে* না হলে কেউ এই আইন সমর্থন করবেন না।
(*দলদাসই বলতাম, কিন্তু আমার বন্ধুরা দলদাস বললে রাগ করেন)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত