গালি দেওয়াটা খুবই স্থূল রুচির ব্যাপার

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২০:১৬

(১) 
গালি জানি। ভয়ংকর সব গালি তো ছোটবেলা থেকেই জানি। কিন্তু পারিবারিক ইয়ের কারণে সেগুলি মুখে উচ্চারণ করতে পারিনা। গালি দেওয়াটা খুবই স্থূল রুচির ব্যাপার। সত্তরের দশকে বা তার আগে বাঙালী মধ্যবিত্তের মধ্যে এইরকম স্থূল রুচির ব্যাপারগুলি থেকে বাচ্চাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার প্রবণতা ছিল। এখনো অনেকের আছে- একটু হয়তো রকমফের হয়েছে- কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে এখনো 'রুচি' কথাটা চালু আছে। চট করে যারা গালাগালি করতে পারে তাদের সাংস্কৃতিক মান এখনো আমাদের সমাজে নিচু বলেই বিবেচনা করা হয়।

স্থূল রুচির ব্যাপারটা কিভাবে মাথায় ঢুকে বসে আছে সেটা বলি। ছোটবেলায় আমরা ভাই বোনেরা মিলে নিজেরাই দেওয়াল পত্রিকা বের করতাম। খুবই বালখ্যিল্য ধরনের কাজ। তবু একটা বড় মোটা কাগজে এটা সেটা লিখে নিজেদের বাসায়ই কোথাও ঝুলিয়ে রেখে আমরা 'বিশাল একটা কিছু করে ফেলেছি' ধরনের আনন্দ পেতাম। খুব বেশী যে বের করেছি সেরকম না। চকরিয়ার এক থানা শিক্ষা অফিসার চাচা এই আইডিয়াটা দিয়েছিলেন। চকরিয়া আর টেকনাফে থাকার সময় তিনবার বা চারবার এইরকম দেওয়াল পত্রিকা করেছিলাম।

টেকনাফে এইরকম এক দেয়ালিকায় একটা কৌতুক পোস্ট করেছি, সেখানে বায়ু ভাঙার একটা ব্যাপার ছিল। এই বায়ু ভাঙার কৌতুকটা পড়ে আমার পিতা একটু হেসে ঠোঁট বাঁকা করে বলেছিলেন, 'স্থূল'। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন। সেই যে এই 'স্থূল' শব্দটা মাথায় ঢুকে গেছে- এখনো মাথার কোন এক কোনার কোনায় যেন সেটা রয়েই গেছে। ফল যেটা হয়েছে, আমরা ভাই বোনেরা গালি আর দিতে পারিনা।

গালি জানি। জানবো না কেন। আপনি যেসব গালি জানেন সেগুলি আমি জানবো না সেরকম ভাবার কারণ নাই। কারণ আমি গালি না দিলেও আমাকে তো কেউ না কেউ গালি দিয়েছে। আর আমার চারপাশে লোকে একে অপরকে গালি দিচ্ছে না? দিচ্ছে তো। সেগুলি শুনি। গালি অভিধান যোগাড় করে গালির অর্থ, গালিগুলির ব্যুৎপত্তি সেগুলিও জানার সুযোগ নিয়েছি। জানি। কত ভয়ংকর গালি যে জানি তার একটা নমুনা এই পোস্টের শেষে দিব।

(২) 
আমার পিতা গালি পছন্দ করতেন না। আমার মাও সেরকম গালি দিতে দক্ষ না। আমরাও গালিগালাজ করতে পছন্দ করিনা। সেই ছোটবেলা থেকেই। একটু বড় হওয়ার পর গালি দেওয়া আরও কঠিন হয়ে গেল। কেননা ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছি যে মানুষই হচ্ছে শেষ কথা। মানুষের জন্যে মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই। তাইলে মানুষকে আমি গালি দিব কি করে। ঢাকায় আসি মাঝে মাঝে বেড়াতে। মফস্বল থেকে এসে ঢাকার মানুষের কথাবার্তা বোলচাল চলাফেরা এইসবে মুগ্ধ হই, চমকে যাই। দুইদিন আগে অপু ভাই আমাদের রাঙ্গামাটি থাকার সময়ের একটা পুরানা ফটো পোস্ট করেছেন। সেখানে নিজেকে দেখে আমি নিজেই হেসে উঠেছি- মহা মুশকিল- একদমই তো মফস্বলি খেত।

ঢাকায় দেখতাম ভদ্রলোকেরা একে অপরকে ভদ্রভাষায় গালি দেয়, 'বস্তির লোক' 'বস্তির মেয়েমানুষ' 'রিকশাওয়ালা'। আমি লজ্জায় মরে যাই। এগুলি আবার কি গালি? বস্তিতে থাকা তো নিচু কিছু না। রিকশাওয়ালা আবার গালি হয় কি করে? তারচেয়ে চোর বলতেন বা ঘুষখোর বলতেন। সেগুলি বরং অপমানজনক গালি হতে পারে। আমাকে কেউ রিকশাওয়ালা বললে আমি কেন রাগ করবো? কি আশ্চর্য, এইরকম গালির কি অর্থ আছে?

আর ইতিমধ্যে নারীর প্রতি বৈষম্য বুঝতে শিখেছি। ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। জেনেছি যে নারী দুইভাবে নির্যাতিত। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণীবৈষম্যের শিকার তো নারী পুরুষ দুইজনই। নারী আবার কেবল নারী হিসাবেই আলাদাভাবে নির্যাতিত। কোথায় যেন পড়লাম গালিগুলি পুরুষতান্ত্রিক, সব গালিতেই নারীকে ছোট করা হয়। নিজের মনেই একেকটা গালি ধরে ধরে পরীক্ষা করে দেখলাম। আসলেই তো! প্রায় প্রতিটা গালিই কোন না কোনোভাবে নারীকেই অবমাননা করে। নিতান্ত নির্দোষ মনে করে বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যে একে অপরকে শালা বলে গালি দিতাম- সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।

আপনিও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। নারীকে অবমাননা না করে কাউকে গালি দেওয়া খুবই কঠিন- প্রায় অসম্ভবই বলতে পারেন। নারিনিরপেক্ষ যে অল্প কয়েকটা গালি আছে, সেগুলি ব্যাবহার করে আবার সেরকম জোশও আসে না।

(৩) 
চোখের সামনে ভয়ংকর গালিবাজি প্রথমবার দেখেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে। আমি থাকতাম শাহজালাল হলে। মাত্র কয়েকদিন হয় গেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ৩২৪ নম্বরে একরাম ভাইয়ের রুমে থাকি। শাহজালাল হলের উল্টাদিকে শাহ্‌ আমানত হল। একদিন রাতের বেলা বিদ্যুৎ চলে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে দুই হলের মধ্যে শুরু হয়ে গেল গালিযুদ্ধ, সেই সাথে থালা বাটি পিটিয়ে আওয়াজ। আমি ভাবলাম না জানি কি হয়েছে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমাদের পাশের রুমের নিতান্ত নিরীহ ভদ্রলোক ধরনের সিনিয়র ভাইটাও শাহ্‌ আমানতের সকলের পরিবারের সকলের সাথে প্রেম করতে চাইছে।

এইরকম চললো যতক্ষণ বিদ্যুৎ না আসে ততক্ষণ। সেই বিদ্যুৎ এসেছে, সব বন্ধ। সকলে ভদ্রতার চেহারা ফিরিয়ে এনে যার যার রুমে। আমার হা হয়ে যাওয়া মুখ দেখে একরাম ভাই আমাকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন যে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নাই, এটা এখানে নৈমিত্তিক ঘটনা।

তার কিছুদিন পরে শিবিরের সাথে মারামারি লেগেছে। এইখানে বলে রাখি, আমরা কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সেই মারামারিতে যোগ দিব বলে দৌড়ে দৌড়ে এফ রহমান হলের সামনে গেছি। এফ রহমানের ভিতরে শিবিরের ছেলেরা ইট পাটকেল কিরিচ বোমা বন্দুক এইসব নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। বাইরে ছাত্র লীগের আর জাতীয় ছাত্রলীগের ছেলেরা আর আমরা দুই চারজন ছাত্র ইউনয়নের কর্মী যোগ দিয়েছি। জাসদের বিভিন্ন গ্রুপের কয়েকজনও সম্ভবত ছিল। অবরোধ চলছে সকাল থেকে।

এফ রহমানের সামনে- আলাওল এফ রহমানে মাঝামাঝি একটা চায়ের দোকান ছিল, সেই চায়ের দোকানটার কোনায় আমরা দাঁড়িয়েছি। আমার সাথে ছাত্র ইউনিয়নের সম্ভবত সালাহুদ্দিন ছিল, আর কেউ ছিল কিনা মনে নাই। আর একদল ছাত্রলীগের মারপিট করা টাইপ ছেলে। পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, শিবিরের ছেলেরা বের হলেই ওদেরকে মার শুরু করবো। শিবিরের ছেলেগুলি আর বের হয়না। হলের কোনায় কোনায় দাঁড়ানো শিবিরের সন্ত্রাসীগুলি দাঁড়ানো, দেখতে পাচ্ছি।

দুই তিনঘণ্টা এইরকম অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছি- এই দুই তিনঘণ্টা ধরে ক্রমাগত উচ্চকণ্ঠে ছাত্রলীগের কয়েকটি ছেলে এফ রহমান হলের দিকে মুখ করে বিরামহীন গালি বর্ষণ করে যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে। বিরামহীন মানে আসলেই বিরামহীন। সেই গালির যে ধরন আর তীব্রতা, তাতে মানুষ তো বাদই দিলাম, বিল্ডিঙের গায়েও আগুন লেগে যাওয়ার কথা।

(৪) 
নিজেকে ভাল মানুষ দেখাচ্ছি- বলছি আমি গালি দেইনা। কথাটা সত্যি। খুব একান্ত বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায় নানারকম মন্দ কথা যে বলি না তা নয়। কিন্তু অন্যকে গালি আমি সাধারণত দিই না। ঐ যে বলেছি, গালি দেওয়া স্থূলতা, মানুষকে অপমান করা আর নারীকে হেয় করা। গালি কি করে দেই? কিন্তু গালি শুনতে পাই, আর ফেসবুকের কল্যাণে পড়তেও পাই।

আশেপাশে অনেককে গালি দিতে দেখি। বয়স্ক লোক, ভাল কাপড় চোপড় পরে। মোটা বেতনের চাকরী করে, আবার চাকরী ছাড়াও নানারকম ইনকাম আছে। স্বচ্ছল লোক। বিজ্ঞের মত কথা বলে আর কথা বলতে গিয়ে পদে পদে মূর্খতা ঠিকরে ঠিকরে বের হয়। সেই মূর্খতা যখন আপনি ধরিয়ে দিবেন, আপনাকে এমনসব গালি দিতে থাকবে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। ইংরেজিতে bigot বলে একটা কথা আছে না, সেই ধরনের লোক। ওদের মধ্যেও অতি নিম্নমানের- কেননা বিগটরি করারও তো একটা ভদ্র কায়দা আছে আরকি। এইসব লোকের আবার ঐ লেভেলের বিদ্যা বুদ্ধিও নাই যে বিগটরিটাও ভদ্রভাবে করতে পারবে।

ফেসবুক হয়েছে বলে এগুলি লোকের গালিও দেখতে পাই। দেখি আর হাসি। মনে মনে বলি, ওরে তুই যে একটা অন্যটি নিকৃষ্ট পচা মাল সেইটা তো আর ঢেকে রাখতে পারলি না। মূর্খতা আর নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি এগুলি হচ্ছে ময়লার গন্ধের মত। পেছনে ময়লা লেগে থাকলে দুর্গন্ধ বের হবেই। দামী সুগন্ধি দিয়ে ঢাকা যায় না। আর এইগুলি লোক তো মনে হয় উঠে এসেছে একদম ময়লার গর্ত থেকে- কোথাকার গন্ধ ঢাকবে? ময়লা তো এদের মগজ পর্যন্ত ঢুকে মগজই পচিয়ে দিয়েছে। দুই চারটা ভদ্র ভাষায় নিন্দা করে ওদের কথা থেকে গন্ধ দুর করতে পারবেন না। তার চেয়ে বরং এদেরকে বর্জন করেন, এদের নিজেদের স্বজাতির সাথে এরা মেলামেশা করুক।

জানি, আপনি এদেরকে বর্জন করলেও এরা আবার ঘোঁত ঘোঁত করে মাঝে মাঝে চলে আসবে। কি আর করবেন। পৃথিবীতে কতরকমের প্রাণী আছে। এগুলিকে কখনো তাড়িয়ে কখনো এড়িয়েই জীবন ধারণ করতে হবে।

টেকনাফে যখন বাস করি, আমাদের বাসার পাশেই পাহাড়। রাতের বেলা পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে হাতি নামতো। আর ঘন ঘন আসতো শুকর আর শেয়াল। হাতি ঠিক আমাদের বাসা পর্যন্ত কখনো আসেনি। দুরে ধানখেত নষ্ট করতো। শুকর মাঝে মাঝেই আমাদের বাগান নষ্ট করে দিত। যতদিন ছিলাম, এইরকম শুকরের অত্যাচার সহ্য করেই বাগান করেছিলাম। কখনো তাড়াতাম, কখনো পারতাম না। শুকরের কাজ শুকর করে।

(৫) 
গালি প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলেই শেষ করি। গালি দেওয়ার এই ব্যাপারটা কিন্তু সারা দুনিয়াতেই আছে। এবং মানুষের ফোকলোরের মত সারা দুনিয়ার গালির মধ্যেও যে কতরকম সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে সেটা দেখলে অবাক হতে হয়। আজকাল তো গালি নিয়ে অনেক স্টাডি হয়, গবেষণা হয়। গালির মনস্তত্ব আছে, গালির দর্শন আছে, আর গালিকে তো সামাজিক বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা প্রতিদিনই হচ্ছে। একবার গালি নিয়ে এইরকম মনোযোগ দিয়ে চার পাঁচটা প্রবন্ধ পড়লাম। তার কিছুদিন পরেই গেছি থাইল্যান্ডে বেড়াতে।

ব্যাংকক শহরের এক মার্কেটে ফিল্টার কিনতে গিয়ে দেখি ক্যাননের দোকানের পাশে একটা ছোট বই আর পেপার ষ্টেশনারীর দোকান। সেখানে পেয়ে গেলাম একটা বই- ছোট একটা পকেট বই- Book of Insult; নানান রকম বিষয়ে ছোট আকৃতির অনেকগুলি বই ছিল সেখানে, আমি কি মনে করে ঐ Book of Insultটাই কিনেছি। সেই বইতে মানুষকে কতভাবে অপমান করা হয়, কিভাবে করা হয় সেইসব কায়দা কানুন ইতিহাস দেওয়া আছে। সেখানে পেয়ে গেলাম এক ভয়ংকর গালি যেটা সাহিত্যের দুনিয়ায় মোটামুটি বিখ্যাত হয়ে আছে।

রোমান জমানার কবি Gaius Valerius Catullus, খৃস্টের জন্মের পঞ্চাশ ষাট বছর আগে ইনি গত হয়েছেন, তাঁকে তাঁর বন্ধু অরেলিয়াস আর আরেকজন খোঁচা দিয়ে 'মাইগ্যা' টাইপের কবি বলেছে। ব্যাস। কবির রাগ আর দেখে কে। তিনি তাঁর বন্ধুকে গালি দিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেললেন। ১১ মাত্রার ছন্দে ১৪ লাইনের কবিতা- ল্যাটিন ভাষায় লেখা। এর ইংরেজি অনুবাদও পাওয়া যায়। কিন্তু ইংরেজি অনুবাদগুলিতে নাকি অশ্লীলতা এড়ানোর জন্যে কবিতার কয়েকটি লাইনকে অনেক শোভন করে দেওয়া হয়েছে। সেইসব শোভন অনুবাদ পড়েই আমার চান্দি পর্যন্ত বিব্রত হয়ে গেছে।

আমি মুল ল্যাটিন কবিতাটার প্রথম দুই লাইন তুলে দিচ্ছি। আপনার যদি ইচ্ছা হয়, গুগল করে এর ইংরেজি অনুবাদ বের করে পড়ে নিতে পারেন।
Pedicabo ego vos et irrumabo,
Aureli pathice et cinaede Furi,

(৬) 
সাম্প্রতিক এই গালিবাজটি অনেক আগে থেকেই গালিবাজ। এর মগজে ঠাসা ময়লা। আগেও দেখেছি। আপনি যদি ওকে চেনেন, ওকে এইসব বন্ধ করতে বলতে পারেন, লাভ হবে না। মগজে ময়লা, মুখ দিয়ে তো ঐ জিনিসই বের হবে। তবে বলে দিতে পারেন, ক্যাটালাস-এর মত কোন এক বাঙালী কবিও দেখবেন ওকে নিয়ে এইরকম এক পিস কবিতা লিখে বসবে। তখন সেও অরেলিয়াসের মত ইতিহাসে অমর হয়ে যাবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত