পাবলো পিকাসো একজন আপদমস্তক শিল্পী
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০১৬, ১০:৫৩
গোয়ের্নিকা, উত্তর স্পেনের শহরতলি। তখন স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলছে। জার্মান বাহিনী বোমা ফেলল ছোট্ট শহরটির ওপর। চারদিকে ধ্বংসের ছবি। আর ধ্বংসের সেই ভয়াবহ চেহারা নিয়ে নিজের স্টুডিওতে ছবি আঁকা শুরু করলেন একজন শিল্পী। শোনা যায়, ছবির কাজ চলার সময় আচমকাই স্টুডিওতে হানা দেয় জার্মানরা। ছবি দেখিয়ে তারা প্রশ্ন করে, ‘কে করেছে?’ উত্তরও ছিটকে আসে, ‘তোমরা।’
চারদিকে ধ্বংসচিত্র, মানুষ চিৎকার করছে, এক মা আলো নিয়ে এগিয়ে আসছেন, কিউবিস্ট ধাঁচ ছবি জুড়ে। এটা তৈরির আগে ছবির মধ্যের বিভিন্ন এক্সপ্রেশনগুলোকে নিয়ে প্রায় দুশোর মতো স্কেচ করেছিলেন পিকাসো। তার অমর সৃষ্টিকর্ম ‘গোয়ের্নিকার’ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
এ ‘গোয়ের্নিকা’ সৃষ্টি হয়েছে যার হাতে তিনি আর কেউ নন, তিনি পাবলো পিকাসো। বিংশ শতাব্দীর সেরা চিত্রকরদের মধ্যে তিনি অন্যতম। জন্মসূত্রে স্পেনীয় হলেও জীবনের একটা বড় অংশ তিনি ফ্রান্সে কাটিয়েছেন। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে উত্তর আধুনিকতার জনক বলা হয় তাকে।
পিকাসো বলেছিলেন, চিত্রশিল্প হলো এমন এক মিথ্যা, যা আমাদের সত্যিকে উপলব্ধি করতে শেখায়। তার এ বাণী যে কতটা বাস্তবসম্মত, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ গোয়ের্নিকা।
পাবলো পিকাসো ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর স্পেনের শহর মালাগায় জন্মগ্রহণ করেন।
পাবলো রুইজ ই পিকাসো (২৫ অক্টোবর ১৮৮১ – ৮ এপ্রিল ১৯৭৩), যিনি পাবলো পিকাসো হিসেবে পরিচিত, ছিলেন একজন স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী, ভাষ্কর, প্রিন্টমেকার, মৃৎশিল্পী, মঞ্চ নকশাকারী, কবি এবং নাট্যকার। বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী শিল্পী হিসেবে তিনি কিউবিস্ট আন্দোলনের সহ-পতিষ্ঠাতা, গঠনকৃত ভাস্কর্যের উদ্ভাবন, কোলাজের সহ-উদ্ভাবন, এবং চিত্রশৈলীর বিস্তৃত ভিন্নতার কারণে অধিক পরিচিতি লাভ করেন। তার বিখ্যাত কাজের মধ্যে রয়েছে প্রোটো-কিউবিস্ট লেস ডেমোইসেরেস ডি’আভিগনন (১৯০৭) এবং স্প্যানের গৃহ যুদ্ধের বিরুদ্ধে আঁকা গের্নিকা (১৯৩৭)।
পিকাসো, হেনরি মাতিসে এবং মার্সেল ডচাম্প এই তিনজন শিল্পী ২০শ শতাব্দীর শুরুতে প্লাস্টিক আর্টে বৈপ্লবীয় উন্নতি সাধনের মাধ্যমে চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, প্রিন্টমেকিং এবং মৃৎশিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটান।
পিকাসো ২০শ শতাব্দীর শিল্পে একজন শ্রেষ্ঠ-পরিচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
২০১৫ সালের ১১ই মে স্পেনের কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর আঁকা 'উইমেন অব আলজিয়ার্স' ছবিটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি শিল্পিকর্মে পরিণত হয়েছিল । নিলামে চিত্রকর্মটি রেকর্ড ১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল । বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৪০ কোটি টাকা । পিকাসোর এ তৈলচিত্রটিতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার করা হয়েছিল । এতে পিকাসোয় সুপরিচিত কিউবিক ধারায় ছাপ রয়েছে । নগ্ন এক রমণীকে সেখানে দেখা গেছে । এটি পিকাসোর ১৫টি শিল্পকর্মের একটি সিরিজের অংশ ।
১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে এটি এঁকেছিলেন তিনি । এটিতে A থেকে O পর্যন্ত ইংরেজি বর্ণমালার ব্যবহার ছিল । নিলামে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হাওয়া শিল্পকর্মের তালিকায় ছিল ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিস বেকন 'Three of Studies of Lusian Froyd' । ২০১৩ সালে নভেম্বরে এটি ১৪ কোটি ২৪ লাখ ডলারে বিক্রি হয় ।
তার আঁকিয়ে জীবনের একটি মজার তথ্য হচ্ছে, পাঁচ-ছ’বছর থেকেই অসম্ভব ভাল ড্রইং করতেন পিকাসো। ওই বয়সের বাচ্চাদের মতো কাঁচা হাতের টান নয়, সাবলীল টানে আঁকা পায়রাদের ছোট ছোট ছবিতে সেনসিটিভ গড়ন ও ভঙ্গি স্পষ্ট। পিকাসো নিজেও বলতেন, ছোটবেলায় তিনি ওল্ড মাস্টারদের মতো আঁকতেন। আর বড় হয়ে শিশুদের মতো।
রাত দশটা-এগারোটা থেকে আঁকা শুরু করতেন তিনি। চলত সারা রাত। একের পর এক অসাধারণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। অসম্ভব জীবনীশক্তি নিয়ে জীবনের শেষ দিন অবধি শিল্পচর্চা করে গিয়েছেন।
নানা পর্যায় রয়েছে তার কাজে। একেবারে গোড়ার দিকে বাস্তবধর্মী ছবি। পরের পর্যায়টি ‘ব্লু পিরিয়ড’। তখন তিনি চরম দারিদ্রের মধ্যে। রেস্তোরাঁয় খেতে আসা রুগ্ন, জীর্ণ চেহারার গরিব মানুষের ছবি আঁকতেন। এ ছবিগুলো ছিল মূলত নীল রঙে আঁকা। তখন থেকেই তিনি পরিচিত হতে শুরু করেন। প্রতিভা স্বীকৃতি পেতে থাকে।
এর পর ‘রোজ পিরিয়ড’। স্প্যানিশ সার্কাসের হার্লেকুইন, কলাকুশলী, ক্লাউন, রিঙের খেলা হয়ে ওঠে তার ছবির বিষয়বস্তু। এই পর্যায়ের ছবিতে দেখি রঙের প্রাচুর্য। পিকাসোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি প্রত্যেক পর্যায়ে তার আগের পর্যায় থেকে সরে এসেছেন, এক-একটা পর্যায়কে ভেঙে আর একটা পর্যায়ে গিয়েছেন। পিকাসোর সৃষ্টিশীলতা ছিল বাঁধনহারা, সব সময়ই নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করতেন। যদিও উনি নিজে বলতেন, ‘আমি কিছু খুঁজি না, আমি পেয়ে যাই।’
পিকাসোর সর্বশ্রেষ্ঠ ছবিগুলির একটি লে দ্যমোয়াজেল দা’ভিয়ঁ (Les Demoiselles d’ Avignon)। তখন আফ্রিকান মুখোশে ভীষণ অনুপ্রাণিত তিনি। অ্যাভিঁয়-র দেহোপজীবিনীরা এ ছবির বিষয়বস্তু। আফ্রিকান মাস্ক-এর প্রভাব ছবিতে স্পষ্ট।
পিকাসোর আর এক বিখ্যাত ছবি ‘উইপিং উওম্যান’। সেই সময় প্রেমিকা ডোরা মার-এর সঙ্গে পিকাসোর বিচ্ছেদ ঘটছে, তিনি অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ডোরা’র কান্নামাখা বিকৃত মুখের ছবি আঁকলেন তিনি।
শুধু ইনিই নন, পিকাসোর জীবনে অনেক মহিলা এসেছেন। এবং প্রত্যেকেই তার শিল্পকাজকে নানাভাবে প্রভাবিত করেন। এদের সংস্পর্শে এসে প্রচুর ছবি তিনি এঁকেছিলেন। অদ্ভুত শিল্পকীর্তির জন্ম দিয়েছিলেন। মারি থেরেস-এর খেলোয়াড়সুলভ চেহারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভাস্কর্য করেছিলেন। শেষ জীবনটা যার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন, সেই জ্যাকেলিন নিজেও ছিলেন পিকাসোর অনেক ছবির মডেল।
পিকাসোর চরিত্র ছিল বর্ণময়। নাটকও লিখতেন, সঙ্গে ছোট ছোট কবিতাও। সিরামিক পট-এর ওপর তার সাবলীল ড্রইং অপূর্ব। ভাস্কর্যগুলোও মোটেই গতানুগতিক ছিল না। নানা ছুটকো জিনিস জোগাড় করে সেগুলো দিয়ে তিনি ভাস্কর্য করেছেন। তার তৈরি ব্রোঞ্জের গর্ভিণী ছাগল বিখ্যাত। সেটার পেটের মধ্যে একটা ঝুড়ি ঢুকিয়ে তিনি এটি তৈরি করেন। আবার, একটা সাইকেলের সিটে সাইকেলের হ্যান্ডেলটা শিং-এর মতো ফিট করে এক লহমায় এনে দেন পশুর মাথার আদল।
এক কথায়, সব কিছুর সঙ্গেই তার আত্মিক যোগ ছিল গভীর। আদ্যপান্ত এক শিল্পীর জীবন তিনি কাটিয়ে গিয়েছেন। তার প্রত্যেকটা ছবির মধ্যেই আসল মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ‘ওয়ার্ল্ড আর্ট’-এ তিনি যে বৈপ্লবিক অবদান রেখে গিয়েছেন, সেখানে তার অবস্থান এতটাই দৃঢ় যে অন্য কোনও শিল্পী পাবলো পিকাসোকে শিল্পে তার জায়গা থেকে সরাতে পারেননি।
পিকাসোকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে অনেক অনেক গল্প-কৌতুক। বিখ্যাতদের নিয়ে মজার কথা ছড়িয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। পাবলো পিকাসো তখন দারুণ জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী। একদিন চার্লি চ্যাপলিন গেলেন পিকাসোর সঙ্গে দেখা করতে। বললেন, ‘আপনি কী করে ছবি আঁকেন, দেখতে এলাম।’
পিকাসো সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে গেলেন তার স্টুডিওর মধ্যে। সেখানে তিনি একটা ছবি আঁকতে ব্যস্ত ছিলেন। চ্যাপলিন দাঁড়িয়ে আছেন আর পিকাসো নিমগ্ন হয়ে ছবি আঁকছেন। হঠাৎ তুলি থেকে খানিকটা রং ছিটকে গিয়ে পড়ল চার্লি চ্যাপলিনের সাদা জামায়। পিকাসো আঁতকে উঠে বললেন, ‘ওহ্, আমি খুবই দুঃখিত চার্লি! দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি স্পিরিট নিয়ে এসে রংটা মুছে দিচ্ছি।’
চ্যাপলিন একবার তার জামাটার দিকে তাকান, তারপর হাসতে হাসতে বলেন, ‘কোনো দরকার নেই, তার চেয়ে আপনি বরং আমার প্যান্টের ওপর একটা সই দিয়ে দিন।’
উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম ল্য মুঁল্যা দ্য লা গালেৎ, দ্য ব্লু রুম, ওল্ড গিটারিস্ট, সেল্ফ-পোট্রেট, টু নুডস, থ্রি মুজিশিয়ানস্, মডেল অ্যান্ড ফিশবৌ, গের্নিকা, উইমেন অব আলজিয়ার্স।