তাজরীন অগ্নিকাণ্ড: দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড?

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ১১:৩০

আজ কলঙ্কিত তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনার বর্ষপূর্তি। 

২৪ নভেম্বর ২০১২। সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিট। ঢাকার অদূরে আশুলিয়া নিশ্চিন্তপুরে তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডের একটি পোশাক কারখানায় আগুনের সূত্রপাত। আগুন লাগার আগে কারখানায় পাঁচটি ফ্লোরে প্রায় আঠারশ শ্রমিক কাজ করছিলেন। এরপর বেজে ওঠে ফায়ার এলার্ম। সতর্ক শ্রমিকেরা। কিন্তু মূল গেটে থাকা একজন নিরাপত্তা কর্মী জানান, ভয় নেই, আগুন নিভে গেছে। গোডাউনে মশার কয়েল থেকে আগুন লাগে বলে শোনেন তিনি। শ্রমিকদের নিশ্চিন্তভাবে কাজ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। এটাই যেন নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন শ্রমিকদের চরম অনিশ্চয়তা। সন্ধ্যা ৭টার কিছু আগে হঠাৎ ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে যায়। পুরো কারখানায় আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু হয়। আট তলা ভবনের অন্ধকারে ছাদ থেকে আটকে পড়া শ্রমিকদের আর্তনাদ আর বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার ভেসে আসে। দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের লেলিহান শিখা দেখে অনেকেই লাফিয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু কারো ভাগ্যে জোটে চিরকালের জন্য পঙ্গুত্ববরণ। অবশেষে এক এক করে ১১১টি তাজা প্রাণ পুড়ে অঙ্গার। 

১১১ সংখ্যাটি মালিক পক্ষ ও সরকারি হিসেবে লেখা। যদিও আহত শ্রমিকদের দাবী বাস্তবিক মৃত্যুর সংখ্যা ৫০০ জনের কাছাকাছি। এখনো অনেকেই খুঁজে পায়নি তার আপনজনকে যারা সেদিন তাজরীনে কর্মরত ছিলো।

আগুন লাগার পর শ্রমিকদের বের হতে না দিয়ে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে। একটি গেইট খোলা রেখে সব গেট বন্ধ রাখা হয়েছিল, বাধ্য করা হয়েছিল একটি গেইট দিয়ে বের হতে। আর আগুন লাগার পরেও শ্রমিকদেরকে কাজ করতে বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাই অনেকের মতে এটা ছিল একটি হত্যাকাণ্ড। 

এরপর তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

শ্রম আইন ভঙ্গ করে আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্টস দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা চালিয়ে আসলেও সরকারের কোন সংস্থা এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) থেকেও তাদের কারখানা কখনো পরিদর্শন করা হয়নি। কারখানা নিয়মিতভাবে পরিদর্শন করে নীতিমালা বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান কলকারখানা অধিদফতর। এই প্রতিষ্ঠান থেকেও কখনো ওই কারখানা পরিদর্শনে যাওয়া হয়নি। তাই এই দুর্ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলেই মনে করছেন অনেকেই। 

তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হওয়ার ১৩ মাস পর ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন সিআইডির পরিদর্শক এ কে এম মহসীন উজ জামান খান।

অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়।

কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের পর দীর্ঘ সময় পাড় হলেও সেই মামলায় নেই অগ্রগতি। কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে স্থবির করে রাখা হয়েছে মামলার কার্যক্রম। এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা।
 
আসামিদের মধ্যে দেলোয়ার, মাহমুদা ও মোর্শেদ ছাড়াও প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল-আমিন, ইনচার্জ আনিসুর রহমান, স্টোর ইনচার্জ আল-আমিন জামিনে রয়েছেন।

আর কারখানা ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জু, কোয়ালিটি ম্যানেজার শহিদুজ্জামান দুলাল, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনারুল ও লোডার শামীম মিয়া পলাতক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ