ছাত্ররাজনীতির সোনালি অতীত ও হ্যাঙ্গওভার

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৪৩

এনস্লাইকোপেডিয়াতে ‘ছাত্র’এর যে সংজ্ঞা পাওয়া যায় তার বাংলা হল- “ছাত্র হলেন কোন ব্যক্তি যিনি কোন পেশার জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষালাভ করছেন” অপরদিকে রাজনীতিবিদ হলেন সেই ব্যক্তি- “যিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মকান্ডে সার্বক্ষণিক যুক্ত থাকার ব্রত বা পেশা গ্রহণ করেছেন।” এখান থেকে আমরা বলতে পারি যে, ছাত্র নিজেকে পেশার জন্য প্রস্তুত করছেন আর রাজনীতিবিদ পেশা ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছেন। তবে রাজনীতি আমাদের এখানে পেশাতে পরিণত হলেও এটি প্রচলিত আর দশটি পেশার মত নয়। এটি মূলত সমাজ-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সেবার ব্রত গ্রহণ করা। সমাজের প্রতি সামাজিক সব মানুষেরই দায় রয়েছে। কেবল রাজনীতিবিদদের হাতেই এই দায় ছেড়ে দেওয়া যেমন কাম্য নয় তেমনি নিরাপদও নয়। ছাত্ররা যেকোন সমাজেরই অংশ, ভিন্ন কোন গ্রহের অধিবাসী নয় যে সামাজিক সমস্যাকে সন্তর্পণে এড়িয়ে যাবে। 

ছাত্ররাই আগামী দিন রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃ্ত্ব দিবে। অপরদিকে রাজনীতিও আজীবন শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই টিকে থাকে। কেননা সমাজ বাস্তবতা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। গণচেতনার পরিবর্তনে তরুণ, বিশেষ করে ছাত্রসমাজের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। এটি স্বাভাবিক, কারণ তরুণদের জীবনে সাধারণত দায় থাকে না। এইজন্য তারা কল্পনাপ্রবণ হতে পারে এবং প্রচলিত ঘুণে ধরা সমাজকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। জাতির ইতিহাসে যে কোন পর্যায়ে জণগণের মধ্যে যে চেতনার বিস্তার প্রয়োজন, তা বহন করার জন্য তরুণ ছাত্রসমাজই সবচেয়ে উপযুক্ত শক্তি। কারণ ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে জাতির দুর্দিন ও সংকটময় অবস্থায় ছাত্ররাই সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং মুক্তির দিশারীরুপে আবির্ভুত হয়েছে। তরুণ ও ছাত্রদের উপর আপামর জনতার এ আস্থা থেকেই জন্ম নিয়েছে ছাত্র রাজনীতির, ঐতিহাসিক পটপরিবর্তনে যা এখন জনতার আশা-আকাংখার গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে।

আমাদের ছাত্র আন্দোলনের শুরুটাই হয়েছে মূলত ৫২ থেকে। বলা বাহুল্য যে, তখনকার প্রেক্ষাপটই ছাত্রদের রাজপথে নামতে বাধ্য করেছিল। ছাত্রাবস্তায় সংসার, ছেলেমেয়ে বা চাকরি হারাবার মত অবস্থা এ তরুণ সমাজের ছিল না। কেবল একটা জিনিসই তারা হারাতে পারতেন, আর তা হল তাদের প্রাণ - ’৫২ তে বরকত, সালাম এবং অন্যরা এবং ’৬৯ এ আসাদ এবং আরো অনেকে যেমন প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর তাই তখন ছাত্র রাজনীতির সামাজিক চাহিদা গড়ে উঠেছিল যা জনমনের প্রত্যাশা অনুধাবন করে চুড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃ্ত্ব দিয়ে বাঙালি জাতির সহস্র বছরের স্বপ্নের একটি নতুন রাষ্ট্র জন্ম দিয়েছিল। ছাত্র এবং রাজনীতির মধ্যে তখনকার ঐতিহাসিক সমন্বয়ের প্রেক্ষাপটেই ছাত্র ও রাজনীতি একীভুত হয়ে ছাত্র-রাজনীতি নিজেই একটি প্রত্যয়ে পরিণত হয়েছিল যার ‘হ্যাঙ্গওভার’ থেকে জাতি এখনও মুক্ত হতে পারেনি।

ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে সেই বৃটিশ আমল থেকে। আগের যে ছাত্ররাজনীতি তা ছিল মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন এবং পরবর্তী কালে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভাগে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ‘৮০’র দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ দেশের ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। সেই পাকিস্তান আমল থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এ দেশের ছাত্র সমাজের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল অগ্রগামী। শত শত ছাত্র এসব আন্দোলনে রক্ত দিয়েছিল। তারাই ছিল জাতির বিবেক। ছাত্র সমাজই জনগণকে তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন করেছিল। আর ছাত্র সমাজের ওপর ছিল জাতির অগাধ আস্থা।

’৫০ থেকে ’৯০ এর দশক পর্যন্ত যারা ছাত্ররাজনীতি করত তারা ছিল ত্যাগী। তারা একটি আদর্শকে ধারণ করতো। গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, মার্ক্সবাদ, সাম্যবাদ ইত্যাদি বিষয় ছিল তাদের নখদর্পণে। তাদের অনেকে ছিল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থী। তাদের রাজনীতির বিষয় ছিল শোষণ-বৈষ্যমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন। তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জাতীয় উন্নয়নের জন্য রাজনীতি করতেন। আর তাদের ছিল প্রবল দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনা। আজকের যারা জাতীয় নেতা তাদের অনেকেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই হলো বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির সোনালি অধ্যায়। 

বর্তমানে যারা ছাত্ররাজনীতি করেন তাদের ত্যাগী মনোভাব নেই। তারা কোনো আদর্শকে আর লালন করার জন্য রাজনীতিতে আসছে না। তাদের অনেকেরই পড়াশোনার সঙ্গে যেন কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে তাদের জানার বা পড়াশোনার আগ্রহ খুব কম। রাজনৈতিক নেতারা আজকের ছাত্র সংগঠনগুলোকে তাদের কাজে ব্যবহার করছে। রাজনীতির হীনস্বার্থে ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে ছাত্রসমাজ তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটাতে পারছে না। তারা সুকুমারবৃত্তির চর্চা করতে পারছে না যা জাতীয় জীবনে খুবই প্রয়োজন। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে আজ প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয়স্বার্থ। জাতীয় রাজনীতির এই পরিস্থিতির জন্য ছাত্ররাজনীতি এখন সুস্থ নেই। ফলে ছাত্রসমাজের নেই কোনো মৌলিক চিন্তাভাবনা। তাদের নিজস্ব মানবীয় গুণাবলী পরিস্ফুটন ঘটছে না। আর এ জন্য জাতীয় পর্যায়ে যোগ্য নাগরিকের শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে।

ছাত্র শিক্ষককে ধরে ধরে পেটাচ্ছে, সাধারণ ছাত্রদের রিডিংরুম থেকে ধরে গেস্টরুমে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখছে, ক্লাস বন্ধ করে মিছিলে যেতে বাধ্য করছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, টেন্ডারবাজি করছে, ছাত্রী ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে মিষ্টিমুখ করছে, মেয়েদের হলে পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছে, সাধারণ ছাত্রদের ক্যাম্পাসে দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদায় মাথা নিচু করে চলতে বাধ্য করছে এবং ছাত্রদের গণতান্ত্রিক ন্যয্য দাবিকে গলা টিপে হত্যা করছে। 

ছাত্ররাজনীতির তিক্ত ফলাফলে অনেকে একে সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার কথা বলেন। এটা মোটেও সমস্যা থেকে উত্তরনের উপায় নয়। আমরা জানি ছাত্র রাজনীতির সোনালি অতীত রয়েছে। অতীতে ছাত্র সমাজের কর্মকা- জাতিকে প্রেরণা জুগিয়েছে। এর আগে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তা সফল হয়নি। এছাড়া ছাত্রদের দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাবার অধিকার আছে। ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীনভাবে ভাবার সুযোগ দিতে হবে, হীনস্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যবহার করা উচিত হবে না। ছাত্ররা যেন নিজেদের সুকুমারবৃত্তির প্রসার ঘটাতে পারে সে দিকে নজর দিতে হবে।

শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে জোরদার করার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে এই ছাত্র সংসদের নির্বাচিত নেতারা শিক্ষাঙ্গনের দাবি দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। আর এতে সব ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। সুতরাং ছাত্ররাজনীতির অতীত ইতিহাসকে সামনে রেখে ছাত্রছাত্রীদের তাদের নিজস্ব স্বাভাবিক পন্থায় চলার সুযোগ দেয়া উচিত। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ