স্কুল কলেজে মানসম্মত শিক্ষা ও গ্রন্থাগারিকদের শিক্ষক পদমর্যাদা

প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:৪৬

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারকে বলা হয় জ্ঞানের উৎস ও জ্ঞানের সংগ্রহশালা। একটি দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের কথা আলোচিত হলে সর্বপ্রথম বই ও লাইব্রেরির কথা চলে আসে। কিন্তু বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি কিভাবে হবে ও গ্রন্থাগার উন্নয়নের কথা কখনও আলোচিত হয়না। একথা সবাই বিশ্বাস করে একটি জাতির মেধা, মন, মনন ও মানসিক বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গ্রন্থাগার। অথচ বই ও গ্রন্থাগারকে যারা পাঠকদের কাছে সঠিকভাবে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলেন তাঁরাই থাকেন সব সময় অবহেলায়। বলা হয়ে থাকে একটি দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে সেদেশের মানুষের জ্ঞান চর্চার উপর। বর্তমান সময়ে আমরা জ্ঞান চর্চায় আগ্রহী হয়েছি বলেই আমরা আজ উন্নতির মহাসড়কে পদার্পণ করেছি। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ উদ্দ্যোগে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোতে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লাগছে। যা আনন্দের। 
 
২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও গ্রন্থাগারের গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে গ্রন্থাগার সম্বন্ধে বলা হয়েছে “গ্রন্থাগার সভ্যতার দর্পণ বলে বিবেচিত। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রন্থাগার যেমন একটি দেশের সার্বিক সাংস্কৃতিক বিকাশগত মান নির্ধারণের অন্যতম সূচক, তেমনি গ্রন্থাগার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ ও এর গুণগত মান ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ব্যবহারের প্রাণ স্পন্দনের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। দেশের নাগরিকদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা জীবনব্যাপী শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, গবেষণা, নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও শিক্ষা গ্রহণে গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে জ্ঞান ও তথ্য সহজলভ্য করার দায়িত্ব হল গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্রের। এই প্রত্যয়কে ভিত্তি করে দেশের গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত জাতীয় গ্রন্থাগার ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর গ্রন্থাগার থেকে শুরু করে কলেজসমূহের গ্রন্থাগার পর্যায়ক্রমে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে এবং শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।” জাতীয় শিক্ষানীতির ধারাবাহিকতায় স্কুল ও কলেজগুলোতে গ্রন্থাগারিক, সহ গ্রন্থাগারিক পদের সৃষ্টি হয় যা বিভিন্ন শিক্ষানুরাগী মহলে বেশ সমাদৃত হয়।

প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক, সহ গ্রন্থাগারিক সহ অন্যান্য পদ সৃষ্টি করা বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর ২০তম অধ্যায়ের কৌশল অংশের ১০-১৩ নম্বরে বলা হয়েছে-

১০. নীতি, পরিকল্পনা ও সমন্বয়গত সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি সংবিধিবদ্ধ এবং সার্বিক মর্যাদাসম্পন্ন কার্যকর গ্রন্থাগার কাউন্সিল স্থাপন করা হবে। 
১১. মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরকে নিজ নিজ প্রশাসনাধীন গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন ও নতুন গ্রন্থাগার স্থাপনায় কাউন্সিলের পরামর্শ অনুযায়ী নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। 
১১. প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক, সহ গ্রন্থাগারিক সহ অন্যান্য পদ সৃষ্টি করা ও তাদের যথার্থ মর্যাদা নির্ধারণ করা হবে।

এখন প্রশ্ন হল গত ২৬ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক জারি কৃত পরিপত্রে ঢাকা বোর্ডের অধীন সকল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত সকল গ্রন্থাগারিকদের শিক্ষকের মর্যদা না দিয়ে পরিপত্র জারি করা হয়েছে যা ১ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে, তা কতখানি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ কে অনুসরণ করে করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্র লক্ষ্য করলে দেখা যায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা সম্পূর্ণভাবে জাতীয় শিক্ষানীতিকে পাশ কাটিয়ে পরিপত্রটি জারি করেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এমন ধরণের গুরুত্বপূর্ণ পরিপত্র জারি করার আগে আরো সময় নিতে পরতো।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে স্কুল কলেজে গ্রন্থাগারিকদের পদমর্যাদা শিক্ষকের মর্যাদার সমান। ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে সার্কুলার জারি করে স্কুল কলেজে গ্রন্থাগারিকদের পদমর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও গ্রন্থাগারিকদের শিক্ষকের পদমর্যাদা দেওয়া হয়।

গ্রন্থাগারিকদের শিক্ষক পদমর্যদা সংক্রান্ত ভারতের কার্ণাটাক ও পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের সার্কুলার

দেশের সকল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত গ্রন্থাগারিকগণ গ্রন্থাগার ক্লাস সহ অন্যান্য ক্লাস নিয়ে থাকেন এবং পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল বইয়ের পাঠদানের মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রীদের  মন মেধা, মনন ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। তাই দেশের সকল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত গ্রন্থাগারিকদের অন্যান্য দেশের ন্যায় শিক্ষকের মর্যাদা প্রদান করা এখন সময়ের দাবী। গ্রন্থাগারিকদের শিক্ষকের মর্যাদা না দেওয়া হলে জাতীয় শিক্ষানীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তাই আশা করি  বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করবেন।

লেখক: সরকারি কর্মকর্তা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ