চিন্তার মশাল ঠিকই জ্বলবে দ্বিগুণ বেগে

প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:৩৬

দু’বছর আগে এই দিনে জাগৃতির প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন হয়ে যান তাঁর নিজ প্রকাশনীর অফিসে। ঘাতকেরা একই সময়ে হামলা করেছিল লালমাটিয়ার প্রকাশনা সংস্থা শুব্ধস্বর’এর অফিসেও। লক্ষ্য ছিল শুব্ধস্বর’এর প্রকাশক আহমেদ রশীদ চৌধুরী টুটুলকে হত্যা করা। সেখানে ব্লগার তারেক রহমান ও রণদীপম বসু থাকার ফলে তাঁরাও হামলার শিকার হন।

এ হত্যাকাণ্ডের আগে দেশের ভেতরে পাঁচজন ব্লগার খুন হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ ও নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়।

প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও আহমেদ রশীদ চৌধুরী টুটুলকে হামলা করার কারণ তাঁরা দুজনই ছিলেন প্রথিতযশা লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়’এর বইয়ের প্রকাশক। অভিজিৎ রায়ও খুন হয়েছিলেন ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে।

এ হত্যাকাণ্ডগুলো সংগঠিত করার সাথে সাথেই ধারাবাহিকভাবে খুন করা হচ্ছিল বিদেশী নাগরিক ও বিভিন্ন ধর্মাবলাম্বী মানুষজনকে। পাদ্রী থেকে পুরোহিত কাউকেই রেহাই দেয়নি হামলাকারীরা।

সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দিক নির্দেশনায় এ হত্যাকাণ্ডগুলো সংগঠিত হচ্ছিল। যুব্ধপরাধীচক্রের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করার পরপরই ব্লগারদের উপর খড়গহস্ত হয়েছে খুনিরা। ৭১’এর খুনি জামাত নেতা যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় নিয়ে ব্লগাররা যে আন্দোলনের সূত্রপাত শুরু করেছিল, তার প্রতিশোধ নিয়েছে জামায়াত-শিবির চক্র ব্লগারদের রক্তে দেশের মাটি ভিজিয়ে দিয়ে। ৭১’এ সংগঠিত অপরাধের দায়ে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত – শিবির চক্রের খুনি নেতাদের বিচারের দাবিতে সর্বোচ্চ শক্তি ঢেলে রাজপথে নামা ব্লগারদের খুন করেই জামায়াত-শিবির চক্র তাদের ৭১’এর খুনি নেতাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে ও প্রতিশোধ নিয়েছে। 

হত্যাকারীরা সবাই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করার চেষ্টাই করেছিল, খুব কম সময়ই খুনিরা অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। ধরা পড়া খুনিদের প্রায় সবাই ছাত্রজীবনে জামাত – শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। ব্লগার হত্যাকাণ্ডের পরপরই জামাত প্রতিষ্ঠিত নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই’এর নাম উঠে আসে। ব্লগারদের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িয়ে যায় নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। প্রায় সবকজন ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সাথে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত বড় ভাই’এর নাম উঠে আসে। 

এ হত্যাকাণ্ডগুলো খুবই পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। খুনিরা পরস্পরের সাথে খুব কম সময়ই মিশতে পেরেছে, বা যোগাযোগ ছিল। খুনিদের পিছনে কলকাঠি নাড়নেওয়ালাদের কাছ থেকেই নির্দেশ পেয়ে খুনিরা কাজে নেমে পড়েছে। কোন ধরণের রাজনৈতিক নির্দেশনা ও সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া এ ধরণের খুন করা যায় না। প্রতিটি খুনে খুনিরা মটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে গেছে, খুনিদের খুন করার সহায়তা করার জন্য ছিল একাধিক সহায়ক দল।

প্রতিটি খুন হবার পরে খুনিরা ও তাদের সমর্থক জামাত - বিএনপি চক্র ও এদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে ব্লগারদের ধর্ম নিয়ে লেখাকে দায়ী করেছে। ক্ষেত্র বিশেষে এ সমস্ত হত্যাকাণ্ড ঠিকই আছে বলে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। হাটহাজারির ৭১’এর খুনি শফি ওরফে তেঁতুল হুজুর ব্লগারদের হত্যা ওয়াজিব বলেও মন্তব্য করেছেন। এ সমস্ত প্রচার প্রপাগান্ডার সাথে ক্ষমতাসীন মহলও তাল দিয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও তাল মিলিয়েছেন। তিনি ব্লগারদের লেখাকে নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, যেন লেখার জন্যই ব্লগাররা খুন হচ্ছিল! মানুষ খুন যেন কিছুই নয়, এটি ডাল ভাত মাত্র!

দেশব্যাপী জামায়াত-বিএনপি চক্র নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ের নামে দেশব্যাপী নিরীহ নাগরিকদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুরোহিত, পাদ্রী, সনাতন ধর্মাবলাম্বী নিরীহ দোকানদার ও ব্লগার হত্যাকান্ডে মদদ দিয়েছে। রাজনৈতিক দাবি আদায়ের নামে সামরিক জান্তার দল বিএনপি, ৭১’এর খুনি চক্রের সাথে মিলে ৭১’এর খুনিদের রক্ষা করতে নেমেছিল। বিএনপি নেত্রী বড়াবড়ই ৭১’এর খুনিরা নিরপরাধ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছিলেন ও মুক্তি দাবি করছিলেন।

বিএনপি নেত্রী গত ক’দিন আগে আদালতে সাফাই স্বাক্ষী দিতে গিয়ে কেঁদে কেটে চোখের জল ও নাকের জল একাকার করেছেন। তিনি তাঁর ছেলে মারা যাবার দিনটিতেও তাঁর নামে সরকার সন্ত্রাসের মামলা দিয়েছে বলে আহাজারি করেছেন। 

দেশের এতগুলো নিরীহ নাগরিকদের আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য তাঁর ভুল রাজনীতি ও ৭১’এর খুনি চক্রের প্রতিশোধস্পৃহা যে দায়ী তা তিনি বেমালুম চেপে গিয়েছেন। ৭১’এর পর দেশের আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের একে একে হত্যার সময় তিনি চোখে ঠুলি পড়েছিলেন, একটি হত্যাকাণ্ডের পরও তিনি খুনিদের প্রতি নিন্দা জানাননি, ন্যুনতম বিষোদগারও করেননি। তিন শতাধিক শিশু–কিশোর, নারী-পুরুষ ও বৃদ্ধ-যুবা বেগম জিয়ার আন্দোলনের আগুনে আক্ষরিক অর্থে জ্বালানো আগুনে ভষ্ম হয়ে ইহধাম পাড়ি দিয়েছে, সাথে দেশের আধুনিক বুদ্ধিজীবী ব্লগার ও বিদেশী নাগরিকরা। তাদের জন্য বেগম জিয়া এক ফোঁটাও অশ্রু ফেলেননি, এঁরা সবাই বেগম জিয়ার সতীনের ছেলে যাঁদের জন্য কোন অশ্রু ফেলতে হয় না, দরকার হয়না কোন রঙিন টিস্যু পেপার! 

লেখার কারণে লেখক ও প্রকাশক হত্যা করে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ঠেকানো যাবে না। মধ্যযুগের চর্চাই সার কথা নয়, যুগে যুগে সমাজের ভিন্নমতের চর্চাকারীরাই জ্ঞানের আগুন জ্বালিয়ে গেছেন। চাপাতির কোপে ভিন্নমত ও জ্ঞানের চর্চা আটকানো যায় না অন্তত এই ভার্চুয়াল জগতে। সাময়িক চাপে কিছু ব্লগার প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেশের বাইরে গিয়েছে বটে, তবে লড়াই থেমে থাকে না মধ্যযুগের দিকে ঠেলে পাঠাতে চাইলেই পাঠানো যায় না। কেউ না কেউ ঠিকই প্রদীপ হাতে জ্ঞানের মশাল প্রজ্বলিত রাখবে। 

প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ ও নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়’ এর সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি।

খুনিরা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে, মধ্যযুগও নির্বাসিত হবে চিন্তার মশাল ঠিকই জ্বলবে দ্বিগুণ বেগে।  

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ