পতিসরের পথে প্রান্তরে, রবি বাউল ঘোরে

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০১৮, ১৩:২০

১.
পতিসরের জল-কাদায় মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বাতাসে কান পাতলেই ভেসে আসে রবীন্দ্র কণ্ঠস্বর। এই পতিসরে রবি ঠাকুর প্রথমবার আসেন ১৮৯১ সালের জানুয়ারিতে। প্রথম দিকে কিছুটা বিরূপ হলেও একসময় পতিসর কবিকে মায়ার বাঁধনে আটকে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ কর্মময় সময় কেটেছে এ পরগনায়। তিনি আপন নানান স্বপ্নবীজ বপন করেন এখানেও। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর কালিগ্রাম পরগণার সদর কাচারি পতিসরে এসে কবি প্রতিষ্ঠা করেন বহুল আলোচিত “পতিসর কৃষি ব্যাংক”। সেই প্রাণের কবি’র স্মৃতিচিহ্ন খুঁজতে ২০১৬ সালের ১৯ মে গিয়েছিলাম তাঁর স্মৃতিময় নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পতিসর। মুনিয়ারী ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী শস্য শ্যামল ছায়া ঘেরা ‘পতিসর’। পতিসরকে ছুঁয়ে বয়ে গেছে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত নাগর নদী। এই নাগর নদীকে উদ্দেশ্য করেই কবি লিখেছেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, / বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ কবির অমর স্মৃতিকে ধারন করে আজও প্রবাহমান নাগর নদী, তবে বহমান নেই আর সেই আগের স্রোতধারা। সেই সাথে নেই নদী পাড়ে অবস্থিত রক্ষাকালি মন্দিরের তালগাছটি। তবে সেখানে নতুন একাধিক তালগাছের দাঁড়িয়ে থাকা দেখেও মোটেই খারাপ লাগেনি। পতিসরে এসে রবির প্রভাব বলয়ের আরেক সাধক ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’খ্যাত পণ্ডিত হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের পদচিহৃস্মৃতিও আমার মনে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। আমি খুঁজেছি তাঁকেও। বলে রাখা ভালো, পতিসর ভ্রমণকালে আমার মতোন যে কোন রবি প্রেমিকের জন্য ‘বাইবেল’ হয়ে উঠতে পারে প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিকের ‘রবীন্দ্রভুবনে পতিসর’ গ্রন্থটি।

২.
আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন কবি, নাট্যকার, উপন্যাস রচয়িতা, ছোটগল্পকার, সঙ্গীতের সুরস্রষ্টা, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ বা শিক্ষাসংস্কারক, প্রবন্ধকার এবং চিত্রশিল্পী। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ডিগ্রির মানপত্রে লেখা কথাক’টি অক্ষরে অক্ষরে খাঁটি, ‘যে বিষয়েই উনি হাত রেখেছেন, তাকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালির শৈল্পিক অহঙ্কারের এক বিশ্বব্যাপ্ত নাম। বিশ্বসাহিত্যের এই উজ্জলতম নক্ষত্র নিজের সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার পরিধি দিয়ে বিস্তৃত করেছেন গোটা বাংলা সাহিত্যের পরিসর। তিনি তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পমাধ্যমের প্রতিটি শাখায় তাঁর অনায়াস বিচরণ সত্যিই বিস্ময়কর তিনি ছিলেন শান্তির কবি, মানবতার কবি। তিনি ছিলেন প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের সাধক। কালজয়ী এ কবি জীবন ও জগৎকে দেখেছেন অত্যন্ত গভীরভাবে যা তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনী, সঙ্গীত ও চিত্রকলায় সুস্থ ধারায় উৎসারিত হয়েছে। কবিগুরু রবি ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) আর মৃত্যু ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮)। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

৩.
সম্প্রতি রবির প্রভাব-ঘোরের জ্বরে আক্রান্ত আমি কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর পতিসর কুঠিবাড়ি ঘুরে প্রত্যয় গভীরতর হলো, যে যাইই বলে বলুক, আমি সংশয়হীনভাবে স্বীকার করি আমার ঠাকুর রবি ঠাকুর। তিনি এক অন্য ঠাকুর, অনন্য ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যের, আমাদের ঐতিহ্যের, আমাদেন সাংস্কৃতির সেই অনতিক্রমা গৌরব যিনি সম্পুর্ণ একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের জগতে এমন একটি বিপ্লব ঘটিয়েছেন যার দৃষ্টান্ত সমগ্র পৃথিবীতে বিরল। মহাকালের অমোঘ বিবর্তনে যুগে যুগে আমাদের স্বীয় সাংস্কৃতির কর্মব্যাপকতায়। আমাদের সুদিনে-দুর্দিনে, আনন্দে-বেদনায়, হতাশায়-উচ্ছাসে নানান পটভূমিতে রবীন্দ্র প্রতিভা তার বর্ণালী দ্যুতি ছড়িয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়, উপলব্ধি করে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতিলগ্ন ও জীবনমুখী শিক্ষাদর্শনের পথপ্রদর্শক। তাঁর শিক্ষাভাবনা আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের তিনি একান্ত আপনজন। 

৪.
বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং ধর্ম-বর্ণ-ভাষার বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখতে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও দর্শন এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। আমাদের মননে বিশ্বকবির ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতি শোষণ, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা ও অমানবিকতা প্রতিরোধে বাঙালির অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখছে, রাখবে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ২৪ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের লেখনী আমাদেরকে উজ্জীবিত করেছে। তাঁর জাতীয়তাবোধ বাঙালির অনন্ত প্রেরণার উৎস। কবির প্রতি অর্ন্তহীন ভালবাসায় ১৯৬১ সালে বৈরী পাকিস্তানি শাসকচক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা যেমন রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালন করেছি, তেমনি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির সাংস্কৃতিক সহায় সূত্র। জীবনের প্রতিটি সমস্যা-সঙ্কট, আনন্দ-বেদনা এবং আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রসৃষ্টি আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কালোত্তীর্ণ এ কবির সৃষ্টিকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কবিগুরুর অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি জাতির পিতা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেন যা দেশের মানুষের মনে সঞ্চারিত করেছে দেশপ্রেমের নতুন প্রেরণা।

৫.
শিলাইদহ ও পতিসর অঞ্চলেই তিনি রচনা করেছিলেন ‘ছিন্নপত্র’র সিংহভাগ এবং অসামান্য কিছু গান। এই অঞ্চলের গ্রামীণ দরিদ্র ও অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের জন্য তাঁর পল্লী উন্নয়ন প্রচেষ্টা আজও আমাদের কাছে অনুসরণীয় হয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যের উৎসভুমি হিসাবে নওগাঁ জেলার পতিসর একটি অনন্য নাম। বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সাথে জড়িয়ে আছে পতিসরের স্মৃতি। জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের পর পতিসরের মতোন অবহেলিত জনপদের লোকজীবনের কল্যাণে রবীন্দ্রনাথ এখানে এক অনন্য কর্মযজ্ঞের সূচনা করেন। প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষিব্যাংক, স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য চিকিৎসালয়, শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন এবং সামাজিক শৃংখলা রক্ষার জন্য তিনি শালিসি ব্যবস্থার প্রচলন করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ দু:স্থ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পতিসরে পল্লী সংগঠনের কাজ শুরু করেন। পল্লী সংগঠন পরিচালনার জন্য গঠিত হয় একটি সাধারণ সভা। উল্লেখ্য যে, ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষের প্রচলন করে কবি রবীন্দ্রনাথ প্রতিসরে সনাতন কৃষি ব্যবস্থায় আধুনিকতার সূত্রপাত করেন।

৬.
‘ওই যে সমস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালবাসি ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এসব কি কোন স্বর্গ থেকে পেতুম? স্বর্গ আর কী দিত জানিনে, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতাময়, এমন সকরুণ আশংকাভরা, অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আদরের ধন কোথা থেকে দিত।’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালের জানুয়ারী মাসে কালীগ্রাম (কালীগ্রাম পরগণার সদর পতিসর) থেকে ইন্দিরা দেবীকে এ চিঠিটি লেখেন। এ চিঠির কথাগুলোতে পতিসরের মাটি ও মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের গভীর ভালবাসা ও মমত্ব ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে পতিসরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও রবীন্দ্রনাথকে বিমোহিত করেছে। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগণার এই জমিদারি ক্রয় করেন ১৮৩০ সালে। কালীগ্রাম পরগণার সদর দপ্তর ছিল পতিসর। পতিসর নওগাঁর আত্রাই উপজেলা সদর থেকে পূর্বদিকে ১৪ কিলোমিটার দূরে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত।

৭.
নাগর নদের তীরের পতিসরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাচারীবাড়ির ইতিহাস খুঁজে জানতে পারি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের তৎকালীন পূর্ববঙ্গে তিনটি জমিদারি ছিল। নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার বিরাহিমপুর (সদর শিলাইদহ) পরগণা, পাবনা জেলার সাজাদপুর পরগণা (সদর সাজাদপুর) এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগণা (সদর পতিসর)। কবি ও জমিদার রবীন্দ্রনাথ কখনো শিলাইদহ থেকে, কখনো সাজাদপুর থেকে, কখনো আত্রাই ঘাট রেল স্টেশন থেকে নিজস্ব বজরায় পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, আত্রাই, নাগর এবং চলনবিল পেরিয়ে জমিদারি তদারকের জন্য পতিসর আসতেন। ড. শচীনন্দন ঘোষালের পল্লী উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ গ্রস্থ থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ জমিদারির প্রকৃত ভার পেয়েছিলেন ১৮৯৬ সালের আগষ্ট মাসে। দেবেন্দ্রনাথ ‘পাওয়ার অব অ্যাটনি’ করে সমস্ত সম্পত্তির সব কর্তৃত্ব তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ কে জমিদারির শিক্ষানবিশ করে কাটাতে হয়েছে। জমিদারির জটিল দায়-দায়িত্বের বিরাট বোঝা বহনের দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয়েছে পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছে। ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগাভাগি হয় ১৯২০ সালে। রবীন্দ্র-গবেষক ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী রচিত পতিসরে রবীন্দ্রনাথ গ্রস্থ থেকে জানা যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একান্নবর্তী পরিবারের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিজেই সম্পন্ন করে দেন। পাবনার সাজাদপুর পরগনা অনুজ গিরীন্দ্রনাথের ভাগে এবং নদীয়ার বিরাহিমপুর ও রাজশাহীর কালীগ্রাম পড়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের ভাগে।পরবর্তীকালে জমিদারি আবার ভাগ হয়। শিলাইদহসহ বিরাহিমপুর পরগণা যায়, সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অংশে, রবীন্দ্রনাথের থাকে শুধু কালীগ্রাম পরগণা। শিলাইদহও পরে ঋণের দায়ে চলে যায় ভাগ্যকুলের কুন্ডুদের হাতে। ১৯২১ সালে জমিদারি পুরোপুরি ভাগ-বাঁটোয়ারার পর শুধু কালীগ্রাম পরগণার জমিদারি তদারকের কাজে বরীন্দ্রনাথকে বহুবার পতিসর আসতে হয়েছে।

৮.
কালীগ্রাম পরগণা তথা পতিসর কাচারিবাড়ি ছিলো রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব জমিদারি। সে জন্য পতিসর এলাকার মানুষের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রাণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পতিসরই হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন ও পরিকল্পনার প্রাণকেন্দ্র। এখানে প্রজাদের কল্যাণে অনেক জনহতিকর কাজ করেন তিনি। যেমন- পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, রেশম চাষ, সমবায় পদ্ধতি, বিচার ব্যবস্থা, পুকুর-দিঘি খনন, চাষাবাদের জন্য কলের লাঙলের প্রচলন, তাঁতে কাপড় বোনা, গ্রাম্য শিল্প প্রচলন, মাছের ব্যবসা, দুর্ভিক্ষের জন্য ধর্মগোলা স্থাপন ইত্যাদি।

৯.
শিলাইদহ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক না থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথ সেখানে মন মতো সংস্কারমূলক কাজ করতে পারেননি। কিন্তু পতিসর এলাকায় এ ধরনের সমস্যা ছিলনা। সে জন্য তিনি পতিসরকেই বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সংস্কার কাজের ক্ষেত্র হিসেবে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃ স্মৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন, শিলাইদহের চার পাশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সদভাব নেই। নতুন কিছু প্রর্বতন করতে গেলেই সন্দেহ করে। কয়েক বছর চেষ্টা করেও সেখানে বিশেষ কিছু করতে পারা যায়নি। এই কারণে কালীগ্রাম পরগনাতেই তিনি বেশী মনোযোগ দিয়েছিলেন। সেখানকার প্রজাদের মধ্যে একনিষ্ঠতা ছিল।

১০.
কালীগ্রাম পরগণায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও সংস্কার কাজের জন্য প্রজাদের নিয়ে ‘কালীগ্রাম হিতৈষী সভা’ গঠন করা হয়। পাঁচজন ছাড়াও কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভায় জমিদারের একজন প্রতিনিধি থাকে। কাজের সুবিধার জন্য সমগ্র পরগণাকে তিন ভাগে ভাগ করে তিনটি ‘বিভাগীয় হিতৈষী সভা’ গঠন করা হয়। প্রজাদের খাজনার প্রতি টাকার সঙ্গে তিন পয়সা অতিরিক্ত আদায় করে হিতৈষী সভার তহবিল গঠন করা হয়। প্রজারা স্বেচ্ছায় চাঁদা দিয়ে এই তহবিল গঠন করত। হিতৈষী সভা প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থার কাজে হাত দেয়। হিতৈষী সভা কয়েকটি গ্রামে পাঠশালা, তিনটি মাধ্যমিক ইংরেজী স্কুল ও পতিসরে একটি হাইস্কুল স্থাপন করে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃ স্মৃতি’ গ্রস্থে বলেছেন, সারা পরগণার মধ্যে শিক্ষার কোন ব্যবস্থাই পূর্বে ছিল না। অবস্থাপন্ন লোক তাদের ছেলেদের নাটোর, আত্রাই, বগুড়াসহ বিভিন্ন শহরে পাঠাতো স্কুলে পড়াবার জন্য।

১১.
পতিসরে কৃষির উন্নতি করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ পতিসর অঞ্চলটা এক-ফসলে। অঞ্চলটা নিচু হওয়ায় বছরের বেশির ভাগ সময় ফসলের মাঠ পানির নিচে থাকে। শুষ্ক মৌসুমেও মাটি কঠিন হয়ে থাকে, লাঙল চলে না। রথীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রস্থে বলেন, ‘শিলাইদহ অঞ্চলে কৃষির উন্নতি করার যথেষ্ট সুযোগ পেলুম। কিন্তু পতিসরে সে সুযোগ নেই, অঞ্চলটা নিতান্তই এক ফসলে। বর্ষার কয়েকমাস জলমগ্ন থাকে আর জল নেমে গেলে মাটি শুকিয়ে এত কঠিন হয়ে যায় যে লাঙ্গল চলে না। সেই জন্য রবিশস্য কিছুই হয় না। এমনকি, গাছপালাও জন্মায় না। বাবা কিন্তু এই অসুবিধা সত্বেও কালীগ্রামে আবাদের কী উন্নতি হতে পারে তাই নিয়ে চিন্তা করতে ছাড়েননি।

১২.
১৩১৫ সালে তিনি কোন এক কর্মীকে লিখছেন, প্রজাদের বস্ত্তবাড়ী ক্ষেত্রের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদিগকে উৎসাহ করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাহির হয়। ফলও বিক্রয়যোগ্য শিমুল আঙ্গুর গাছ বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তাহার মূল হইতে কিরুপ খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগতে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভ হইবে। কাচারিতে যে আমেরিকান ভুট্টার বীজ আছে তাহা পুনর্বার লাগাইবার চেষ্টা করিতে হইবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পিতৃ স্মৃতি’ গ্রস্থে লিখেছেন, ‘অনেক চেষ্টার ফলেও কালীগ্রামে চাষাবাদের বিশেষ উন্নতি করা সম্ভব হয়নি। কয়েক বছর পর একটা সুযোগ পেলুম। উত্তরবঙ্গ বন্যার সাহায্যার্থে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয় অনেক টাকা তুলেছিলেন। দুঃস্থদের সাহায্য করার কাজ শেষ হয়ে গেলে এই ফান্ডে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থেকে গিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে আত্রাইতে স্থায়ী ভাবে একটি খাদি আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন, কয়েকটি ট্রাক্টরও কেনা হয়। ট্রাক্টর কেনার উদ্দেশ্য ছিল, বন্যাতে অনেক গরু মরে যাওয়ায় লাঙ্গল চালাবার উপায় ছিল না, আচার্যদেবের কাছ থেকে পতিসরের জন্য একটা লাঙ্গল চেয়ে নিলুম। আমাদের দেশে তখনও ট্রাক্টরের চলন হয়নি। ট্রাক্টর তো পেলুম কিন্তু চালক পেলুম না। নিজেই চালাতে লাগলুম।’

১৩.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে কুটিরশিল্প বিস্তারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। একজন মুসলমান জোলাকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়েছিল প্রশিক্ষণের জন্য। কুটিরশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ শেষে ওই জোলাকে পতিসর নিয়ে এসে তাকে শিক্ষক করে একটি বয়ন শিক্ষার স্কুল খোলা হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র এবং পতিসরের শেষ জমিদার রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘বোলপুরে একটা ধানভানা কল চলছে, সেইরকম একটা কল এখানে (পতিসর) আনাতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে। এ দেশ ধানেরই দেশ বোলপুরের চেয়ে অনেক বেশী ধান এখানে জন্মায়। এই কলের সন্ধান দেখিস।’

১৪.
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারের শুরুতেই পতিসরে সালিশি বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরগণার কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি করে বিচারসভা স্থাপন করেন। নিয়ম করা হলো, প্রজাদের মধ্যে কোনো বিবাদ হলে উভয় পক্ষকেই বিচারসভায় উপস্থিত হতে হবে। প্রজারা ফৌজদারি ছাড়া অন্য কোনো রকম মামলা নিয়ে আদালতে যাবে না। কেউ এই নিয়ম অমান্য করলে গ্রামবাসী তাকে একঘরে করবে, তার সঙ্গে কেউ সম্পর্ক রাখবে না। বিচারে আপিলেরও ব্যবস্থা ছিল। সমস্ত পরগণার জন্য পাঁচজন সভ্য নিয়ে একটি আপিল বিভাগ ছিল। এই পাঁচজনকে পঞ্চপ্রধান বলা হতো। পঞ্চপ্রধানের বিচারে সন্তুষ্ট না হলে শেষ আপিল ছিল স্বয়ং জমিদারের কাছে। এ ধরনের বিচার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় প্রজারা খুশি হয়েছিল এবং আদালতে নালিশ করতে যাওয়া তারা ছেড়ে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘আদালতের সাহায্য ছাড়া বিনা ব্যয়ে বিনা বিলম্বে মামলার বিচারের এই ব্যবস্থা আরম্ভ হবার শুরু থেকেই প্রজারা এর উপকারিতা অনুভব করেছিল।’

১৫.
জমিদার জীবনের শুরুতেই রথীন্দ্রনাথ লক্ষ করলেন, প্রজারা সকলেই ঋণী। গরিব প্রজারা মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে পারত না। কারণ সুদের হার ছিল অত্যন্ত বেশি। আর সুদের সুদ আদায় করা হতো। প্রজাদের এই দুঃখ-দুর্দশা দেখে প্রজাদরদি জমিদার রথীন্দ্রনাথের প্রাণ কেঁদে ওঠে। ধার করা টাকা দিয়ে তিনি পতিসরে একটি কৃষি-ব্যাংক স্থাপন করলেন। ‘পিতৃ স্মৃতি’ গ্রন্থে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘হাজার টাকা ধার নিয়ে পতিসরে একটি কৃষি ব্যাংক খুলে বসলেন।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কারের এক লাখ আট হাজার টাকা পতিসর কৃষি ব্যাংকে ডিপোজিট হিসেবে রেখেছিলেন। প্রজারা কৃষি-ব্যাংক থেকে কর্জ নেওয়া শুরু করলে মহাজনরা তাদের কারবার গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

১৬.
রবীন্দ্রনাথ গ্রাম উন্নয়নের যে ধারাকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘পল্লী সঞ্জীবন’ অর্থাৎ গ্রামের মধ্যে প্রাণের নবজাগরণ) তাকে আধুনিক অর্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘পল্লী উন্নয়ন’-এর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বা ‘সিষ্টেম অ্যাপ্রোচ’ হিসেবেই মানতে হয়। ঔপনিবেশিক শাসনকালে রবীন্দ্রনাথ যে কৃষি অর্থনীতির মৌলিক কার্যক্রমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা এক কথায় অভাবনীয়, কেননা তখনো ওই ঊনিবিংশ শতকের শেষ পাদে কোনো উন্নয়নতত্বের জন্মই হয়নি। কৃষি-অর্থনীতির উন্নয়ন তো দূর অস্ত, অর্থনৈতিক উন্নয়নতত্ব কথাটার জন্ম দিয়েছেন জার্মান অর্থনীতিবিদ সুম্পিটার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে মাত্র। স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথ যে পদ্ধতিতে কৃষি তথা ভূমি-অর্থনীতির ব্যবহারিক দিক থেকে রায়ত-উৎপাদন-উপাদান ব্যবস্থার ভেতরে কৃষি ফসল ফলানোর উন্নতির পথ অবলম্বন করে দেখিয়েছেন, তা অবশ্যই ‘রবীন্দ্র-কৃষি-উন্নয়ন মডেল’ বলেই স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথ পতিসরে গড়ে তুলতে চেয়েছিল তাঁর সাধের পল্লীসমাজ (স্বদেশী সমাজ), সচ্ছল শিক্ষিত স্বনির্ভর গ্রাম। আজ থেকে প্রায় সোয়াশ’ বছর আগে পতিসর ঘিরে এই ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন।

১৭.
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর পতিসরের এই সব কর্মকাণ্ড থেমে যায়। এরপর জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। আস্তে আস্তে নীরব-নিথর হয়ে যায় একসময়ের প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপর পতিসর। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পতিসরের সেই সুবর্ণ দিন। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পতিসরের কাচারীবাড়ী। কাচারীবাড়ীটি দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে জীর্ণ হয়ে যায়। লুটপাট ও চুরি হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পতিসরের সেই সুবর্ণ দিন। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পতিসরের কাচারিবাড়ি। কাচারিবাড়িটি দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে জীর্ণ হয়ে যায়। লুটপাট ও চুরি হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। ১৯১৪ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কাচারীবাড়ি অধিগ্রহণ করে। ২০০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত চুরি যাওয়া কিছু কিছু জিনিসপত্র উদ্ধার করে কাচারীবাড়িতে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বাথটাব, বোটের নোঙর, কৃষিচাষের ট্রাক্টরের যন্ত্রাংশ, চেয়ার-টেবিল, কাঠের আলমারি, খাট, আরাম কেদারা, লোহার সিন্দুক এবং বেশ কিছু দুর্লভ ছবি।

১৮.
রবীন্দ্রনাথ পতিসরের মাটি ও মানুষকে অত্যন্ত আপন মনে করে ভালবেসেছিলেন। পতিসর থেকে ১৮৯৪ সালের ২১ মার্চ তারিখে ইন্দিরা দেবীকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘এখানকার প্রজাদের উপর বাস্তবিক মনের স্নেহ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে-এদের কোন রকম কষ্ট দিতে আদবে উচ্ছে করে না। এদের সরল ছেলেমানুষের মতো অকৃত্রিম স্নেহের আবদার শুনলে বাস্তবিক মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে। যখন তুমি বলতে বলতে তুই বলে ওঠে, যখন আমাকে ধমকায়, তখন ভারী মিষ্টি লাগে। এক এক সময় আমি ওদের কথা শুনে হাসি, তাই দেখে ওরাও হাসে।’

১৯.
শুধু জমিদারি ও উন্নয়ন পরিকল্পনাই নয়, এই পতিসর ছিল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃষ্টির অনন্ত প্রেরণা। এখানে তিনি রচনা করেছেন অনেক কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। এখানে তিনি রচনা করেন দুর্লভ জন্ম, মেঘদূত, আমাদের ছোট নদী, পল্লীগ্রাম, মধ্যাহ্ন, সামান্য লোক, খেয়া, বন, তপোবন, অনন্তপথে, ক্ষণমিলন, প্রেম প্রভৃতি কবিতা। বিখ্যাত গান বিধি ডগার আঁখি, বধূ মিছে রাগ করো না, জলে-ডোবা চিকন শ্যামল, আমি কান পেতে রই, তুমি নবরূপে এসো প্রাণে প্রভৃতি। ছোট গল্প প্রতিহিংসা, ঠাকুরদা, কাদম্বরী। উপন্যাস ‘গোরা’ ও ‘ঘরে-বাইরে’র অংশ বিশেষ। এ ছাড়া বেশকিছু প্রবন্ধ, ছিন্নপত্রাবলি এই পতিসরে রচিত। 

২০.
এই ছায়াস্নিগ্ধ নিভৃত পল্লীর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সাথে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন বাংলার সাহিত্যের কিছু অবিশ্বরণীয় গল্প, কবিতা, নাটক ও গান। পতিসরে বসে তিনি রচনা করেছেন কাব্য নাটিকা ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘গোরা’, ও ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের অংশবিশেষ। রচনা করেছেন ছোট গল্প ‘প্রতিহিংসা’ ও ‘ঠাকুরদা’। প্রবন্ধ ‘ইংরাজ’ ও ‘ভারতবাসী’। এছাড়াও চৈতালী কাব্যের অধিকাংশ কবিতা , চিত্রা কাব্যের শেষ পর্বের কবিতা ‘পূর্নিমা ও সন্ধ্যা’ এবং শিশুতোষ কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’ ও ‘তালগাছ’ তিনি রচনা করেছিলেন এই নওগাঁর পতিসরে বসেই। পতিসরে রচিত গানের মধ্যে রয়েছে ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’ ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ ‘তুমি আমার নিভৃত সাধনা’ ‘বধূ মিছে রাগ করোনা’‘আমি কান পেতে রই’সহ আরো অনেক গান। 

২১.
রবীন্দ্রনাথের কল্প জগৎ, মনীষার বৈচিত্র্য ও মননের দিগন্তের যতটুকু আমাদের আকৃষ্ট করে তার পুরোটাই সামাজিক ভাবনাকে কেন্দ্র করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের রচনার ভান্ডার বিশাল।এই সুবর্ণ ভান্ডারের তিনটি মনিকা ‘শান্তি’, ‘ঠাকুরদা’ ও ‘প্রতিহিংসা’ পতিসরে রচিত মর্মে গবেষকরা অদ্যাবধি নিশ্চিৎ হয়েছেন।ঘটনা বিন্যাস ও শিল্প শৈলীর প্রেক্ষাপটে তিনটি গল্পেই রয়েছে গভীর মানবিকতাবোধ ও সমাজ পরিবর্তনের অসংখ্য উপাদান। বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতির সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের যে অকৃত্রিম আনন্দধারা উদ্ভাবিতহয় তাই সহজে প্রভাবিত হয়েছে এই নিরলংকৃত সরল গল্পগুলোর মধ্যে। এই আনন্দ বিশ্মিত সৃষ্টির মধ্যে হতভাগ্য জনদরিদ্র পল্লীবাসির জাগরণের দৃষ্টান্ত আমাদের সাহিত্যে আর কোথাও নেই।

২২.
১৯৩১-৩২ সালে নওগাঁর মহকুমা প্রশাসক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়। তিনি তাঁর ‘যুক্তবঙ্গের স্মৃতি’ গ্রন্থে পতিসর নিয়ে লিখছেন, ‘হাতী ছিল আমার প্রধান বাহন। যেমন হাউস বোট ছিল আমার প্রধান যান, পাই কোথায়? জমিদারের কাছে। নওগাঁ মহকুমায় তখন মোটর চলাচল যোগ্য রাস্তা নেই,পায়ে হাঁটাও যায় না। কারণ হলো কাঁদায় কোমড় পর্যন্ত ডুবে যায়, সেখানে হাতির মতো সহায় আর কে আছে। সেই হাতিও একবার তলিয়ে যাচ্ছিল আমাকে নিয়ে। তবে হাতিতে চড়ে তো স্বপরিবারে যাওয়া যায়না। যেতে হয় পালকিতে চড়ে। রবীন্দ্রনাথের মতো, উনি কেমন করে যে পারলেন, আমিতো হাত-পা গুটিয়ে বসে হাঁপিয়ে উঠি। হ্যাঁ, আমার ভাগ্যে লিখা ছিল রবীন্দ্রনাথের পালকিতে চড়া, আর হাউস বোটে চড়ে বেড়ানো , তবে পালকিটা পতিসরের নয়, শিলাইদাহ, দুই যায়গাতেই আমাকে যেতে হয়েছে। কখনো নওগাঁ থেকে কখনো কুষ্টিয়া থেকে। আক্ষরিক অর্থে তাঁর পদাংক অনুসরণ করেছি। রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কালীগ্রামেও গিয়েছি। এতে করেও তার প্রেরণায় শতাংশের এক একাংশও পাইনি। প্রশাসন আমাকে রাহুর মতো গ্রাস করেছিল। যুগটা ছিল সত্যগ্রহের তথা সন্ত্রাসবাদের যুগ। আমাকে পাল্লা দিয়ে জনসংযোগ করতে হচ্ছিল। ঠাকুর বাবুরা কদাচিৎ আসেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে মাত্র একটিবার আসতে দেখেছি। আত্রাই ঘাটে প্রজাপরিবৃত্ত। শেষ বিদায় নিচ্ছেন। তখন আমি রাজশাহীতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। আমার কাছে জমিদার হিসাবে তাঁর একটি গোপনীয় আর্জি ছিল। (সূত্র : যুক্তবঙ্গের স্মৃতি, পৃ: ১২ ও ১৩)।

২৩.
বস্তুত রবীন্দ্রনাথ মানব জীবন, মানব সমাজ ও মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে মানবিক সত্যকে সবার উপরে ঠাঁই দিয়েছেন। তাঁর সমাজ চেতনা তাই মানব চেনতা নির্ভর শুধু নয়; তা মানবিক চেতনায় এবং মানবিক প্রয়োজনের উপর নির্ভর। সে প্রয়োজন অবশ্যই মানব কল্যাণের, মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে বাঁধা। প্রকৃতির সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের ভাবনা একই বোধে জড়িত। তিনি তার রচনায় বার বার যে শিথিল চরাচরে ব্যাপ্ত বিশ্বমানবতার জয়গান গেয়েছেন। সমুদ্রের অবিরাম কলধ্বনির যে ঐক্যতানের সুর তার কানে বাজে সে সুর মানবতার দু’কূলকে প্লাবিত করে ভাসিয়ে নেয় আবহমান কালের পাঠকদের। শুধু পৃথিবী আর সমুদ্রের বন্ধন নয়, বিশ্ব ভুবনের প্রতিটি কণিকার সাথে তিনি অনুভব করেছেন আত্মীয়তার বন্ধন। আর তাই প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষের বাসভূমি এই তিনের পরস্পর সমন্বয়কে ঘিরেই তার সমাজ ভাবনার বৃত্ত আবৃত্ত হয়। এক কথায় পতিসরকে বাদ দিয়ে সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ও প্রজাহিতৈষী রবীন্দ্রনাথকে অন্বেষণ ও অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

(তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রভুবনে পতিসর: আহমদ রফিক, যুক্তবঙ্গের স্মৃতি: অন্নদাশঙ্কর রায়, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ