প্রথাবিরোধী নির্ভীক হুমায়ুন আজাদ

প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০১৬, ১১:৫৬

অনন্য আজাদ

অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনার দেশ আমাদের বাঙলাদেশ। এখানে অক্ষমের হাতে ক্ষমতার দণ্ড, শাসকের কর্মকাণ্ডে শোষকের নিপীড়ন। এদেশে বিদ্বানের অবস্থান রাজপুরুষের নিচে বলে বিদ্যৎমণ্ডলী রাজানুগ্রহ লাভের জন্য শাসকগোষ্ঠীর দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। এ সমাজে অকস্মাৎ এমন একজনের দেখা মেলে যিনি রাজকীয় বেশের পরোয়ানা না করে তাঁর জীর্ণ বস্ত্রেই মানব জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে জীবন উৎসর্গ করে যেতে পারেন। রাজা প্রজা কারো কাছেই অবনত মস্তকে আনুগত্য স্বীকার না করে জীবন দিয়ে যেতে পারেন। এরকম একজন মানুষ ছিলেন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী মৌলবাদী সন্ত্রাসী ঘাতকদের অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়ে পরিনামে অপরিণত বয়সেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর অপরাধটি ভয়ংকর ছিল। অপরাধ ছিল, যুক্তির বাইরে কিছু মানতে না চাওয়া, অপরাধ ছিল প্রচলিত সকল প্রথা-গোঁড়ামি-সংস্কার তথাকথিত নিষিদ্ধ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা। তিনি নির্ভয়ে দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন, শতাব্দী ধরে প্রচলিত প্রথাগুলো ভুল ছিল। প্রথার আড়ালে মানুষের বোধশক্তিকে বলি দেওয়া হচ্ছে সেটি উনি উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর অকাট্য যুক্তি দ্বারা তবে শৈল্পিকতা মোড়ানো ভাষায়। তাঁর আরও একটি অপরাধ ছিল; জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ। প্রতিটি স্তরে রেখেছিলেন তাঁর মননশীলতা প্রগতিশীলতা আর সৃষ্টিশীলতার পরিচয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পর্শকাতর কবি; সৃষ্টি করেছিলেন কোমল সৌন্দর্যমণ্ডিত টলমলে স্নিগ্ধ তবে প্রচণ্ড ধারালো তীক্ষ্ণ অনুভূতির কবিতা।

একই হাতে তিনি লিখেছিলেন জীবনের বিভিন্ন স্তর নিয়ে কঠিন বাস্তবের প্রতিচ্ছবি সম্মলিত উপন্যাস। যা পাঠককে ভাবায়, কল্পনা করতে বাধ্য করে, প্রশ্ন জাগায় মনে, ভাঙায় অনেক পুরাতন ধারণাকে, গড়ে নতুন ধারণা। কিশোরদের তিনি দিয়েছেন রূপকল্পের অসাধারণ স্বপ্নগ্রস্থ কিশোর উপন্যাস। তাঁর আরও একটি সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেন ভাষাবিজ্ঞানে প্রথম একটি অদ্বিতীয় গ্রন্থ লিখে- বাক্যতত্ত্ব। তাঁর আরেকটি অসাধারণ অবদান বাংলা ভাষা বিষয়ক রচনার সম্পাদিত গ্রন্থ বাঙলা ভাষা ১ম ও ২য় খণ্ড।

তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি সমালোচনা করেছিলেন। রাঘববোয়াল বাঘ সিংহ কারো সামনেই তিনি মাথা নত করেন নি। কারো স্তব করেন নি। যেখানে সবাই মুহুরর্মুহু স্তুতিবানে মাথা নত করে দাঁড়ায় , সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন মেরুদণ্ড সোজা করে ; যেমনটি দাঁড়ায় সুউচ্চ পর্বত। করেছেন সাহিত্যের সমালোচনা, ভেঙেছেন অনেক প্রথা, অনেক ভাবমূর্তি। বিভিন্ন স্তরের বোদ্ধারা অবাক বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে চেয়েছিলেন তাঁর দিকে; তীক্ষ্ণ বানীও ছুঁড়েছেন তাঁর দিকে। কিন্তু তিনি ছিলেন অদম্য। তীক্ষ্ণ বানীকে মোকাবেলা করেছেন আরও সূক্ষ্ম সূচালো যুক্তি দিয়ে। অপরাধ ছিল এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তিনি নারীবাদী ছিলেন। তিনি মুক্ত করতে চেয়েছিলেন সমাজের মরচে ধরা শেকল থেকে নারীকে। দেখাতে চেয়েছিলেন মুক্ত আকাশ যেমন পুরুষের , ঠিক ততটাই নারীদের। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি সমালোচনা করেছিলেন আমাদের দেশের তথাকথিত রাজনীতিকদের। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি প্রচলিত সকল আদিম ধারণার অসাড়তা প্রমাণ করেছিলেন। সমাজের মহাপুরুষগণ যে আদিম অদৃশ্য শক্তির কথা প্রচার করেছিলো তিনি সে’সবের ধ্রুবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যা খান খান করে ভেঙে দেয় অনেক সেজদাকারি, মূর্তি পূজারিদের যুক্তিহীন ধারণাকে।

তিনি জন্মেছিলেন প্রচন্ড আলোকিত রোদে। তাই কখনো কোনো অন্ধকার পশ্চাদমুখী মরচে ধরা মতবাদে নিজেকে বন্ধি রাখেন নি। তিনি জন্মেছিলেন স্বাধীন পরিবেশে, তাই কখনো কোন শৃঙ্খলতায় নিজেকে বাঁধেন নি। বরং যখনই কোন শেকল এসেছে তাকে বাঁধতে উনি প্রচণ্ডভাবে তা ছিন্ন করেছেন। উনি সততায় বিশ্বাসী ছিলেন, তাই মুখোশ ধরে টান দিয়েছিলেন ভন্ডদের। উনি সত্যভাষী ছিলেন, তাই সহজেই বের হয়ে আসতো তীব্র সত্য উনার মুখ দিয়ে, যা প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখে কষে চড় মারে। সর্বোপরি তিনি প্রচন্ড থাবা বসান মৌলবাদীদের ঘাড়ে। উনার হাতে ছিল একটি প্রচন্ড শক্তিশালী হাতিয়ার, যা দিয়ে উনি জম্ম দিয়ে গেছেন তীব্র থেকে তীব্রতর এক একটি গ্রন্থ। যেখানে উনি প্রকাশ করেছেন নিজের প্রচন্ডতা, উন্মেষ করেছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল ভন্ড মৌলবাদীদের ঘিন ঘিনে কুৎসিত ভয়াবহ জঘন্যতম রূপ। একে একে নগ্ন করতে থাকেন তিনি মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের আসল চেহারা। প্রকাশ করেন ধর্মের আড়ালে থেকে কী ভয়াবহ বীভৎস মানসিকতার অধিকারী তারা। স্বার্থ আদায়ে তারা হাতে রাখা পবিত্র কিতাবকেও বিক্রি করতে পারে, মুখে জাহান্নাম বেহেস্তের কথা বলে দুর্নীতি হত্যা লুট ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট কাজে লিপ্ত হতে পারে তা তিনি উন্মুক্ত করেছিলেন সবার সামনে, যা সহ্য হয় নি তাদের। ভীত নড়ে গিয়েছিল তাদের। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আদিম বর্বরোচিত উপায়ে। নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল তাঁর হাতের শক্তিশালী হাতিয়ারটিকে, বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল তাঁর কন্ঠনালীকে।

যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি না দিয়ে তারা তাদের আসল রূপেই পিছন থেকে হামলে পড়ে। ব্যর্থ হয়, সফল হয় আরও পরে। কিন্তু মুর্খদের জানা নেই, মুল্যবোধকে ধবংস করা যায় না, সত্যকে চেপে রাখা যায় না, অখন্ড যুক্তিকে চাপাতি দিয়ে ফালি ফালি করা যায় না। তারা জানে না দুর্নিবার দুর্বিনীত অকুতোভয় চেতনাকে নির্বাণ করা যায় না। তিনি আহত হয়েছিলেন, কিন্তু দমে যান নি। মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসে তিনি আরও তীব্র বেগে এগিয়ে গেছেন । তাঁর হাতের কলম সহস্র চাপাতিধারীকে আঘাত করে আরও দ্বিগুণ বেগে। যার জন্ম হয়েছিলো রুখে দাঁড়ানোর জন্য-তিনি চাপাতির প্রচণ্ড আঘাতের সামনেও অটল ছিলেন। তাই তাঁর আদর্শ আজও অম্লান, তাঁর তেজোদৃপ্ত সত্য আজও ভন্ড মুখোশধারী কূপমন্ডুক মৌলবাদীদের বিশ্বাসে ফাটল ধরায়।

মৃত্যুর বারো বছর পরও তাদের বুক কেঁপে উঠে হুমায়ুন আজাদের নাম শুনলে। আজও তারা রাতে ঘুমে দুঃস্বপ্নে চিৎকার করে উঠে এই ভেবে, হুমায়ুন আজাদের কলম থেকে বের হয়ে আসা চাপাতি তুল্য তীক্ষ্ণ ধারালো অখণ্ডনীয় যুক্তিগুলো তাদের ধ্বংস না করে দেয়। তাই মাঝে মাঝে তারা অস্থির হয়ে উঠে। দেহকে তারা ধ্বংস করেছিলো। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার যোগ্যতা নেই বলেই বার বার সেই নশ্বর দেহের উপরই আক্রমণ চালায় যা তাঁর প্রিয় বাঙলার মাটির সাথে মিশে গেছে বহু আগেই। কাপুরুষরা মনে করেছিলো, তাঁকে ধ্বংস করতে পারলেই তাঁর সৃষ্টিও ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু এটি তাদের বোধের বাইরে যে সৃষ্টিকারীকে ধ্বংস করা যায়, সৃষ্টি’কে নয়। অট্টালিকাকে গুঁড়িয়ে ফেলা যায়, পর্বতকে নয়। হুমায়ুন আজাদ জয়ী। উনি জয়ী কারণ ওঁর সৃষ্টি আজও বেঁচে আছে, ওঁর সৃষ্টি দিন দিন হাজারো সাহসীর জন্ম দিচ্ছে, হাজারো মাথায় প্রশ্ন জাগাচ্ছে, হাজারো ঘরে নারীবাদী জন্ম নিচ্ছে, সংস্কার ভাঙছে, অলৌকিকতার পরিবর্তে মানবদৃষ্টিকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনছে। এবং হুমায়ুন আজাদ তাঁর সৃষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকবেন যতদিন একজনও সৎ নির্ভীক যুক্তিবাদী মানুষ থাকবে এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ