একজন তারেক মাসুদ ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৬, ১২:৩৪

বাংলার এক বিশাল অপূর্ণতা আজও রয়ে গেছে চলচ্চিত্রের জগতে। আজ থেকে ৫ বছর আগে ঠিক এ দিনটিতেই হারিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের সেলুলয়েড জগতে অসামান্য কারিগর তারেক মাসুদ। নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’ নির্মাণের লোকেশন দেখে ফেরার পথে ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর সহ পাঁচ জন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারেক মাসুদ দিয়েছেন তাঁদের সবটুকুই। কিন্তু কেন জানি এ মানুষগুলো হন ক্ষনজন্মা। খুব বাড়াবাড়ি রকমের অল্প সময়ের মধ্যে বিদায় নেন তাঁরা। যেমন বলা যেতে পারে বাংলার অনবদ্য ও অন্যতম দুই নির্মাতা জহির রায়হান ও আলমগীর কবির। 

বাংলাদেশের এ দুই গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকারের ছবির বিষয়বস্তু আর নির্মাণশৈলী ছিল গতানুগতিক বিনোদনধর্মী ছবি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দু’জন পরিচালকই তাঁদের কাজ দিয়ে অন্য পরিচালকদের বক্তব্যধর্মী ছবি নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। দুঃখজনকভাবে দু’জন পরিচালকেরই ঘটেছে অকালমৃত্যু।

‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০), ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি নির্মাণের পর জহির রায়হান যখন চিন্তাশীল কাজ করার জন্য আরো পরিণত এবং প্রস্তুত হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ১৯৭২ সালে মিরপুরে বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের ওপর পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠীর হামলার একটি দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত জহির রায়হান নিখোঁজ হন। তাঁর অনেক আগ্রহের অসমাপ্ত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ তিনি আর শেষ করে যেতে পারেননি।

 

আলমগীর কবির সত্তর ও আশির দশকে তৈরি করেছিলেন নান্দনিক দিক দিয়ে আকর্ষণীয় ও বক্তব্যধর্মী বিভিন্ন ছবি। এছাড়া একজন চলচ্চিত্র শিক্ষক হিসেবেও তিনি পালন করছিলেন আগ্রহী তরুণদের নির্মাতা হিসেবে প্রস্তুত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ১৯৮৯ সালে এক মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান তিনিও।

এবার বিশেষতঃ আমার দৃষ্টিতে তারেক মাসুদ ও বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু কথা বলা যাক। খুব একটা যে বলা যাবে তা নয়। এ মানুষটিকে লিখতে বা বলতে গেলে কম পড়ে যায় সবকিছুতেই। মূলধারার বাণিজ্যিক ও বিনোদনধর্মী ছবির মূলনীতি সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করে চিন্তাশীল ও প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণের কারিগর তারেক মাসুদ। তাঁকে বলা যায় বাংলাদেশের বিকল্প ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একজন পরিচালক। যিনি পরিচিত চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।

সাহসিকতার সাথে নিয়মিতভাবে বক্তব্য ও নির্মাণশৈলীর দিক থেকে গতানুগতিকতা ধারামুক্ত রেখে যে ক’জন পরিচালক ছবি নির্মাণ করেছেন তাঁদের মধ্যে তারেক মাসুদও একজন।

ফরাসি, জার্মান বা ভারতীয় নতুন সিনেমার মতো নতুন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যে একটি শক্তিশালী ধারা সৃষ্টি হয়েছে তা খুব একটা দেখা যায়না। ভারত, ব্রাজিল, ইরান, সেনেগাল প্রভৃতি তৃতীয় বিশ্বের দেশের বিকল্প ধারার বিভিন্ন ছবি বিশ্ব চলচ্চিত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে তৈরি শৈল্পিক ও সমাজসচেতন চলচ্চিত্রগুলো বিশ্বে যথেষ্ট পরিচিত নয়। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে এ ধরনের ছবির সংখ্যাও কম। নতুন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সেলুলয়েডের ভাষাকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য প্রয়োজন হয় কয়েকজন চলচ্চিত্রকারের উপস্থিতি, যাঁরা নির্মাণ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু চলচ্চিত্র। প্রথাবিরোধী কাজ করার ব্যাপারে তাঁদের আন্তরিকতা অনুপ্রাণিত করে অন্য অনেক নির্মাতাকে।

‘সিনেমার ফেরিওয়ালা’ কিংবা ‘ছবির কারিগর’ এ শব্দগুলো তাঁদের সাথে জড়িয়ে আছে আষ্ঠে পৃষ্ঠে। আমার চলচ্চিত্রের সাথে পরিচয়টা ঠিকঠাকভাবে শুরু হয়েছিল প্রথমত সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা সিরিজ’ ও ‘গুপি-বাঘা সিরিজ’র ছবিগুলো দেখে। তবে ছবির ধারা কিংবা ছবির গতিপথ বোঝা শুরু তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ ছবি দিয়ে। কোন অভিনয় নির্ভর ছবি নয় এটি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কিছু ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে অনবদ্য এক প্রামাণ্যচিত্র (ডকুমেন্টারি) তৈরি করেন তারেক মাসুদ। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে পরিচয় করান এক অসীম গৌরবে মধ্য দিয়ে। 

তারেক মাসুদ বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন জীবনের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’। এরপর ১৯৯৫ সালে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনানির্ভর দু’টি প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ ও ‘মুক্তির কথা’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের পরিচিতি আনেন ভিন্ন আঙ্গিকে।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাঙালিরা যেমন অস্ত্র হাতে নেমেছিল, তেমনি ঢোল-করতাল, হারমোনিয়াম নিয়েও নেমেছিলেন কন্ঠযোদ্ধারা। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে গণসংগীত গেয়ে তাঁরা উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সচেতন করেছিলেন সাধারণ মানুষ ও শরণার্থীদেরকেও। ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হয় আমিও সেই দিনটিতে রয়েছি। চারিদিক থেকে যুদ্ধ আর মৃত্যুর খবর। অসহায় বাঙালির একাংশ তখন পাড়ি দিচ্ছিলো সীমান্তের ওপারে। নদীতে ফুলে ফেঁপে ওঠা বিভৎস লাশের ওপর শকুনের ভীড়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার এমন চিত্র সেলুলয়েডের মাধ্যমে মানুষের মাঝে যথাযথভাবে তুলে ধরেছিলেন খুব কম সংখ্যক নির্মাতা।

ছবিটির নেপথ্যে জানা যায়, মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের অভিপ্রায়ে এদেশের একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গ নেন। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামের দলের এই সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরনার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। এই শিল্পীদের সাথে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কারণের তিনি ডকুমেন্টারি তৈরি করতে পারেননি।

দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তারা আরো বিভিন্ন উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংরক্ষিত উপাদান সংগ্রহ করেন, বিশ বছর আগের সেই শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ করেন। লেভিনের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফুটেজের সাথে সংগৃহীত অন্যান্য উপাদান যোগ করে ছবিটি নির্মিত হয়।

এরপর ২০০২ সালে নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’। মুক্তিযুদ্ধ আশ্রিত নান্দনিক এই সিনেমা কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার পাশাপাশি জিতে নেয় সমালোচক পুরস্কার।

ষাটের দশকের উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপট হতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগের সময়ের একটি পরিবার কিভাবে যুদ্ধ ও ধর্মের কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার গল্প নিয়ে তৈরি এ চলচ্চিত্র। পরিচালকের নিজের ছোটবেলার কাহিনীর জীবনের উপর ভিত্তি করে এ ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত ধার্মিক বাবা কাজী সাহেব তাঁর ছোট্ট ছেলে আনুকে পড়াশোনার জন্য মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন। দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের পাশাপাশি আনুর মাদ্রাসাতেও চরম ও মধ্যপন্থী মতবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে। বিভক্তির এই একই চিত্র দেখা যায় গোঁড়া ধার্মিক কাজী ও তাঁর স্বাধীনচেতা স্ত্রী আয়েশার মধ্যে। ধর্মীয় উদারতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র এবং ইসলামের দুর্বোধ্যতা এ সব কিছু মিলিয়ে মাটির ময়না জাগতিক দ্বন্দ্বের একটি দৃশ্যমান প্রতিকৃতি, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটেও গ্রামের চিত্র তুলে ধরতে বেশ মূর্তিমান।

‘মাটির ময়না’ ছবিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য তারেক মাসুদ গ্রামের বাউল আর বয়াতিদের সংগীত ব্যবহার করেছেন। সচেতনভাবে ব্যবহৃত বিশেষ কয়েকটি সংগীত সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধতা, ধর্মীয় বিভক্তি, পীড়নমূলক আচরণ প্রভৃতি নেতিবাচক দিকবিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করেছে। ‘মাটির ময়না’ ছবিতে গ্রামীণ সংগীত তাই হয়ে উঠেছে চলচ্চিত্রের একটি স্বতন্ত্র ভাষা। 

বিভিন্ন গান এই ছবিতে বারবার কাহিনীর ধারাবাহিকতা ভেঙে দিতেও ব্যবহৃত হয়েছে। যখনই কাহিনীতে দর্শকের নিষ্ক্রিয়ভাবে নিমগ্ন হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখনই কোনো অর্থবহ সংগীত ব্যবহার করে পরিচালক দর্শককে নিমগ্ন হতে বাধা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ‘মাটির ময়না’ ছবিতে গান দর্শককে গতানুগতিকভাবে আনন্দ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়নি; বরং তা প্রয়োগ করা হয়েছে দর্শকের চিন্তার সক্রিয়তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। এ পদ্ধতি তাই হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের আর্ট সিনেমায় প্রায়ই ব্যবহৃত ‘ব্রেখটিয়ো’ কৌশলের অনুরূপ।

এ ছবিটি প্রথম বাংলাদেশি সিনেমা হিসেবে অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ২০০৪ সালে ছবিটি ব্রিটেনের ডিরেক্টরস গিল্ড পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। এর পর তারেক মাসুদ ২০০৬ সালে নির্মাণ করেন ‘অন্তর্যাত্রা’। 

সর্বশেষ যে ছবিটি তিনি নির্মাণ করেন, তার নাম ‘রানওয়ে’। এ ছবিটি বর্তমান সময়ের সাথে এমন ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যা দেখলে মনে হবে তারেক মাসুদ একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। বর্তমান সময়ে জঙ্গিবাদ যেভাবে বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, ঠিক এ বিষয়টি নিয়েই তিনি তৈরি করেছিলেন চলচ্চিত্রটি।

মূল চরিত্র রুহুল গ্রামে এক মাদরাসায় পড়ত, একসময় সে চলে আসে ঢাকায়। রুহুলের বাবা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির সন্ধানে গিয়ে নিরুদ্দেশ। আর তাঁর পরিবার ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংলগ্ন একচালা ঘরে বসবাস করে। রুহুলের বোন ফাতেমা গার্মেন্টসে চাকুরিরত এবং প্রতিনিয়ত শোষণের শিকার। গন্ডগোলের কারণে দুই মাস বেতন পায় না। তার মা রহিমা ক্ষুদ্র ঋণ সমিতির মাধ্যমে একটি গাভী কিনে দুধ বিক্রি করে সংসার চালান।

রুহুল বেকার এবং হতাশ হলেও প্রচণ্ড আদর্শবাদী। চাকরি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে রুহুল উড়োজাহাজের ছায়ায় দিন কাটায়। মাঝেমধ্যে সে মামাকে সাইবার ক্যাফের ব্যবসায় সাহায্য করে এবং ইন্টারনেট শেখার চেষ্টা করে। সেখানে দৃঢ় অথচ শান্ত মেজাজের কম্পিউটার দক্ষ আরিফের সঙ্গে তার ক্রমশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আরিফ উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে রুহুলকে উদ্বুদ্ধ করে। তাকে বোঝাতে শুরু করে ইসলামের জিহাদের বিষয়ে, খিলাফতের বিষয়ে। একটা সময় আরিফের মাধ্যমেই আফগানিস্তান ফেরত মুজাহিদ দলনেতার জঙ্গি শিবিরে শরিক হয় রুহুল। ধর্মীয় উগ্রবাদী আদর্শে উজ্জীবিত রুহুল বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। হঠাৎ একটা সময় সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় আরিফের স্কোয়াড। আরিফ আত্মঘাতি হামলায় আহত হয়ে মেডিকেলে ঢুকে। দ্বীন রক্ষার্থে গৃহত্যাগী রুহুল তখন নিজের বিবেকের সঙ্গে আরেক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। নান্দনিক জীবনের কক্ষচ্যুত রুহুল মায়ের দুধ মাখা হাতের আশ্রয়ে চলে আসে।

আরিফের চরিত্রটি আগাগোড়াই মুগ্ধ করে দর্শকদের। যমুনা বিহারের সময় জঙ্গি নেতার বিজ্ঞাপনী মানসিকতা দেখে, বাংলাদেশের সনাতনী সিনেমায় নিম্নবর্গের দর্শকদের অংশগ্রহণ, রুহুলের মামার শুদ্ধ ইংরেজি বলার ধরণ, পাথরকে মাঝে রেখে রুহুলের প্রেমালাপ, উড়ন্ত বিমানকে মাটিতে ফেলে দেওয়ার ক্রোধে গুলতি ছুড়ে মারার ইমেজগুলো দর্শকদের দেয় নির্মল আনন্দ।

এছাড়া তারেক মাসুদের উল্লেখযোগ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিগুলো হচ্ছে - ‘সোনার বেড়ি’, ‘একুশে’ ও ‘নরসুন্দর’। এ ছবিগুলো গতানুগতিকতা ধারাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এক দারুণ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ সব শেষ। আমাদের দেশে এমন চলচ্চিত্র খুব একটা হয়না বললেই চলে। নিত্য নতুন চলচ্চিত্রে লাইট, ক্যামেরা, গ্রাফিক্সের বহু কারসাজি থাকলেও সব কেমন যেন প্রাণহীন। আজও সেই ‘মাটির ময়না’ কিংবা ‘মুক্তির গান’ অথবা ‘নরসুন্দর’ দেখলে এখনো অন্য এক নতুনত্ব খুঁজে পাই। শুধু নতুনত্ব নয়, প্রতিটি ফ্রেম থেকে শেখা যায় নতুন করে।  

২০১২ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘একুশে পদক’ প্রাপ্ত নির্মাতা তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সব ধরনের অন্ধতা আর যুক্তিহীনতার বিরোধিতা।

যে স্বল্পসংখ্যক ছবি তিনি নির্মাণ করেছেন, তা আমাদের দেশের চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে সাহসিকতার সঙ্গে বক্তব্য প্রকাশ এবং ভাবনা আর নির্মাণশৈলীর গভীরতার কারণে। নিজের চলচ্চিত্র তিনি গতানুগতিকতামুক্ত করে তুলতে পেরেছিলেন, ফলে তা হয়ে উঠেছে প্রকৃত বিকল্প ধারার ছবি। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও প্রতিবাদী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব, তিনি সেই উদাহরণ রেখেছেন। 

প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী নবীন চলচ্চিত্রকারদের জন্য তারেক মাসুদের কাজ অনুপ্রেরণাময় হয়ে থাকবে সব সময়। তাঁর অপূর্ণতা পূরণ হয়তো কখনো হবে না। তবে যে ধরনের চলচ্চিত্র তারেক মাসুদ তৈরি করেছেন, আমাদের প্রত্যাশা সেই চিন্তাসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের ধারা সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশে শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ