এখন খুনই একমাত্র পাথেয় ধর্মের!

প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৬, ২৩:৫৮

বাংলাদেশের সংবিধান মত প্রকাশের যতটা স্বাধীনতা দিয়েছিল ততটাই কেড়ে নিয়েছিল ১৯৭৪’এর বিশেষ ক্ষমতা আইন দিয়ে। দুই দুইটি সামরিক জান্তার হাত দিয়ে বাংলাদেশ ও এদেশের রাজনীতি ধর্ষিত হয়েছিল।

এ দেশটি রাজনৈতিকভাবে যাঁরা জন্ম দিয়েছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই সামরিক জান্তার হাতে ১৯৭৪’এর বিশেষ ক্ষমতা আইনে জেল খেটেছেন। ১৯৯০’এর গণভ্যুত্থান পরবর্তী বিচারপতি শাহাবুদ্দিন সরকারের আমলে বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রেস ও পাবলিকেশন আইনটি রহিত করা হয়। তবে রাষ্ট্রের মালিক মোক্তাররা নানান কায়দায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে থাকেন অবিরত। যেমন এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন ৫৭ ধারা দিয়ে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার ব্যাপারে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এক কাতারেই সমাসীন।

৫৭ ধারায় প্রথমেই জেলে গিয়েছেন কয়েকজন ব্লগার। রাষ্ট্র ও মৌলবাদীরা ব্লগারদের মধ্যে জুজুর ভয় দেখছে। ধর্ম গেল গেল বলে রব উঠেছে। ফেসবুকে ও ব্লগে কে কি লিখলো তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ঘুম নাই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চোখে। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। ধর্মের ব্যাপারে কোন কিছু লেখা বরদাশত করা হবে না। পারলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজে পেতে ধরে আনেন ব্লগারদের, ধর্ম অবমাননার দায়ে। অনলাইনে খুনের হুমকি থ্রেট দেবার পরেও কোন মৌলবাদী চক্রের কাউকেও ৫৭ ধারা ছুঁতে পারেনি। 

কতজন ব্লগার ধর্ম নিয়ে লেখা লেখি করেন? কোন তথ্য আছে গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে?

ইতিমধ্যে যে সমস্ত ব্লগাররা খুন হয়ে গেছে তাঁদের মধ্যে সবাই কি ধর্ম নিয়ে লেখা লেখির কারণেই খুন হয়েছেন? নাকি তার মধ্যে কোন রাজনীতি আছে? আমরা রাজনীতিটি এড়িয়ে যেতে চাই সযত্নে।

কোন খুন হলেই আমরা দেখতে পাই, খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির বদন বইটির পাতা উলটানো শুরু হয়ে গেছে। ধর্ম নিয়ে কোন মন্তব্য থাকলেই হলো, মৃত ব্যক্তিটির চরিত্র হনন শুরু হয়ে যায়। যেন এ কারণেই ব্যক্তিটি খুন হয়ে গেছে এবং খুনটি জায়েজ!

রাজশাহীতে গত ক’বছরে চারজন শিক্ষক খুন হয়ে গেছেন। এদের মধ্যে কেউ কি ব্লগে লিখতেন?

কেবলমাত্র রাজনীতির কারণেই তাঁদের খুন করে ফেলা হয়েছ। খুন হয়ে যাওয়া একজন শিক্ষকও মৌলবাদী রাজনীতির সাথে জড়িত নন। রাজনীতির মাঠে সক্রিয় না থাকলেও, কোন শিক্ষককেই মৌলবাদীরা রেহাই দেয়নি, প্রত্যেকেই খুন হয়ে গেছেন। রাজশাহীর শিক্ষক হত্যাকাণ্ডে কোন রাজনীতি নাই এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই রাজশাহীতে বাংলা ভাই’এর নেতৃত্বে বিশ কিলোমিটারের বেশী সশস্র মিছিল হয়েছিলো। কথা উঠতে পারে বাংলা ভাই’এর ফাঁসি হয়েছিলো। এক বাংলা ভাইকে ফাঁসি দিয়ে এ রাজিনীতির উচ্ছেদ সম্ভব কিনা?

খুন হয়ে যাচ্ছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। আহলে হাদিস’এর মসজিদে নামাজরত মুসল্লীদের উপর গুলি করা হয়েছে। মারা গিয়েছেন ইমামসহ কয়েকজন। খুন হচ্ছেন মাজারের খাদেম, গির্জার ফাদার। খুন হচ্ছেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব।

সম্প্রতি টাংগাইলের গোপালপুরে একজন দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দারকে খুন করেছে মৌলবাদীরা। অভিযোগ নিখিল ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করেছে। নিখিলের বিরুব্ধে মামলা দিয়েছিলো ৭১’এর খুনি কথিত মাওলানা রাজাকার মানান’এর দৈনিক ইনকিলাবের গোপালপুরের প্রতিনিধি। 

দৈনিক ইনকিলাবের রাজনীতিটি যদি আমরা ধর্তব্যের মধ্যে আনি, দেখতে পাবো আগাগোড়া সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে পত্রিকাটি। নিখিল জেলে ছিলো, এলাকার নেতৃস্থানীয়দের হস্তক্ষেপের পর মামলা তুলে নেয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে নিখিল পালিয়েছিলো। পলাতক নিখিলের দোকানের সাটারে কারা নীল কালিতে লিখেছিলো আদালত জামিন দিয়েছে আমরা জামিন দেইনি? ছমাস বেঁচেছিলো নিখিল এরপর চাপাতির কোপে ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছে হতদরিদ্র নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দার।

এখন বিভিন্ন জায়গায় হেফাজত - জামাতের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষকদের উপর ফতোয়া দেয়া হচ্ছে, যে তাঁরা ধর্ম বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন ক্লাসে। সম্প্রতি বাগেরহাটে দু’জন শিক্ষককে ক্লাসে অবরুব্ধ করা রাখে মৌলবাদীরা। এক পর্যায়ে ‘হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী (৪৬) ও গণিতের শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষালকে (৫৫) ৬ মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। চিতলমারী উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনোয়ার পারভেজ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এই দণ্ডাদেশ দেন।’ এটি ২৫শে এপ্রিলের সংবাদ।

ইতোমধ্যে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার একটি স্কুলেও একজন সনাতন ধর্মের একজন নারী শিক্ষককে উন্মত্ত জনতা (এ জনতার পেছনেও হেফাজত) পুলিশে দিয়েছে ধর্ম অবমাননার দায়ে। ঐ নারী শিক্ষকের কপাল ভালো কেবল পুলিশে দিয়েছে, ধর্ষণ করেনি ৭১’এর মত। কেউ কোন তদন্ত করেনি। তদন্তের দায়ভার কাঁধে নিতে চায়নি কেউ? ঘুষখোর মাতাল পুলিশেরও ধর্ম আছে। কাজেই তদন্ত কি হবে? আগাম বলে দেয়া যায়। 

কারণটি স্পষ্ট হেফাজতকে চটানোর মত ঝুঁকি নিতে চায়নি কোন পক্ষই। রাজনীতির মাঠে হেফাজতের ট্রামকার্ড হচ্ছে ধর্ম। এটি বিক্রি করে হেফাজত সরকারের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়েছে, নিয়েছে রেলওয়ের জমি। তেঁতুল হুজুরের (শফী) পুত্রের সম্পদ এখন চোখ ধাঁধায়। ধর্ম বাণিজ্যের রমরমা এখন তেঁতুল হুজুরের (শফী) পুত্র আনাস’এর। পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে আনাস’এর সম্পদের মায়াবী ছবি।

একজন ধর্মান্তরিত মুক্তিযোব্ধা হোসেন আলী সরকার খুন হয়ে যান। যিনি ধর্মান্তরিত হয়েছেন প্রায় ১৭ বছর আগে। কে কত বছর আগে ধর্মান্তরিত হয়েছেন? এটি বাইরে থেকে কারও জানার কথা না। তেমনি জানার কথা না ক’ঘর আহলে হাদিস আছে কোন গ্রামে? রয়েছেন গির্জার ফাদার কোন বাড়িটিতে?

স্থানীয় রাজনীতির কোন যোগসাজস না থাকলে এ খুনগুলো করা যেত না। খুনের রাজনীতির সাথে কোন না কোন পর্যায়ের স্থানীয় রাজনৈতিক যোগসাজস আছে, এটি গোয়েন্দা না হলেও বোঝা যায়। বাইরে থেকে আদিষ্ট হয়ে খুন করে যাবে, এমন পেশাদারিত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও জন্মায়নি। যাকে খুন করা হবে তাঁর তথ্য উপাত্ত জানার জন্যও স্থানীয় কোন না কোন রাজনৈতিক দল জড়িত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামার পরেই ঘাড়ে কোপ খেতে হচ্ছে ব্লগারদের। সাথে খুনের বহরে যুক্ত হচ্ছেন রাজনীতির মাঠ দখলের বার্তা দেয়ার জন্য বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষজন। একটু একটু করে মুক্তিযুব্ধের বাংলাদেশের রাজনৈতিক জমি দখলে নিচ্ছে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী।

ক্ষমতাসীনদের সুশাসনের অভাবের দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে হেফাজত। একটু একটু করে কচ্ছপের মত করে দখলে নিচ্ছে রাজনৈতিক ভূমি। স্কুল মাষ্টার, মাজারের খাদেম, গির্জার ফাদার ও মন্দির – মঠের পুরোহিত এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব খুন হওয়াটাই শেষ না। এটি বার্তা দিচ্ছে যে, আমরা আসছি, আমাদের কথাই শুনতে হবে। স্থানীয় রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখছে একদল মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনার মানুষ। যাদের কাছে মানুষ হত্যায় কোন পাপ বা অনুশোচনা নাই। হত্যায় মুক্তি মিলবে ইহজগত থেকে পরলৌকিক অপার্থিব জগতে। সেখানে জগতের কোন কোন পরিবারকে নরকে নিক্ষেপ করতেও দ্বিধা নাই। খুনই একমাত্র পাথেয় এখন ধর্মের! ধর্মের বিকাশের জন্য এখন খুনকে সমার্থক করে ফেলা হয়েছে!

আমি জানিনা ছ’মাস জেল খেটে বেড়িয়ে ‘শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী (৪৬) ও গণিতের শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষাল (৫৫)’ স্কুলে ফিরবেন কিনা? ফিরতে পারবেন কিনা? নাকি নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দার’এর মত অপেক্ষা করছে তাঁদের ঘাড়ে চাপাতির কোপ?

স্থানীয় রাজনীতির উপর চোখ না রাখলে বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হবে। ৭১’এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে আছে জামায়াত ও হেফাজত। ক্ষমতাসীনদের সুশাসনের অভাবজনিত ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি নির্লিপ্ততা ও বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বপনার সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো।

চক চকে ছুরির সামান্যই দেখা গেছে বাকিটা এখনও জোব্বার আড়ালেই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ