নয়ীম গহরের ‘জন্ম ধন্য হলো’ বটে!

প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০১৬, ১১:০৮

‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’- কালজয়ী এই গানটির জন্ম দিয়েছিলেন যিনি সেই নয়ীম গহর আজ মারা গেছেন। 

বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ার লক্ষ্যে নায়কের ভূমিকায় থেকে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়েছেন তাদেরই একজন নয়ীম গহর। ৭১ সালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি ‘বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ চট্টগ্রামে পৌঁছে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেও তিনি ইচ্ছে করেই মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র সংগ্রহ করেননি। ২০১৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা হিসেবে পেয়েছেন ‘স্বাধীনতা পদক’।

গান লেখার পাশাপাশি একজন ঔপন্যাসিক, গায়ক, অভিনেতা ও নাট্য রচয়িতা ছিলেন তিনি। বিবিসি বাংলার ভাষ্যকার ও সংবাদ পাঠক হিসেবেও কাজ করেছেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’র সূচনা সংগীত ‘ইচ্ছে করেই যারা ভুল করে’রও লেখক তিনি।

‘নোঙ্গর তোলো তোলো সময় যে হলো হলো’ কিংবা ‘পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে’ এমন সব গান লিখে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন যে মানুষটি সেই নয়ীম গহর মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করে যেতে পারেননি! 

এর জন্য আমিও অপরাধী।
আমি লজ্জিত।
আমি অনুতপ্ত। 

পারিবারিকভাবে নয়ীম গহর ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন। পরোপকারী এই মানুষটি একসময় সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়েন। অনেকে তার সরলতার আশ্রয় নিয়ে প্রতারণাও করে। শেষ বয়সে তার চিকিৎসা চালাতেও হিমশিম খেতে হয় পরিবারকে।

২০০০ সালে তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল। কয়েক বছর ধরে তিনি চলাচলে অক্ষম ছিলেন। ছয় মাস আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে তার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছিল। গত মাসে তার উরুতে একটি অস্ত্রোপচারের পর সেখানে পঁচন ধরে। দীর্ঘদিন বিছানায় থেকে তার পিঠেও ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিলো। মুখ দিয়ে খাবার খাওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।

৭৮ বছর বয়সে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে অর্থাভাবে কষ্ট করছেন। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতার কথা শেষ পর্যন্ত তাকে ভাবতে হয়েছিলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

এমন এক পরিস্থিতিতে তাঁর মেয়ে ইলোরা গহর আমাকে একদিন জানালো, তাঁর বাবার মৃত্যুপূর্ব ইচ্ছা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করা। সে বলল, আমি কোনওভাবে ব্যবস্থা করতে পারব কী না। তারপর থেকে একে একে কতজনকে ধরলাম, কতজনের কাছে ধর্না দিলাম, কত ‘ফর্মালিটিস মেইনটেইন’ করলাম, কত আশ্বাস পেলাম; ফলাফল শুন্য। অর্থনৈতিক লাভের বিষয় ছাড়া সামাজিক কিংবা মানবিক বিষয় নিয়ে গেলে ‘তাঁরা’ বিরক্ত হন।

ইলোরা আপডেট জানার জন্য আমাকে অনেকবার ফোন করেছে। তাকে আমার চেষ্টার কথা জানিয়েছি। সম্ভাবনার কথা জানিয়েছি। ফলাফল শুন্য।

ইলোরার বড় বোনের সাথে নয়ীম গহরকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি নির্মাণের ব্যাপারে কথা হয়েছিলো। তিনি একদিন ফেসবুকে লিখলেন, ‘আপনি অনেক দেরি করে ফেলছেন’। 

সত্যি অনেক দেরি করে ফেলেছি। 
এর জন্য আমি অপরাধী।
আমি লজ্জিত।
আমি অনুতপ্ত। 
নয়ীম গহর লিখেছিলেন, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো...’ 
কিন্তু স্বাধীন দেশে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা হিসেবে ‘স্বাধীনতা পদক’প্রাপ্ত নয়ীম গহর তাঁর শেষ ইচ্ছা, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার ‘শিডিউল’ পাননি। আর কখনও পাবেন না। 
তাঁর জন্ম ধন্য হয়েছে বটে!

লেখক: রাকিবুল হাসান, চলচিত্র পরিচালক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ