কুশুম্বা মসজিদ

প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০১৭, ১২:২১ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:৩৭

নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলা। আত্রাই নদীর পশ্চিমতীরে ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই গ্রামটির নাম কুশুম্বা। এখানকার প্রায় সাড়ে চারশো বছর প্রাচীন কুশুম্বা মসজিদের কারণে কুসুম্বা গ্রাম ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। কুশুম্বা মসজিদ নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলাধীন ৮ নং কুশুম্বা ইউনিয়নের কুশুম্বা গ্রামে নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে উপজেলা সদর হতে তিন মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। মসজিদের সন্মুখভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি। যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে। মসজিদের প্রবেশ পথের ‌একটু দূরে বাক্স আকৃতির একখণ্ড কালো পাথর দেখা যায়। এটিকে অনেকে কবর বলে মনে করেন। 

জানা যায়, জনৈক কৃষক হাল চাষের সময় তার জমিতে পাথরটির সন্ধান পায়। সম্ভবত তার প্রচেষ্টায় পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছিল। এই পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবিতে লেখা রয়েছে, ‘আল মালেকু মা হুমম মোকারারামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আসরাফ আল হোসেন।’ যার অর্থ ‘তিনি শাসক যিনি পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হুসেনের পুত্র আবুল মোজাফর হোসেন শাহ।’ এ থেকে বোঝা যায় প্রস্তুর খণ্ডটি হুসেন শাহের আমলের স্মৃতি বিজড়িত। 

জনশ্রুতি আছে, সবরখান বা সোলায়মান নামে জনৈক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দুটি শিলালিপির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তবে মূল প্রবেশ পথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় এই মসজিদটি ৯৬৬ হি. বা ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দের। তখন ছিল শের শাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দীন বাহাদুরের শাসনামল।

মসজিদের পূর্বদিকের কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারের উপরে স্থাপিত আরবিতে (শুধু নির্মাতা শব্দটি ফারসিতে) উৎকীর্ণ শিলালিপি অনুসারে এ মসজিদের নির্মাণকাল ৯৬৬ হিজরি (১৫৫৮-৫৯ খ্রি.)। মসজিদটি শূর আমলে নির্মিত হলেও এ মসজিদে উত্তর ভারতে ইতোপূর্বে বিকশিত শূর স্থাপত্যের প্রভাব মোটেই দেখা যায় না, বরং এটি বাংলার স্থাপত্য রীতিতেই নির্মিত। ইটের গাঁথুনি, সামান্য বক্র কার্নিশ এবং সংলগ্ন অষ্টকোণ আকৃতির পার্শ্ববুরুজ প্রভৃতি এ রীতির পরিচয় বহন করে। এ মসজিদটি ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আঙ্গিনার ভেতরে মসজিদটি অবস্থিত। এ আঙ্গিনায় প্রবেশের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় একটি প্রবেশদ্বার যেখানে প্রহরীদের দাঁড়ানোর জায়গা রয়েছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত। মসজিদটির মূল গাঁথুনি ইটের তৈরী হলেও এর বাইরের দেওয়ালের সম্পূর্ণ অংশ এবং ভেতরের দেওয়ালে পেন্ডেন্টিভের খিলান পর্যন্ত পাথর দিয়ে আবৃত। এর স্তম্ভ, ভিত্তিমঞ্চ, মেঝে এবং পাশের দেওয়ালের জালি নকশা পাথরের তৈরী। আয়তাকার এ মসজিদ তিনটি ‘বে’ এবং দুটি ‘আইলে’ বিভক্ত। পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি পশ্চিম দেওয়াল থেকে সামান্য অভিক্ষিপ্ত।

অভ্যন্তরভাগের পশ্চিম দেওয়ালে (কিবলা দেওয়ালে) দক্ষিণ-পূর্ব দিকের এবং মাঝের প্রবেশপথ বরাবর মেঝের সমান্তরালে দুটি মিহরাব আছে। তবে উত্তর-পশ্চিম কোণের ‘বে’তে অবস্থিত মিহরাবটি একটি উচু প্লাটফর্মের মধ্যে স্থাপিত। পূর্বদিকে স্থাপিত একটি সিঁড়ি দিয়ে এ প্লাটফর্মে উঠা যায়। কুসুম্বা মসজিদের মিহরাবগুলি খোদাইকৃত পাথরের নকশা দিয়ে ব্যাপকভাবে অলংকৃত। এগুলিতে রয়েছে বহুখাজ বিশিষ্ট খিলান। সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত পাথরের তৈরী স্তম্ভের উপর স্থাপিত এ খিলানগুলির শীর্ষে রয়েছে কলস মোটিফের অলংকরণ। স্তম্ভগুলির গায়ে রয়েছে ঝুলন্ত শিকল ঘন্টার নকশা। মিহরাবের ফ্রেমে রযেছে প্রায় সর্পিল আকারে খোদিত আঙ্গুর গুচ্ছ ও লতার নকশা। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় বিন্দুর আকার ধারণকারী কলস, বৃক্ষলতা ও গোলাপ নকশা। প্লাটফর্মের প্রান্তেও রয়েছে আঙ্গুর লতার অলংকরণ। আর এ প্লাটফর্মের ভারবহনকারী খিলানের স্প্যান্ড্রিল এবং মসজিদের কিবলা দেওয়াল জুড়ে রয়েছে গোলাপ নকশা।

বাইরের দেওয়ালে আস্তরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে পাথরগুলি অমসৃণ পাথর। পাথরগুলোতে রয়েছে গভীর খোদাইকার্য। বাইরের দিকে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন লাগে ছাঁচে ঢালা অলংকরণসমূহ। এগুলি দেওয়াল গাত্রকে উচু নিচু অংশে বিভক্ত করেছে। এ ছাড়া বক্র কার্নিশ জুড়ে, পাশ্ববুরুজগুলিকে ঘিরে এবং কার্নিশের নিচে একই ধরনের অলঙ্করন ছড়িয়ে আছে। পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের গায়ে আয়তাকার খোপ নকশাকে ঘিরে ফ্রেম হিসেবে ছাঁচে ঢালা অলংকরণ রয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের খিলানের স্প্যান্ড্রিল ছোট ছোট কলস ও গোলাপ নকশায় পরিপূর্ণ। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে রয়েছে জালি ঢাকা জানালা।

সূত্র :
উইকিপিডিয়া 
Ahmad Hasan Dani, Muslim Architecture in Bengal, Dacca, 1961;
Catherine B Asher, Inventory of Key Monuments, in George Michell (ed),
Islamic Heritage of Bengal, Paris: UNESCO, 1984.