‘প্রাইজমানির টাকার খাবার ছিল বলে বাসার কেউ খায়নি’

প্রকাশ : ১১ জুন ২০১৭, ২০:৪৭

সাহস ডেস্ক

পৃথিবীতে সেই আদিম যুগ থেকে বুদ্ধির খেলা হিসেবে পরিচিত দাবা। মানুষ নিজের বুদ্ধিকে আরও তীক্ষ্ণ করার জন্য দাবা খেলে থাকেন। বাংলাদেশেও বহু বছর যাবত দাবা খেলে আসছে। খেলছে দাবার বিশ্বকাপ।

আমাদের দেশেরই রয়েছে ৫ জন গ্র্যান্ডমাস্টার এবং রানী হামিদের মত কালজয়ী নারী দাবাড়ু। তবুও আজও নানান গোড়ামি ও কুসংস্কারের কারণে নারী দাবাড়ুরা নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।

নানান বাধা-বিপত্তি পাড় হয়ে অনেক নারী দাবাড়ুই আজ সফল, কিন্তু বাধা-বিপত্তি তাদের পিছু ছাড়েনি। তেমনি এক দাবাড়ু সাবিকুর রহমান তনিমা। আদ্ব-দ্বীন মহিলা মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করছেন। পড়াশুনার পাশাপাশি সেই ২০১০ সাল থেকে নিয়মিত দাবা খেলছেন। ২০১৬ সালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন দাবা জাতীয় দলে। প্রতিনিয়ত তিনি বিভিন্ন গোড়ামি ও কুসংস্কারের সাথে লড়াই করে খেলে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখেন দেশের হয়ে বিশ্ব দরবারে প্রতিনিধিত্ব করার। দেশের লাল-সবুজ পতাকা তুলে ধরতে চান সবার উপরে। তনিমার দাবার এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছেন মুনওয়ার আলম নির্ঝরের সাথে। টাইমস ওয়ার্ল্ডের পাঠকদের জন্য থাকছে তনিমার দাবার কোর্টে এবং সামাজিক গোড়ামির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প। ছবি তুলেছেন নিঠর জাহিদ।

২০১০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম দাবা খেলা শুরু করেন। ঐসময় ফেডারেশন বয়স ভিত্তিক একটি দাবা টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিল, যেখানে প্রথম অংশগ্রহণ করে তনিমা। তবে পরিবারের ঘোরতোর আপত্তি ছিল। এই শর্তে সে খেলার সুযোগ পায়, এই একবারই সে খেলবে আর কখনও দাবা খেলতে পারবে না। এই শর্তেই রাজী হয়ে কোন কোচ ছাড়াই, অনুশীলন ছাড়া অংশগ্রহণ করেন জাতীয় দলের এই তরুনী। তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে, সেসময় প্রসংশা করেন দেশের প্রখ্যাত নারী দাবাড়ু রানী হামিদ। কিন্তু রানী হামিদের মত দাবাড়ুর প্রসংশাতেও মন গলেনি তনিমার পরিবারের সদস্যদের। কারণ দাবা খেলাটা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম!!

কিন্তু তনিমা বদ্ধপরিকর দাবা খেলার ব্যাপারে। তাই সে তার পরিবারকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন এখানে হারামের কিছু নেই। তাতেও পরিবার রাজি না হলে তনিমা পরিবারকে বলে, সে যদি এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট করতে পারে তাহলে তাকে খেলতে দিতে হবে। সে এসএসসিতে ভাল ফলাফল করে পরের বছর ফের টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ভাল খেলে আলোচোনায় চলে আসে। কিন্তু তখনই পরিবার কোনভাবেই তনিমার দাবা খেলাটা মেনে নিতে পারছে না। এবার নতুন অভিযোগ ছেলেদের সাথে দাবা খেলাটা কতটা সঠিক!

এত ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যেও নিয়মিত খেলা চালিয়ে যাচ্ছে এই দাবাড়ু। আজও পরিবার মেনে নেয়নি তার এই দাবা খেলা। পরিবারের সমর্থন না পাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে তনিমা বলেন, গত বছর আমি একটা টূর্নামেন্ট খেলে বেশ বড় একটা প্রাইজমানি পেয়েছিলাম। এত টাকা প্রাইজমানি পেয়েছিলাম। আমি আনন্দে বাসার সবার জন্য অনেক খাবার কিনে এনেছিলাম। এই খাবার দাবার প্রাইজমানির টাকায় কেনা বলে বাসার কেউ খায়নি। আমি মনের কষ্টে সব খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন।

এমনকি প্রথম প্রাইজমানি পাওয়ার পরও সে টাকা বাসার কেউ গ্রহণ করেনি। উল্টো বলা হয়েছে, এই টাকার বড় অংশ যেন ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা হয়। সেই টাকা দিয়ে দুইটা হাদীসের বই এবং একজন মানুষকে খাওয়ানো হয়। তারপরও সেই টাকা কিংবা তনিমার দাবা খেলা কোনটাই পরিবার আজও মেনে নিতে পারেনি।

তনিমার পরিবার মনে করেন, মেয়ে দাবা খেলা মানে সে বেশ কুটিল বুদ্ধির অধিকারী হবে এবং তার বিয়ে দিতেও সমস্যা হবে। পাশাপাশি তারা বিশ্বাস করেন ধর্মীয় ভাবে দাবা খেলা ও প্রাইজমানি বিষয়টা সম্পূর্ণ হারাম।

তনিমার বাসায় দাবা খেলাটাকে এতটাই ঘৃণা করা হয় যে, সে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে সেই কথাটাই নিজ মুখে বলতে পারেনি ভয়ে। বান্ধবীদেরকে দিয়ে বলাতে হয়েছিল এমন একটি খুশির সংবাদ।

তনিমার নিজের কোন প্রশিক্ষক নেই। সে খেলা দেখে, পিডিএফ পড়ে, পুরাতণ ডাটা দেখে দেখে খেলা শিখছে এবং খেলছে। তিনি মনে করেন দেশের মেয়েদের দাবাতে আরও উতসাহীত করতে এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে নারী দাবাড়ুদের জন্য ভাল কোচ ও প্রশিক্ষকের প্রয়োজন।

তবে পরিবার ও সমাজের এত অসহযোগীতার পরও তনিমা আজ বেশ সফল। নিয়মিত টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করে। আর সে বিশ্বাস করে, মেয়েদের উচিত সাজ-গোজ, ভার্চুয়াল জগত আর প্রাচূর্যতার চিন্তা বাদ দিয়ে দাবা খেলে নিজের মেধাকে আরও বিকশিত করা।

এত কষ্টের গল্পের পাশাপাশি তিনি তার আনন্দ ও সাফল্যের গল্পও বলেছেন লাজুক হাসি দিয়ে। বলেছেন সবচেয়ে ভাল লাগে যখন সিনিয়ার দাবাড়ুরা খেলার প্রসংশা করেন। কিংবা খুব ভাল লাগে যখন বন্ধু কিংবা শিক্ষকরা বেশ সমীহ করে সেটা দেখতে।

তবে এত কিছুর পরও খেলাটা চালিয়ে যেতে চান তিনি। আর দেশের নামকে নিজের খেলার মাধ্যমে অনেক উপরে তুলে ধরতে চান।

কার্টেসি: টাইমস ওয়ার্ল্ড ২৪ ডটকম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত