‘বসনিয়ার কসাই’ ম্লাদিচের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১১:৫১ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১১:৫৪

অনলাইন ডেস্ক

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার পূর্বাঞ্চলীয় ছোট পার্বত্য শহর স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ‘বসনিয়ার কসাই’ খ্যাত সাবেক বসনিয়ান সার্ব কমান্ডার রাতকো ম্লাদিচকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (২২ নভেম্বর) এ সাজা দিয়েছে যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ তদন্তে গঠিত জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনাল।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ম্লাদিচের বিচারের এ রায়ের মাধ্যমে বিশেষ এ ট্রাইব্যুনাল যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ করল। এটিই ছিল ট্রাইব্যুনালের শেষ রায়।

১৯৯৫ সালের জুলাইয়ের ওই ঘটনায় অন্তত ৮ হাজার নিরস্ত্র মুসলিম পুরুষ ও বালককে হত্যা করা হয়েছিল, ম্লাদিচ ওই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের অভিযোগ।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ম্লাদিচ নেতৃত্বাধীন বাহিনীই স্রেব্রেনিৎসায় বসনীয় মুসলিমদের (বসনিয়াকস) নির্বিচারে হত্যা করে এবং সারায়েভোর দখল নেয়।

হেগের জাতিসংঘ ট্রাইবুনালে বুধবার ম্লাদিচের বিরুদ্ধে মোট ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মধ্যে ১০টিতে তাকে দোষীসাব্যস্ত করা হয় বলে জানায় বিবিসি। যার মধ্যে স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার পাশাপাশি সারায়েভো অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগও আছে।

তবে রায় ঘোষণার সময় ৭৪ বছরের ম্লাদিচ আদালতে উপস্থিত ছিলেন না।

বিবিসি জানায়, বিচারকদের বিরুদ্ধে চিৎকার করার কারণে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

ম্লাদিচ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন জানিয়ে তার আইনজীবীরা বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু বিচারকরা সেই অনুরোধে সাড়া দেননি।

যদিও এদিন শুরুতে তাকে ভারমুক্ত ও হাসিখুশি দেখাচ্ছিল এবং তিনি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে পোজ দিচ্ছিলেন।

ম্লাদিচ তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তার আইনজীবীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলেও জানিয়েছেন।

তাদের ভাষ্য, সার্ব বাহিনী ও তার মিত্রদের গণহত্যা এবং বেসামরিকদের ওপর ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানে’ ম্লাদিচের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ মেলেনি, যে কারণে অভিযুক্ত হলেও তাকে ১৫ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেয়ার সুযোগ নেই।
ম্লাদিচের অপরাধ:

১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সার্ব বাহিনী সারায়েভো অবরোধ করে রেখেছিল। তাদের নিক্ষেপ করা গোলা ও স্নাইপারদের গুলিতে প্রায় ১১ হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

বসনিয়া যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ সার্বিয়ার সীমান্তের কাছে অবস্থিত স্রেব্রেনিৎসাকে ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ডাচ সদস্যরা এলাকাটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল।

১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই ম্লাদিচের বাহিনীর আচমকা আক্রমণে হতবিহ্বল ডাচ শান্তিরক্ষীরা আত্মসমর্পণ করে।

সার্ব বাহিনী এরপর শহরটির পুরুষ ও বালকদের নারীদের কাছ থেকে আলাদা করে। পুরুষদের বাসে করে সরিয়ে নিয়ে কিংবা দূরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

পরদিন ব্রোঞ্জের বর্ম পরা ম্লাদিচ স্রেব্রেনিৎসার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ক্যামেরার সামনে তিনি শিশুদের মাঝে চকোলেট ও মিষ্টি বিলি করেন বলে জানান স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যায় ছেলে ও স্বামী হারানো মুনিরা সুবাসিচ। ক্যামেরার সামনে তিনি (ম্লাদিচ) বলছিলেন কিছুই হবে না এবং আমাদের ভয় পাওয়ারও কারণ নেই।

ক্যামেরা চলে যাওয়ার পর তিনি তার সৈন্যদের যাকে যাকে হত্যা করা যায় তাদেরকে হত্যা করতে, যাকে যাকে ধর্ষণ করা যায় তাদেরকে ধর্ষণ করার নির্দেশ দেন। সবশেষে আমাদের বলেন স্রেব্রেনিৎসা থেকে পালিয়ে যেতে, যেন তিনি সেখানে ‘জাতিগতভাবে শুদ্ধ’ একটি শহর প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, বলেন মুনিরা।

ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর মিসিং পারসনের (আইসিএমপি) কর্মীরা পরে স্রেব্রেনিৎসার গণকবর থেকে মুনিরার ছেলে নারমিন ও স্বামী হিলমোর দেহাবশেষ উদ্ধার করে। গণকবরগুলোতে পাওয়া দেহাবশেষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে প্রায় ৭ হাজার নিহতের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয় বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

মুসলমান নিয়ন্ত্রিত বসনিয়ার সরকারি বাহিনীর ঘাঁটি হওয়ায় সারায়েভো সার্ব বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল এবং এ কারণেই শহরটি দীর্ঘদিন ধরে অবরোধ করে রাখতে হয়েছিল বলে জানান ম্লাদিচের আইনজীবিরা।

সার্ব বাহিনী যখন স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যা চালায় তখন ম্লাদিচ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না এবং পরে ঘটনা শুনে মর্মাহত হন বলেও দাবি তাদের।

গণহত্যার দায়ে ম্লাদিচের বিচার চললেও যুগোস্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিম-ক্রোটদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দ্রুতগতিতে সার্বদের হয়ে বসনিয়ার ৭০ শতাংশ দখলে নেওয়ায় এখনও অনেকের চোখেই তিনি ‘নায়ক’।

ম্লাদিচের ছেলে ডার্কো রয়টার্সকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল তার বাবাকে ছেড়ে দেবে বলেই তিনি প্রত্যাশা করছেন। বিচারে তার বিরুদ্ধে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলেছে বলে আমরা দেখিনি। এখন আমরা তার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন।

বেশ কয়েকদফা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যায় আক্রান্ত ম্লাদিচের স্বাস্থ্যের কারণেই বিচার দীর্ঘায়িত হয় বলে রয়টার্স জানিয়েছে। একই কারণ দেখিয়ে সাবেক এ সার্ব কমান্ডারের আইনজীবীরা শেষ মুহূর্তে রায় মুলতু্বি রাখারও আবেদন জানিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা তাতে সাড়া দেননি।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ম্লাদিচ যদি হত্যাকাণ্ডের সরাসরি নির্দেশ নাও দিয়ে থাকেন তাও অধস্তনদের কৃতকর্মের দায় তার ওপর বর্তায়। এর আগে যুগোস্লাভিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটিওয়াই) ম্লাদিচের চার অধস্তনকে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছিল।

বসনিয়ার সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ ও সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসেভিচের সঙ্গে মিলে ম্লাদিচ বসনিয়া থেকে মুসলমানদের সরিয়ে ‘বৃহত্তর সার্বিয়া’ প্রতিষ্ঠা করতে স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিকল্পনা করেন বলেও ভাষ্য তদন্ত কর্মকর্তাদের।

গণহত্যার পর ১৯৯৫ সালে কারাদজিচের সঙ্গেই অভিযুক্ত হন ম্লাদিচ; ২০১১ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারদজিচকে ২০১৬ সালে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আইসিটিওয়াই।

আর নিজেকে নির্দোষ দাবি করা মিলোসেভিচ ২০০৬ সালে বিচার চলাকালে জেলের মধ্যেই মারা যান।

বসনিয়া যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আইসিটিওয়াই বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো ও কসোভোর ১৬১ জনের বিচার করেছে। এর মধ্যে ৮৩ জনই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে সার্ব।

সাহস২৪.কম/আল মনসুর