ইলিশের নতুন সম্ভাবনা

দেশে প্রথমবার তৈরি হল কৌটাজাত সর্ষে ইলিশ

প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৩, ১৬:০৩

সাহস, কৃষি ডেস্ক
সহকারী অধ্যাপক মাসুদ রানা, উদ্যোক্তা আবেদ আহসান সাগর এবং অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব

 

মাছের রাজা ইলিশ। স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। কিন্তু ইলিশ মাছ সবসময়, সবখানে পাওয়া যায়না বলে ইলিশপ্রেমিদের আক্ষেপের শেষ ছিলোনা। তবে এই আক্ষেপের অবসান হতে যাচ্ছে। এখন কৌটাজাত ইলিশ সারাবছর পাওয়ার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। 

বাংলাদেশে প্রথমবারের মত তৈরি করা হয়েছে কৌটাজাত সর্ষে ইলিশ। মাত্র ৩২০ টাকায় মিলবে ইলিশ মাছের ৪টি টুকরা। পাওয়া যাবে সারাবছর। ইতোমধ্যে কৌটাজাতকৃত ইলিশের প্রথম ব্যাচ বিভিন্ন দলের কাছে স্বাদপরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

গবেষকেরা জানিয়েছেন, এ বছরের মার্চ মাসের শুরু থেকে প্রায় ৫০০ মানুষ তাদের উৎপাদিত কৌটাজাতকৃত ইলিশ খেয়েছেন এবং ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছেন। বর্তমানে পণ্যটির শেল্ফ লাইফ তিন মাস। বাংলাদেশের শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সম্প্রতি স্থানীয়ভাবে রাসায়নিকমুক্ত কৌটাজাতকৃত সর্ষে ইলিশ তৈরি করেছেন। শেকৃবি'র ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই কৌটাজাত মাছ জনপ্রিয় একটি খাবার। রান্নাবান্না ছাড়াই সরাসরি বের করে খাওয়া যায় এই মাছ।  বিশ্বজুড়ে টুনা, স্যামন, সার্ডিন, পিলচার্ডসহ আরও কিছু সামুদ্রিক মাছ কৌটাজাত করা হয়। বর্তমান গবেষকেরা তাদের গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো বিভিন্ন এশীয় দেশের কৌটাজাতকৃত মাছ পরখ করে দেখেন। কারণ ওসব দেশের মাছের প্রকার ও রেসিপি কিছুটা আমাদের এখানকার মতোই। আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে যে কৌটা পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে ইলিশের কৌটাজাতকরণ সম্ভব নয়।

কারণ মাছটির শরীরের ফ্যাটি এসিড টিনের কৌটার সঙ্গে রাসায়নিকভাবে বিক্রিয়া করে। তাই গবেষকেরা মাছ ও কৌটার অ্যালুমিনিয়ামের স্তরের মাঝখানে জিংক্স-অক্সাইডের স্তরসমৃদ্ধ কনটেইনার আমদানি করেছেন। সিলিং মেশিন এবং মাছকে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত মেশিনও বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এবার সেই সুবিধাই পাওয়া যাবে ইলিশ মাছের বেলায়৷ সাধারণত বেশি চর্বি থাকায় এ মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায় না। তাই বেশিদিন টিকেয়ে রাখতে লবণ দিয়ে রাখা হয়। সেই তুলনায় কৌটাজাত করা বেশি কার্যকরী।

গবেষকেরা ইলিশের চর্বি উপাদান ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ নিয়েও পরীক্ষা চালান। তাছাড়া গর্ভবতী মা, ও শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান ওমেগা-৩ ও ৬-এর মতো দরকারি সব ফ্যাটি এসিড কৌটার ভেতর যেন অক্ষুণ্ণ থাকে তা নিশ্চিত করেছেন গবেষকেরা। গবেষকরা জানিয়েছেন, এ কৌটাজাতকরণ প্রক্রিয়ায় কোনো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়নি। এরপর তারা স্থানীয় ভোক্তাদের স্বাদের কথা মাথায় রেখে রেসিপির পরিকল্পনা করেছেন। বর্তমানে কৌটাজাত এই মাছের সেল্ফ লাইফ ৩ মাস। পাশাপাশি দাম ধরা হয়েছে ৩২০ টাকা। তবে কৌটাগুলো দেশে তৈরি করা সম্ভব হলে দাম আর কমে আসবে বলে জানা গেছে।

বর্ষায় ইলিশ ভাজা, ইলিশের ভর্তা, শর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, দই ইলিশ, পান্তা ইলিশ, ইলিশের ডিম ছাড়া যেন বাঙালির রসনায় তৃপ্তি আসে না। ইলিশ মাছ স্বাদে যেমন অতুলনীয়, তেমনি পুষ্টি উপাদানেও ভরপুর। 

প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে রয়েছে ২৫ গ্রাম প্রোটিন, ২০৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ৩ দশমিক ৩৯ গ্রাম শর্করা, ২ দশমিক ২ গ্রাম খনিজ ও ১৯ দশমিক ৪ গ্রাম চর্বি। আরও রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, নায়সিন, ট্রিপ্টোফ্যান, ভিটামিন বি১২, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসহ অন্যান্য ভিটামিন ও মিনারেলস।

বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এ টিনজাত ইলিশের পুষ্টি উপাদান ও শেল্ফ লাইফের ওপর একাধিক বিশ্লেষণ চলছে। পণ্যটির মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নির্দিষ্ট করার জন্য প্রায় এক বছর ধরে এ বিশ্লেষণ চলবে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হার্ভেস্ট টেকনোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সহগবেষক মো. মাসুদ রানা বলেন, 'ইলিশ মাছ সংরক্ষণের দীর্ঘদিনের চিন্তা থেকেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে মাছ কৌটাজাতকরণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করি আমরা। একইসঙ্গে আমারা চেয়েছি আমাদের প্রিয় এ মাছটিকে সারাবছর জুড়ে সকল শ্রেণির মানুষের পাতে তুলে দিতে।'

তিনি আরো বলেন, 'বাঙালি ইলিশকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে সর্ষে দিয়ে। তাই আমরা প্রথমে সর্ষে দিয়েই কৌটাজাত করেছি।' গবেষকেরা তিনটি রেসিপির পরিকল্পনা করছেন: সর্ষে ইলিশ, চিলি ইলিশ, এবং মসলা ছাড়া ইলিশের সঙ্গে সবজি। শেষ আইটেমটি বিদেশি ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে।

সাগর ফিশ এক্সপোর্ট নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে তারা ইলিশ কৌটাজাতকরণের পাইলট প্রকল্পে আমন্ত্রণ জানান। কয়েক মাস ধরে দুই পক্ষের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের পর প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও কক্সবাজার চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মালিক আবেদ আহসান সাগর ২০২২ সালে প্রকল্পটিতে আগ্রহী হন এবং কক্সবাজারে তার নিজস্ব জায়গায় একটি প্ল্যান্ট তৈরি করেন।

উল্লেখ, ২০২০-২১ সালে দেশে মোট মাছ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪.৬২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। আর এর মধ্যে কেবল ইলিশই ছিল ০.৫৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মৎস্যবিভাগের তথ্যমতে বিভিন্ন সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে গত দশকে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে।

দেশে এবং বাইরের রপ্তানি বাজার — দুজায়গাতেই কৌটাজাতকৃত মাছের দারুণ ভবিষ্যৎ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের আশপাশের মাছের শেল্ফ লাইফ তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশি কৌটাজাতকৃত মাছের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত