মিরপুর মুক্ত দিবস স্মরণ এবং জল্লাদখানা পরিদর্শন

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:২৫

১.
‘মঙ্গল আসর’-এর জন্য বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকার মতোন একটি আলোকিত দিন। ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকার সৃজনশীল সহশিক্ষার আনন্দময় কর্মকান্ডের ‘মঙ্গল আসর’-এর আয়োজনে ‘বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম স্মৃতি ট্রাস্ট ফান্ড’ আয়োজিত দিনব্যাপী ‘মিরপুর মুক্ত দিবস’ পালন, স্মারক আলোচনা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, পুরস্কার প্রদান এবং গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত মিরপুর জল্লাদখানা পরিদর্শন এবং সেখানকার গ্রন্থাগারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মূল্যবান কয়েকটি গ্রন্থ উপহার প্রদান করা হয়। 

বুধবার (৩০ জানুয়ারি) অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিনম্র শ্রদ্ধায় আরো স্মরণ করা হয় আজকের দিনে প্রয়াত দু’জন মহান মানুষ মহাত্মা গান্ধীকে, জহির রায়হানকে। 

উল্লেখ্য, ৩১ জানুয়ারি ‘মিরপুর মুক্ত দিবস’ হলেও আমরা একদিন আগেই ৩০ জানুয়ারি স্মরণ আয়োজন করেছিলাম মিরপুর জল্লাদখানার সাথে জড়িয়ে থাকা অমর নাম, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতা, পরিচালক ও সাহিত্যিক জহির রায়হানের শহীদ দিবসের স্মৃতির প্রতি বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাতে। দেশের প্রধানতম চিত্রনির্মাতা ও বরেণ্য কথাশিল্পী জহির রায়হান (১৯ আগস্ট ১৯৩৫–৩০ জানুয়ারি ১৯৭২), মিরপুর জল্লাদখানায় শহীদ ও নির্যাতিত সকলের সাথে আরেকজনের নামও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়, তিনি শহীদ লে. সেলিম। মিরপুর মুক্তিদাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লে. সেলিমের শাহাদাতবার্ষিকীও ৩০ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের এই দিনে মিরপুরকে মুক্ত করতে গিয়ে লে. সেলিমসহ ৪১ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য, শতাধিক পুলিশ এবং মুক্তিযোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। 

২.
আলোচনার শুরুতেই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয় সোনালি আঁশের সোনালি মানুষ, বিশ্বখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ, নিবিষ্ট বিজ্ঞানসাধক মাকসুদুল আলমকে, পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়ে যিনি মনে রাখবার মতোন অনুস্মরণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। ‘বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম স্মৃতি ট্রাস্ট ফান্ড’-এর সৌজন্যে পুরস্কার প্রদান করা হয় চিরদিনের সেরা উপহার বইসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাও। শিক্ষার্থীদের জন্য সামান্য আপ্যায়নেরও ব্যবস্থা করা হয়। এসব আয়োজনে সহযোগিতা প্রদানের জন্য জিন বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম স্মৃতি ট্রাস্টের রাফিয়া হাসিনা (Rafia Hasina) আপার প্রতি সবিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশে এবং বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ে তুলতে তাঁর নিরন্তর আগ্রহ, উৎসাহ ও অকৃত্রিম সহযোগিতা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বলে বিবেচনা করি। আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন (Mahmuda Shilpi) আপার নিরন্তর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ আমাদের এই প্রয়াসকে সফল করতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে বলে তার প্রতিও কৃতজ্ঞ আমরা।

৩.
আয়োজনে ৬৫ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্য থেকে ১৩ জন পুরস্কার লাভ করে। আয়োজনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিলো অনুষ্ঠানের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা তথা আলোচনায় অংশগ্রহণ, বিচারকের দায়িত্ব পালনসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার কার্যক্রম পরিচালিত হয় শিক্ষার্থীদের দ্বারাই। ‘মঙ্গল আসর’-এর পরিচালক শিক্ষক হিসেবে আমি শুধু সূত্রধরের ন্যায় ভূমিকা পালন করেছি। আমাদের শিক্ষার্থীদের হাতে দায়িত্ব প্রদান করলে তারা যে সঠিকভাবে বিবেচনার সাথে সম্পন্ন করতে পারে, আজ আবারে সেই আশাবাদী মনোভাবের বাস্তব প্রমাণ পেয়ে আমি যারপর নাই মুগ্ধ, ভীষণই আবেগ আপ্লুত। ওরা পারে, ওরাই পারবে স্বপ্নকে সম্পন্ন করতে, রূপায়ণ ঘটাতে। জিন বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমের মহান বাণীটিই স্মরণে আসে, ‘স্বপ্ন দেখো, তুমিও পারবে’।

৪.
প্রায় দু’ঘন্টার অধিক সময়ের আলোচনা শেষে আমরা পদব্রজে রওনা হই জল্লাদখানা অভিমুখে। চলে গেলাম মিরপুর জল্লাদখানায়। সমবেতভাবে গভীর শ্রদ্ধা জানলাম গণহত্যার ইতিহাস, বিভৎসতা। মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রমিলা বিশ্বাসের নিকট সেখানকার গ্রন্থাগারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মূল্যবান কয়েকটি গ্রন্থ উপহার প্রদান করা হয়। পরে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমির নানা স্মৃতিকাহিনি তুলে ধরেন এবং নানা প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি ইতিহাসমনস্ক ঋদ্ধতায়, মমত্বময়তায়, উদ্দীপনায় তুলে ধরেন তরুণ প্রজন্মের সামনে। আলোচনায় উঠে এলো বাঙালির ওপর পাকিস্তানি আর তাদের দোসরদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কাহিনি। ঘুরে দাঁড়ানো বাঙালির অসম সাহসিকতায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটও বাদ গেলো না। রক্তস্নাত মিরপুর এবং ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের অনুভবকে সুতীব্রভাবে আলোড়িত করে। মিরপুর জল্লাদখানা, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি হাজারো মানুষকে হত্যা করার, মানুষের নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার অতলস্পর্শী পতন বলে আলোচিত হলো। তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত, পাঁচ লক্ষাধিক নারীর চরম ত্যাগ এবং কয়েক কোটি মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে উদ্ভব ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য বিশ্বের কোনো জাতি বা রাষ্ট্রকে দিতে হয়নি। তারই দৃষ্টান্ত এই জল্লাদখানা।

৫.
আমরা সজল নয়নে দেখেছি জল্লাদখানার প্রবেশদ্বারেই বর্ণনাসহ শহীদদের অনেকের নামের তালিকা প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রদর্শন করা হয়েছে রাজশাহীর বাবলা বন বধ্যভূমির মাটি, কিশোরগঞ্জের বড়ইতলা বধ্যভূমির মাটি, চট্রগ্রাম ফয়’স লেক বধ্যভূমির মাটি। খুলনা চুকনগর বধ্যভূমির মাটি, সিলেট আদ্যিতপুর বধ্যভূমির মাটিসহ ৪৭৭টি বধ্যভূমির তালিকা। এর পূর্বপাশে রয়েছে টেরাকোটা ইট ও লোহার সমন্বয়ে তৈরি শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামান-এর যৌথভাবে করা একটি ভাস্কর্য ‘জীবন অবিনশ্বর’। উল্লেখ্য, জল্লাদখানার শহীদ পরিবারের সন্তানেরা ২০০৭ সালের ২১ জুন এই স্থাপনাটির দ্বার উম্মোচন করা করেন। জল্লাদখানা বধ্যভূমির তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, জল্লাদখানার আয়তন ছিল এক একর জায়গা জুড়ে। দেশ স্বাধীনের পরে বিভিন্ন সময় ক্ষমতাবানদের হাতে দখল হতে হতে বর্তমানে জল্লাদখানার আয়তন চার কাঠায় এসে ঠেকেছে। বধ্যভূমির দুপাশ ঘেষেই রয়েছে দুটি গার্মেন্টস। আশেপাশে অসংখ্য ঝুটপট্টি আগত দর্শনার্থীদের অস্বস্তিতে ফেলছে। নষ্ট করছে বধ্যভূমির পবিত্রতা। বুঝতে পারি আমাদের নতুনভাবে ভাববার প্রয়োজন রয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধ যে সামাজিক শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছিল সেই গৌরব থেকে প্রেরণা নিয়ে সমাজশক্তির বিকাশমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিপথের দিশা আমরা পেতে পারি। সমাজশক্তির সেই বন্দনাগান গাইতে আমাদের আরো বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখার প্রয়োজন অনুভব করি।

৬.
আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় গড়ে উঠুক নতুন প্রজন্ম, আমাদের সন্তানরা একাত্তরপরবর্তী প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক আয়োজন নয়, একইসাথে চেতনাতাড়িত নানান সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করাও জরুরি বিবেচনা করি। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান- এ কথা আক্ষরিক অর্থেই কেবল সত্য; বাস্তবে নয়। এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে, মুক্তি বিনা মূল্যে মেলেনি বিশেষত বাংলাদেশের। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কারো ইচ্ছায় সৃষ্টি নয়, বল প্রয়োগেও সৃষ্ট নয়। এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র মানুষের নিতান্ত প্রয়োজনেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ জাতি গঠন এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় গড়ে তুলতে মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ ঘিরে মিরপুরবাসী এবং বিশেষভাবে মিরপুরের সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও তরুণসমাজকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে পারে। এই স্মৃতিপীঠ হয়ে উঠতে পারে স্মৃতির নবায়নের নানামুখি কর্মকাণ্ডের ভিত্তি। ‘স্বাধীনতা আমার অহংকার’ বলে স্বীকার করে ‘এক সাগর’ রক্ত যারা দিয়েছেন- তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে আসুন সমবেত সুরে বলি ‘আমরা তোমাদের ভুলব না।’

৭.
‘মঙ্গল আসর’-এর উদ্যোগ ‘আলোকিত মানুষ চাই, করি দৃঢ় অঙ্গিকার, গড়ি ঘরে ঘরে পাঠাগার’- আন্দোলনকে আরো বিকশিত করতে, পাঠরুচি সযতনে সাজিয়ে সমৃদ্ধতর করতে, সকলের জন্য যুক্তিবাদি সমাজ গড়তে এবং সর্বোপরি মানবিক মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায় ‘দেশ আমার-দায়িত্ব আমার’ বাণীকে আত্মস্থ করার মনোভাব ব্যক্ত হয় আজকের আয়োজনের বিভিন্নজনের কথায়, উচ্চারণে। মানবাধিকারের দাবিগুলি স্মরণে রেখে দেশপ্রেমের আত্মসচেতনতাকে আরেকটু দায়িত্বশীলভাবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রকাশে যার যার অবস্থান থেকে অকৃত্রিমভাবে চেষ্টা করে যাওয়ার গভীর আত্মপ্রত্যয়ী শপথও গ্রহণ করি আমরা নিজেদের কাছেই। এভাবেই ক্লাসের বাইরের জীবনানন্দে ভরপুর প্রশ্নোত্তরময় আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’ আমাদের জীবনের এক মহত্তম ঘটনা মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করে, দেশপ্রেমকে জাগ্রত করতে সদা সচেষ্ট। অসীম সাহসিকতা, বীরত্ব, আত্মত্যাগ, আর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট উৎরে যাওয়ার এক বড় ক্যানভাস মুক্তিযুদ্ধকে চেতনায় জাগ্রত করার এই প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত