কারাবন্দীত্বের ১৩৮ দিন

আজও জামিন হয়নি ঝুমন দাসের

প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২১, ১৫:৪৮

ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অভিযোগ তুলে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ঝুমন দাসের নামে। আজকে ১৩৮ দিন কারাবন্দী থেকেও আলোর দিশা পাচ্ছে না ঝুমন দাসের পরিবার। দফায় দফায় হাকিম এবং জেলা জজ আদালতে আবেদন করলেও দেখা মিলছেনা জামিনের।

আজ রবিবার (১ আগস্ট) আবারও আদালতে জামিনের আবেদন উত্থাপন করার কথা থাকলেও আজও হয়নি ঝুমন দাসের জামিন। বিষয়টি সাহস২৪কে নিশ্চিত করেন ঝুমন দাসের আইনজীবী দেবাংশু শেখর দাস।

আইনজীবী জানান, আজ (রবিবার) ঝুমন দাসের জামিন আবেদনের কথা ছিলো। আদালতের বিচারপতি না থাকায় সেটা আজ আর হয়নি। তবে আগামী ৩ আগস্ট আমরা আবার ঝুমন দাসের পক্ষে জামিন আবেদন করবো।

মামুনুলের বিরুদ্ধে ফেসবুকের সেই স্ট্যাটাসের জের ধরে ঝুমনকে আটকের পরদিন তার গ্রাম নোয়াগাঁওয়ে তাণ্ডব চালায় মামুনুলের অনুসারীরা। সেই তাণ্ডবে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় গ্রামের প্রায় ৯০টি হিন্দু বাড়ি।

আটকের পর ঝুমনকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা। এই মামলায় হাকিম আদালত এবং জেলা জজ আদালতে বারবার জামিন আবেদন করেও মেলেনি কোনও আলোর দিশা। সর্বশেষ ১৬ মে ঝুমন দাসের জামিন আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয় সুনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। আদেশ কিম্বা কোনও নির্ধারণ করা হয়নি কোনও তারিখও। জজ কোর্ট থেকে কোনও আদেশ না পাওয়ায় ঝুমনের পরিবার যেতে পারছে না উচ্চ আদালতে।

এ প্রসঙ্গে ঝুমন দাসের স্ত্রী রাই সরকার রাই বলেন, ‘আমার স্বামী কোনও অপরাধ করেনি। বরাবরই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। যারা ধর্ম দিয়ে দেশের সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে একটা মানুষকে কেন দিনের পর দিন এভাবে কারাবন্দী থাকতে হবে? এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামীর একটা খারাপ আচরণ কেউ দেখাতে পারবে না। আমাদের এত বছরের সম্পর্ক একদিন একটা উচ্চস্বরে কথা বলেন নি আমার সাথে। এমন একটা মানুষ জেলে বন্দী। আমাদের পরিবারের অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন। নিরাপত্তাহীনতায় কাটছে প্রতি সেকেন্ড। মা (শাশুড়ি) ক্ষণে ক্ষণে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’

রাই বলেন, ‘সরকারের কাছে দাবি আমার স্বামীর বিরুদ্ধে এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে আমাদের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে দিন। তার সাথে নাগরিক হিসেবে আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করুণ।’

ঝুমনের মা নিভারানী দাস বলেন, ‘ছেলেকে গ্রেপ্তারের পর আমাদের ঘরসহ গ্রামের সকল বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হলো। আমার পুত্রবধূকে হেনস্তা করা হয়েছে। আর কী শাস্তি পাওয়ার বাকি আছে আমাদের?’

প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে চলতি বছরের মার্চের ১৫ তারিখ শানে রিসালত সম্মেলন নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে বক্তব্য রাখেন হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে এর আগেই সমালোচনায় ছিলেন মামুনুল হক। দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় দিরাইয়ের সমাবেশে এসে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন মামুনুল।

মামুনুল হকের সমালোচনা করে এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাস আপন। স্ট্যাটাসে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ আনেন মামুনুলের বিরুদ্ধে।

ঝুমনের এমন স্ট্যাটাসে ক্ষেপে যান হেফাজত ও মামুনুলের স্থানীয়া অনুসারীরা। মামুনুলের নামে সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা ও অবমাননা বলে চালাতে থাকেন এলাকায় প্রচারণা। এতে এলাকাজুড়ে দেখা দেয় তুমুল উত্তেজনা।

বিষয়টি বুঝতে পেরে গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে পুলিশের হাতে তুলে দেন ঝুমন দাসকে। হেফাজতে ইসলামসহ স্থানীয় মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ওই রাতেই স্থানীয় বাজারে বৈঠক করে প্রশাসন। এ সময় আটকের খবর জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শান্ত থাকার আশ্বাস দেন উপস্থিত সবাই।

কিন্তু সারা দেশ যখন উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত ঠিক ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। লুটপাট ও ভাঙচুর চালায় ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি ও মন্দিরে।

শাল্লার এই তাণ্ডবে অভিযোগ ওঠে- পুলিশ আগে থেকে আভাস পেয়েও কোনও ব্যবস্থা নেয় নি। এই গাফিলতির অভিযোগের ঘটনার তদন্তে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ সদর দপ্তরে ২৬ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেয় এই কমিটি।

প্রতিবেদনে হামলার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারসহ (এসপি) ১১ জনকে বদলি এবং ৬ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

নোয়াগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস একটি নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঝুমন কোনো ধর্ম, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়নি। সে একজন ব্যক্তির সমালোচনা করেছে। এ কারণে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে জেলে রাখা অযৌক্তিক। আমরা তার মুক্তি চাই এবং যারা আমাদের গ্রামে হামলা ও লুটপাট করেছিল সবার গ্রেপ্তার চাই।’

ঝুমন দাসের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখালেখি করছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে মানুষটা ধর্মীয় সম্প্রীতির পক্ষে কথা বলছে তাকে এভাবে হেনস্তার বিষয়টা আসলেই দুঃখজনক। এই মামুনুলদের মত ধর্ম ব্যবসায়ীরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে আসছে। সেখান থেকে ঝুমন দাসদের মত যুবকরা ধর্মের নামে এসব সাম্প্রদায়ীক সমস্যা নিরসনে নিজেদের মত প্রকাশ করছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে এতটুকু অধিকার ঝুমন দাসদের মত যুবকদের না থাকলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অচিরেই বিনষ্ট হবে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক সমাজ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত