‘পদ্মাসেতুর জন্যেই মোটরসাইকেল কিনেছিলাম’
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:৪২
মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের মাঝিরকান্দি ঘাটের উদ্দেশে প্রমত্তা পদ্মাকে পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে একটি লঞ্চ। নদীর খরস্রোতে দুলছে সেটি। অন্যদিকে, লঞ্চে বহন করা একটি মোটরসাইকেলকে শক্ত হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তার মালিক। তার শঙ্কা, লঞ্চটা একটু কাত হলেই বুঝি তার শখের মোটরসাইকেলটা পরে যাবে নদীতে, বিলীন হয়ে যাবে পদ্মায়। সপ্তাহে একবার এভাবে ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা পাড়ি দেন শরীয়তপুরের কাজীরহাট গ্রামের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম। ঢাকার বাবুবাজারে গার্মেন্টেস এর ব্যবসা থাকায় সপ্তাহে একবার পরিবারের সাথে সময় কাটাতে কাজীরহাটে আসা যাওয়া তার। নদীতে ফেরি চলাচল না করায় পদ্মা পাড়ি দিতে তার মোটরসাইকেলটি উঠাতে হয় লঞ্চে। এত ঝুঁকি সত্ত্বেও মোটরসাইকেল কেন জানতে চাইলে শরিফুল বলেন, ‘এই পদ্মা সেতুর জন্যে কিছু টাকা জমিয়ে মোটরসাইকেল কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম ঢাকা থেকে সহজে মোটরসাইকেলে সেতু পাড়ি দিয়ে গ্রামে যাবো, কিন্তু সরকার তো সেতুতে মোটরসাইকেল উঠানো বন্ধ করে দিলো। চালুর অপেক্ষায় আছি, তখন আর কষ্ট হবে না।’
একই লঞ্চে থাকা আরও এক মোটরসাইকেল চালক ওবায়দুর ভোগান্তির আত্মপ্রকাশ বলেন, ‘আহা! আহারে পদ্মা সেতু রে’, ‘পদ্মা সেতু চালু নিয়ে ছিলো অনেক স্বপ্ন। ভেবেছিলাম মোটরসাইকেল নিয়ে এই পথে সহজে ঢাকায় আসা যাওয়া করবো। কিন্তু সরকার মোটরসাইকেলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর তা আর হলো না। আগে তো ফেরি ছিলো, এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে, আবার কখনও পিকাপে পার করাতে হয়। আমাদের ভোগান্তির যেন শেষ নেই।’
শরিফুল ইসলাম ও ওবায়দুরের মত অনেকে আছেন যারা কোনোরকম টাকা জমিয়ে একটি মোটরসাইকেল কিনেছিলেন পদ্মাসেতু পাড়ি দেবে বলে। কিন্তু সেই সৌভাগ্য একদিনের বেশি গড়ায়নি তাদের জন্য। সেতু জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার প্রথম দিনেই (২৬ জুন) মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরপরই মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার। আর এতেই ভোগান্তির বেড়ায় আটকে যায় এমন সাধারণ মোটরসাইকেল ব্যাবহারকারীরা।
‘‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দেশের সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সড়কপথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। দুই প্রান্তের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের সেতুবন্ধন ঘটেছে। দূরত্ব কমেছে ঢাকার সাথে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার। এতে কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই পদ্মা পাড়ি দিতে পারবে এমন স্বপ্নই দেখেছে দক্ষিণাঞ্চলের সকল শ্রেণীপেশার মানুষ।’’
পদ্মা সেতুর দ্বার খোলার আগ পর্যন্ত যানবাহন পারাপারের একমাত্র ভরসা ছিলো ফেরি। সেতু সম্পূর্ণরূপে সচল হওয়ার পর যানবাহন সংকটে লোকসানের মুখে পরে নৌ কর্তৃপক্ষ। বন্ধ করে দেয়া হয় ফেরি চলাচল। এমতাবস্থায় নিরুপায় হয়ে পদ্মা পাড়ি দিতে বিকল্প পন্থা অবলম্বন করতে থাকে মোটরসাইকেল চালকেরা। কখনও পিকাপ ভ্যান, কখনও ট্রাকে মোটরসাইকেল উঠিয়ে পদ্মা পাড়ি দিতে থাকে তারা। এমন কর্মকাণ্ডেও আসে সরকারি নিষেধাজ্ঞা। পুলিশ- সেনাবাহিনী সরব থাকায় তা হয়ে ওঠে আরও চ্যালেঞ্জিং। এর পাশাপাশি সুযোগের সৎব্যবহার করে মোটরসাইকেল পার করিয়ে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয় মোটরসাইকেল বহনকারী পিকাপ ও ট্রাক মালিকেরা। বাড়তি খরচ কমাতে অনেক ঝুঁকি নিয়েও লঞ্চে উঠানো হচ্ছে মোটরসাইকেল। যা ভোগান্তির চরম পর্যায়ে নিয়ে যায় মোটরসাইকেল চালকদের। বাড়তি ভাড়া নেওয়ার পাশাপাশি কখনও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেক মোটরসাইকেল চালক।
লঞ্চের স্টাফদের সাথে মোটরসাইকেলের ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পরতে দেখা যায় ঢাকার একটি বেসরকারি ফার্মে কর্মরত নাজমুল ইসলামকে। নাজমুলের দাবি, তার কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। জানতে চাইলে বলেন, ‘মোটরসাইকেল লঞ্চে উঠানোর সময় সাড়ে চারশো টাকা দর করা হয়। এখন উঠানোর পর স্টাফরা ৫০ টাকা অতিরিক্ত লেবার চার্জ দাবি করে। টাকা না দিলে বাইক নামিয়ে দেবে না বলছে। আজ পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চললে ১০০ টাকাতেই কাজ হয়ে যেত। হত না কোনো ভোগান্তি।’
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, দেশের সবচেয়ে বড় সেতুতে মোটরসাইকেল পার হওয়ার সুযোগ দেওয়ার চিন্তা সরকার আপাতত করছে না। সেসময় তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চালুর বিষয়ে আগে থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না সরকারের। কিন্তু নতুন সমস্যা হয়ে গেছে, সবকিছু মিলিয়ে পরে আমরা মোটরসাইকেল পুনরায় চালানোর অনুমতি দেওয়ার চিন্তা করব।’
পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ রাখার এ সিদ্ধান্ত সাময়িক, গণমাধ্যমে এমনটাই বলেছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও। গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘সেতুতে স্পিডগান মেশিন ও সিসি ক্যামেরা বসানোর পরই মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে।’ তবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কবে থেকে মোটরসাইকেল চলবে, তা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে’। এদিকে, পদ্মা সেতু উন্মুক্ত করার ৮ মাস পর স্পিডগান ও সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে বা কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে তা নিয়ে এখনও কোনো ঘোষণা দেয়নি সরকার। স্পিডগান ও সিসি ক্যামেরা বসানো হলেও মোটরসাইকেল পুনরায় সেতুতে চলার অনুমোদন পাবে কি না, তা নিয়েও সংশয়ে কাটাচ্ছে মোটরসাইকেল চালকেরা।
গেল বছর ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের বিধিনিষেধ আরোপের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। পরে চলতি বছর জানুয়ারিতে সেই রিট খারিজ করে হাইকোর্ট বেঞ্চ। বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটটি উত্থাপিত হয়নি বলে খারিজ করে দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ইয়ারুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ।
পরে আইনজীবী ইয়ারুল ইসলাম জানান, পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল সাময়িকভাবে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বলে শুনানিতে এসেছে। পরবর্তী সময় এ বিধিনিষেধ তুলেও নেওয়া হতে পারে বলে আদালত বলেছেন। কোন সড়কে কোন গাড়ি চলবে, সে বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেমন অনেক সড়কে ভ্যানগাড়ি, রিকশা যেতে দেওয়া হয় না, যা সরকারের একধরনের নীতি। এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না বলে জানান আদালত। এরপর রিটটি ফেরত নেওয়ার কথা জানানো হয়। পরে আদালত রিটটি উত্থাপিত হয়নি বলে খারিজ করে দেন।
মোটরসাইকেল বন্ধ রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, সেতু নির্মাণ করা হয়েছে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে। এর সর্বোচ্চ ব্যবহার হওয়াই উচিত। এ ছাড়া সেতু কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান। সেতু নির্মাণ করা হয়েছে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। তা ফেরত দিতে হবে ৩৫ বছরে। ফলে মোটরসাইকেলের আয় থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। বাসেকের দেওয়া তথ্যমতে, পদ্মা সেতু চালুর পরদিন (২৬ জুন) ৬১ হাজার ৮৫৬টি যানবাহন পারাপার হয়। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই মোটরসাইকেল। সেতু বিভাগ জানায়, প্রথম দিন টোল আদায় হয় পৌনে তিন কোটি টাকা। যেখানে শুধুমাত্র মোটরসাইকেল থেকেই টোল আদায় হয় ৪৬ লক্ষ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা। পরদিন (২৭ জুন) থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করে সেতু বিভাগ। ওই দিন সেতু দিয়ে মোট যানবাহন চলাচল করে ১৫ হাজার ২৭৪টি। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় যানবাহন পারাপার চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। এদিন টোল আদায় হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দেশের সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সড়কপথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। দুই প্রান্তের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের সেতুবন্ধন ঘটেছে। দূরত্ব কমেছে ঢাকার সাথে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার। এতে কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই পদ্মা পাড়ি দিতে পারবে এমন স্বপ্নই দেখেছে দক্ষিণাঞ্চলের সকল শ্রেণীপেশার মানুষ।
সাহস২৪.কম/এএম.