ফসলরক্ষায় প্রকল্প-বরাদ্দ বাড়িয়েও শেষ হয়নি বাঁধের কাজ

প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৩, ১৬:৪৬

সাহস ডেস্ক

গত বছরের চেয়ে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ ও অতিরিক্ত প্রকল্প বাড়িয়েও শেষ করা যায়নি সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বেড়িবাঁধের কাজ। কোথাও কোথাও সবেমাত্র কাজ শুরু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে ৭৮ ভাগ কাজ শেষ করার কথা বলা হলেও সরেজমিন, কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন গড়ে ৫০ ভাগ কাজও সম্পন্ন হয়নি। হাওর আন্দোলন নেতারা জানান, ১ হাজার ৭৬টি প্রকল্পের মধ্যে অন্তত তিন শতাধিক প্রকল্পে প্রায় ৫০ কোটি টাকা সরকারের অপচয় হবে। তাছাড়া প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) প্রতিনিধিদের কাছ থেকে অন্তত ২০ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ উঠেছে। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ যথাসময়ে শুরু না করে শেষ করতে না পারা, দুর্নীতি, অনিয়ম, নীতিমালা বিরোধী প্রকল্পগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কর্মসূচির পর প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছেন হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।

সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও মেরামতে নিয়োজিত জেলা কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলার ৫৪টি হাওরের ৭৪৫ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ২০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ১ হাজার ৭৮টি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। এর এর মধ্যে ২টি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। গতবার ৭৬৫টি প্রকল্পে ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ফসলরক্ষা বাঁধ করা হয়েছিল।

সরেজমিন এবং হাওরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সর্বশেষ কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী গণশুনানি করে মাঠে গিয়ে বাঁধ এলাকার প্রকৃত কৃষকদের নেতৃত্বে পিআইসি গঠন করার কথা। কিন্তু সেটা কোথাও মানা হয়নি। গত বছরের অক্টোবর মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সার্ভেয়ার এনে প্রিওয়ার্ক করে প্রকল্প প্রস্তুত করে। উপজেলায় কর্মরত সেকশন অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের একটি সিন্ডিকেট মিলে প্রিওয়ার্কে পিআইসির সুবিধাভোগীদের সঙ্গে আতাত করে ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেখিয়ে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রকল্প তৈরি করার অভিযোগ ওঠে। প্রতিটি পিআইসি গড়ে ২ লক্ষ টাকা নিয়ে পিআইসি অনুমোদন দেওয়ার একাধিক অভিযোগ আছে। এভাবে প্রকল্পের নকশায় সরকারি অর্থ অপচয় করে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। তাছাড়া প্রকল্প বাড়ানো, অক্ষত প্রকল্প, অল্প ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়ায় সরকারের আরো অন্তত ৫০ কোটি টাকা অপচয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও কৃষকরা জানিয়েছেন, এখনো জেলার ২১৮টি ক্লোজারের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শতাধিক ক্লোজারে মাটি ফেলা হয়নি। সরকারি হিসেবে এখনো ৩৮টি ক্লোজারের কাজ বাকি। ঘুষ দুর্নীতি অনিয়ম ঢাকতে অক্ষত, অপ্রয়োজনীয় ও অল্প ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্পে তড়িঘড়ি করে উপরের আবরণ সরিয়ে, কোথাও ১-২ ফুট মাটি ফেলে, স্লোবের পুরনো দুর্বাঘাস ছেঁটে প্রকল্পগুলো নতুন দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যার ফলে হাওরের মূল ক্লোজারের দিকে পিআইসি ও প্রকল্প অনুমোদনে জড়িতদের দৃষ্টি কম ছিল। কৃষকরা জানিয়েছেন, ফসলরক্ষা বাঁধ টেকসই করতেই বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা। পরবর্তীতে হাওরাঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বাঁধ টেকসই না হওয়ায় পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কা সামলাতে পারেনা অস্থায়ী বাঁধগুলো।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, তাদের প্রতিনিধিরা জেলার ১২ উপজেলার অন্তত পাঁচ শতাধিক পিআইসির কাজ পরিদর্শন করেছেন। পিআইসি নীতিমালা না মেনে এক এলাকার লোককে আরেক এলাকায় এনে পিআইসি দেয়া হয়েছে। বাঁধ ঘুরে হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আরো জানান, চলতি বছরের বোরো ফসল বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে বন্যার দোহাই দিয়ে বিপুল বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাঁধগুলো বন্যানিয়ন্ত্রক বাঁধ নয়, ফসলরক্ষার অস্থায়ী বাঁধ। যা বন্যার পানির লেভেল থেকে নিচে থাকে।

সরেজমিন ঘুরে এসে নেতৃবৃন্দ জানান, দোয়ারাবাজার উপজেলায় দেখার হাওরের বোরো ফসলের সুরক্ষার নাম করে সুরমা নদীর ডান তীর নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। নাইন্দার হাওরের ব্রিজের মুখে একটি ক্লোজার বন্ধ করে একটি প্রকল্প গ্রহণ করলেই হতো সেখানে ১৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তাহিরপুরে পাঁচনাইল্লায় হাওরে কেন্দুয়া নদীতে একটি ক্লোজারের স্থলে ৩টি প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। বালিজুরী ইউনিয়নে বাঁধের পুরাতন এলাইনমেন্ট পরিবর্তন করে গ্রামের ভেতর দিয়ে বালির বাঁধ করা হচ্ছে। শাল্লা উপজেলায় গড়ে প্রতিটি বাঁধে ২২-২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই উপজেলায় ২০, ২২, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৬৫, ৬৬,৮৫, ৮৬, ১০৪, ১০৫, ১০৬, ১০৭, ১০৮, ১০৯, ১১০, ১১১, ১১২, ১১৩, ১১৪, ১১৫, ১১৬, ১১৭, ১১, ১১৯, ১২০, ১২৩, ১২৭, ১৩১, ১৩২, ১৫০, ১৫১ প্রকল্পগুলো অপ্রয়োজনীয়, অক্ষত ও অল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিপুল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি এসব প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে কাজ অর্ধেকও হয়নি। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১১৮ নং প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বাধের নিকট থেকে মাটি তোলা হচ্ছে। ১৩১, ১৩২ ও ৩৮ নং প্রকল্পেও গোড়া থেকে মাটি তোলা হচ্ছে। ১১৮ নং প্রকল্পটি পাকা সড়ক হলেও প্রকল্প দেওয়া হয়েছে।

২৭ ফেব্রুয়ারি এই উপজেলার ৮৫ ও ৮৬ নম্বর প্রকল্পে গিয়ে দেখা মাত্র এক ফুট মাটি ফেলা হয়েছে। ১৫০, ১৫১ প্রকল্পের কাজও বাকি। দেখার হাওরের মহাসিং নদীর দুই তীর, খাই ও খাওয়াজুরী, সাংহাই হাওরের অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উপজেলার জামখলার ক্লোজারসহ একাধিক স্থানে এক বাঁধকে ভাগ করে একাধিক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সদর উপজেলার চলতি নদী বামতীরে বোরো ফসলের অস্তিত্ব না থাকলেও রহস্যজনকভাবে চলতি নদীর তীরে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামের ডাকুয়ার হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ জরুরি হলেও সেখানে কোন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি।

জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওরের শালিকা, ডুমাখালী, বড়ঢর, রাজনগর কেয়াঘাটের ক্লোজারের কাজের গতিও মন্থর। ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে বাঁধের টাকায় তৈরি হচ্ছে চেয়ারম্যানের বাড়ির সড়ক। তাছাড়া জেলার বেশিরভাগ বাঁধেই এখনো কমপেকশন করে ঘাস লাগানো হয়নি।

কৃষক নেতা অমর চাঁন দাস বলেন, আমি বিভিন্ন বাঁধ ঘুরে দেখেছি শাল্লা উপজেলার অধিকাংশ প্রকল্পেই কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু দিরাইয়ে কাজ শুরু হয়েছে শেষ দিকে। কাজের মানও সন্তোষজনক নয়। তাছাড়া অযথা কিছু প্রকল্প দিয়ে সরকারের টাকা অপচয় করা হচ্ছে। আগে কাজ শুরু হলে বাঁধ টেকসই হতো এবং বন্যাঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারতো।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, আমাদের পর্যবেক্ষণে অন্তত ৩ শতাধিক অপ্রয়োজনীয়, অক্ষত, অল্প ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে সমান বরাদ্দ দিয়ে সরকারের প্রায় ৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত অপচয় হবে বলে আমরা মনে করি। তাছাড়া শুরুর দিকে পিআইসি গঠনের নামে সুবিধাভোগীদের সঙ্গে আতাত করে পিআইসি থেকে অন্তত ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। পিআইসিকে লাভজনক মনে করে একটি চক্র গড়ে ওঠেছে। তারা সরকারের ভালো উদ্যোগকে বিতর্কিত করে লুটপাটের ঠিকাদারি প্রথায় যেতে চায়।

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, কৃষকের জন্য করা পিআইসিতে কৃষককে নেওয়া হয়না। সুবিধাভোগীরা অর্থের বিনিময়ে সুযোগ নেয়। প্রিওয়ার্ক ও পোস্ট ওয়ার্কে চরম দুর্নীতি করা হয়। তাছাড়া শুরুতে কাজ না করায় যথা সময়ে কাজ শেষ হয় না। যার ফলে বাঁধ পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কা সামলাতে পারে না। তিনি বলেন, জেলায় এখনো অর্ধেকের বেশি কাজ বাকি আছে, অথচ বন্যার দোহাই দিয়ে প্রকল্প ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার বলেন, গড়ে ৭৮ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ২১৮টি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারের মধ্যে ১৮০টির কাজ শেষ হয়েছে। আমরা মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। তবে কাজ শেষ করতে আরো এক সপ্তাহ সময় বাড়ানো হয়েছে। আশা করি এর মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি বলে জানান তিনি।

সাহস২৪.কম/এএম.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত