জায়েদা খাতুনের জয়ের কারণ কী, নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেয়া !

প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩, ১৮:৩২

বিবিসি বাংলা
বিজয়ী মা জায়েদা খাতুন ও ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম

জায়েদা খাতুন যখন গাজীপুর নির্বাচনে প্রার্থী হবার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন তখন বিষয়টিকে অনেকে গুরুত্ব দেননি। তার পরিচিতি ছিল 'জাহাঙ্গীরের মা' হিসেবে। একথা সবার জানা ছিল যে নির্বাচনের নানা জটিল সমীকরণ জায়েদা খাতুনের কাছে পুরোপুরি অজানা ছিল। দৃশ্যপট খানিকটা বদলাতে থাকে যখন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। বিরোধী দল বিহীন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেন জায়েদা খাতুন।

  • সত্তর বছর বয়সী জায়েদা খাতুনের জয়ী হওয়ার পেছনে কারণ কী?
  • গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম (বামে) ও তার মা, নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন
  • গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম (বামে) ও তার মা, নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন
গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম (বামে) ও তার মা, নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন
 

বিএনপির অনুপস্থিতি

নির্বাচনে জায়েদা খাতুনের জয়ের পেছনে অন্যতম বড় একটি কারণ ছিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেয়া।

২০১৩ সালে গাজীপুরে যখন প্রথমবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হয় তখনও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন আজমত উল্লাহ। সেবার তিনি বিরোধী দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন। ঐ নির্বাচনে মোট ভোটারের প্রায় ৬৪ শতাংশ ভোট দিয়েছিলেন।

এরপর ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটির দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বিজয়ী হন। ঐ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল।

পুলিশের সহায়তায় জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ভোটকেন্দ্র দখলে নিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছিল পাঁচ বছর আগে।

গাজীপুরে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলে বোঝা যায়, এই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতে পারতো। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও তারা চেয়েছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় হোক।

এবারের নির্বাচনে বিএনপি কোনো প্রার্থীকে সমর্থন না করায় শুধু আওয়ামী লীগের নিজেদের 'ভোট ভাগাভাগি' হয়েছে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।

অনেকে এটাও মনে করেন, এই ভাগাভাগির পাশাপাশি বিএনপি সমর্থকদের একটি অংশের ভোট জায়েদা খাতুনের পক্ষে গিয়েছে।

গাজীপুর একটি ওয়ার্ডের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক বলছিলেন, “গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচনেই বিএনপির বিপুল ভোটে জয়ের রেকর্ড আছে। এবারের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী থাকলে নিশ্চিতভাবে এই নির্বাচনের ফলাফলের চিত্র অন্যরকম হত।”

গাজীপুরের এবারের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন মোট ভোটারের প্রায় ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি ভোটার ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন।

নারী ভোটারদের একট বড় অংশ জায়েদা খাতুনকে ভোট দিয়েছেন

আমেরিকার ভিসা নীতির প্রভাব?

গাজীপুরে ভোট গ্রহণের আগের দিন রাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে। তাতে বলা হয়েছে - যে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হলে ঐ ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারে।

অনেকে মনে করেন এই ঘোষণার প্রভাব পড়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব ছিল পরিষ্কার। ভোট জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রর্থীর এজেন্ট বের করে করে দেয়া এবং ভোটকেন্দ্রের সামনে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের অবস্থানের মত ঘটনা ঘটেছে জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনে।

কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এসব চোখে পড়েনি বলে উল্লেখ করছেন বিবিসির সংবাদদাতারা। ফলে ভোটকেন্দ্র যারা এসেছেন তারা নিজেদের পছন্দমতো ভোট দিতে পেরেছেন।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’, সুজন-এর প্রধান বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতির কিছুটা প্রভাব গাজীপুরের নির্বাচনে পড়েছে।

“মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতার বক্তব্য দেখেছি, যেখানে তারা তাদের কর্মীদের নির্বাচনের আগে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার বক্তব্যেও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না করার বিষয়টি উঠে এসেছে”, বলছিলেন মি. মজুমদার।

“এই নীতির প্রভাব পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। কোনো একটা কাজ করে যদি বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে যে কোনো যৌক্তিক মানুষই চাইবেন না যে তার সেই ক্ষতি হোক। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটা করতে চাইবে না তারা।”

তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ‘ভিসা নীতি’র জের ধরে গাজীপুর নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হলেও জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমনটা হবে বলে মনে করেন না মি. মজুমদার।

তার মতে, জাতীয় নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের যদি উপস্থিতি থাকে, তাহলে প্রধান দুই দলই জয়ের জন্য মরিয়া থাকবে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিষধাজ্ঞার আশঙ্কা থাকলেও নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম হবে বলে ধারণা করেন তিনি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবশ্য বলছে যে গাজীপুর নির্বাচনের ফলই শেখ হাসিনা প্রশাসনের ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকারের’ বড় প্রমাণ।

আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হেরেছে, এটাই প্রমাণ করে যে সেখানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন, তা পালনে আমাদের প্রশাসন কতটা দৃঢ়সঙ্কল্প, এই ফলাফলের মাধ্যমেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়।”

ভোট গণনা

আওয়ামী লীগের একটি অংশের সমর্থন

জাহাঙ্গীর আলম দীর্ঘসময় গাজীপুরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। জেলার মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও কম নয়। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টও হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে জবাব দিতে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনেও হাজির হতে হয়েছিল।

তারপরেও গাজীপুর আওয়ামী লীগের একটি অংশের মধ্যে তার সমর্থন রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, জাহাঙ্গীর আলম যখন মেয়র ছিলেন তখন তার কাছ থেকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ সুবিধাভোগী ছিলেন।

এজন্য আওয়ামী লীগের প্রাপ্য ভোটের একটা বড় অংশ জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের পক্ষে গেছে।

এই নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৮ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়, যেই দলের কাজ ছিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয়ের লক্ষ্যে সার্বিক কার্যক্রম তদারকি করা।

এই দলের সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, যিনি বলছিলেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অনেক কর্মী জায়েদা খাতুনের সমর্থনে কাজ করেছেন।

“জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হলেও তিনি কখনোই আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেননি। তার মা নির্বাচনে জয়ের পরও তিনি বলেছেন যে ‘ব্যক্তির পরাজয় হয়েছে, নৌকার জয় হয়েছে।’”

“কাগজে-কলমে নৌকার প্রার্থী হারলেও আমরা কিন্তু ঐ এলাকায় আমাদের ভোট ব্যাংক কমে যাওয়ার কোনো ইঙ্গিত দেখছি না। কারণ জাহাঙ্গীর আলমের মা’কেও নৌকার সমর্থকরাই ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছেন” বলছিলেন মি. বড়ুয়া।

নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরদের অনেকে প্রকাশ্যেই জাহাঙ্গীর আলমের মায়ের সমর্থনে কাজ করেছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের তুণমূলের অনেক নেতাকর্মীও প্রকাশ্যেই জায়েদা খাতুনের হয়ে প্রচারণা চালিয়েছে বলে বলেন বিপ্লব বড়ুয়া।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ (ডানে) ২০১৩ সালে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে এক লাখ ভোটের বেশি ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল

আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ (ডানে) ২০১৩ সালে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে এক লাখ ভোটের বেশি ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল
ছবির ক্যাপশান: আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ (ডানে) ২০১৩ সালে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে এক লাখ ভোটের বেশি ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল

নারী ভোটার উপস্থিতি

নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার সময় সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজের ও তার মায়ের আলাদা মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছিলেন। মি. আলমের নিজের মনোনয়ন পত্র বাতিল হয়ে গেলেও তার মার মনোনয়ন বৈধতা পায়।

এরপর পুরো নির্বাচন প্রচারণার সময় জাহাঙ্গীর আলম তার মায়ের সাথে ছিলেন। কার্যত, জাহাঙ্গীর আলমই প্রচারণা চালিয়েছেন।

ভোটের দিন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বেশ কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখেন বিবিসি সংবাদদাতা আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, নারী ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন জায়েদা খাতুন।

“বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ঘুরে আমি দেখেছি যে নারী ভোটারদের একট বড় অংশ জায়েদা খাতুনকে ভোট দিচ্ছে। অনেকেই জায়েদা খাতুনকে আলাদাভাবে না চিনলেও জাহাঙ্গীর আলমের মা হিসেবে তাকে ভোট দিয়েছে,” বলেন আবুল কালাম আজাদ।

তাছাড়া অনেকে মনে করেন, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী 'বাড়তি সুবিধা' পায় এবং তারা প্রভাবশালী । সেটির বিপরীতে জায়েদা খাতুনকে অনেক 'দুর্বল' হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এজন্য ভোটারদের একটি অংশের মধ্যে জায়েদা খাতুনের প্রতি সহানুভূতিও কাজ করেছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত