আমাদের বাতিঘর আব্দুল গাফফার চৌধুরী

প্রকাশ | ১২ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৩০ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:২৪

বাংলা ভাষাদিবস একুশের অমর প্রভাতফেরীর গীতিকার শ্রদ্ধেয় কলামিস্ট-সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর জন্মদিন আজ। 

১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের উলানিয়ার বিখ্যাত জমিদার বাড়িতে জন্মেছেন বরেণ্য মানুষটি। তার বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম।

আবদুল গাফফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর তাকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। সেসময়ে আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত 'কংগ্রেস হিতৈষী' পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। বরিশাল শহরে তিনি কিছুদিন একটি মার্কসবাদী দল আরএসপি'র সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ছাত্র জীবনেই তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয়। বরিশালের সন্তান শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা তখন কলকাতার প্রধান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হতো। তরুণ বয়সেই অমর একটি গানের জন্য বাংলা ভাষার অবিস্মরণীয়-প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের আসনে স্থান হয় এই মানুষটির। আর বিশ্বের বাঙালি চিরদিন এই অমর গানটির জন্যই তাকে স্মরণ করবে। এবং যতবার গানটি গীত হবে যখন যেথায়– তিনিও ততবার তারই গানের ভাষায় স্মরণীয়-বরণীয় হবেন। এই কারণেই তিনি জীবন্ত কিংবদন্তীতুল্য মানুষ।

তিনি একাধারেই রচনা করেছেন কবিতা, নাটক ও গানসহ উপন্যাসও। বর্তমান প্রজন্ম তাকে কলামিস্ট ও সাংবাদিক হিসেবে জানলেও তিনি একজন নন্দিত কথাশিল্পীও। মাত্র চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়েই আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখা শুরু করেন। অবশেষে তারুণ্যদীপ্ত বয়সেই খ্যাতিমানের তালিকায় তারই নাম চলে আসে।

১৯৫০ সালে গাফফার চৌধুরী পরিপূর্ণভাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এ সময়ে তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। মাসিক সওগাত, দিলরুবা, মেঘনা, ইত্তেফাক, আজাদ, জেহাদ ও পূর্বদেশসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন বরেণ্য এই সাংবাদিক। এছাড়া তিনি কলকাতায় দৈনিক আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক জনপদ বের করেন। 

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তাঁর স্মৃতিচারণাধর্মী কলাম ও পরবর্তীতে বই – “নিরুদ্দিষ্ট নয়মাস” আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি দলিলসম রচনা। ৩টি ছোটগল্পের বই – কৃষ্ণপক্ষ, সুন্দররাই সুন্দর, এবং সম্রাটের ছবি। সম্রাটের ছবির জন্য অর্জন করেছেন ইউনেস্কোর পুরস্কার। চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, নাম না জানা ভোর, শেষ রজনীর চাঁদ এবং নীল যমুনা তার প্রখর চেতনাধর্মী তিনটি উপন্যাস।

প্রবাসে থেকেও তিনি পাঠকপ্রিয় নিরলস লেখক। দেশি-বিদেশি অসংখ্য দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিতই দুহাতে অনেক কলাম লিখছেন। তার লেখার অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় সমসাময়িক বিষয়বস্তু তুলে আনেন। তীক্ষ্ণ অথচ দারুণ সহজ লেখনীতে পাঠক হৃদয়জয়ী বক্তব্য উঠে আসে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সকল কলামেই। কোনওরকম বিচ্যূতি ছাড়া এ যাবৎকাল ধরেই জীবন্ত ইতিহাস বর্ণনা ঝর্ণাধারার মতোই তার মেধাবী হাতে লিখিত হয়ে আসছে। 

বায়ান্নতে যেমন অমর সঙ্গীতের বাণীর জন্ম দিয়েছেন, একাত্তরেও তেমনই ভূমিকা রেখেছেন মুজিবনগর সরকার-এর প্রধান মুখপত্র জয়বাংলার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপূর্ণ প্রকাশনার মধ্য দিয়েই। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কলম সৈনিকের দায়িত্ব যথাযথ পালনের সঙ্গেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মোটিভেটরের দায়িত্ব পালন করেন। 

বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট নিয়েই তার গভীর চিন্তা প্রসূত লেখালিখি আজও অব্যাহত গতিতে সচল। এবং সময় পেলেই ছুটে আসেন প্রিয় বাংলাদেশে। 

তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গাফফার চৌধুরী। ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, এরপর একে এক একুশে পদক, ইউনেস্কো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কারসহ ২০০৮ সালে সংহতি আজীবন সম্মাননা পদক, লন্ডন, ২০০৯ সালে স্বাধীনতা পদক,  ২০০৯ সালে মানিক মিয়া পদক, ওই বছরই তাঁকে যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা (টাওয়ার হ্যামলেটস) উপাধি সংহতি আয়োজিত প্রবাসীদের পক্ষ থেকে ঢাকায় এক সংবধর্ন দেওয়া হয়।
   
তাই তো তাঁর গানের কথা বলি -আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি- না, পারি না। আমরা আমাদের ভায়ের স্মৃতি– আমার সোনার দেশের রক্তস্মৃতি কোনদিনও ভুলিতে পারি না। প্রিয় লেখক-কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী, বাংলাদেশের ক্রান্তিকাল অতিক্রমণে আপনি মহান সৈনিকের মতোই জাতির মাথার পরে পথ-প্রদর্শকের ভূমিকায় থাকুন অপ্রতিরোধ্য ও নমস্য মানুষ হয়ে। 

“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ।।
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ।।”
 
না, পারিনা। আমরা আমাদের ভাইয়ের স্মৃতি – আমার সোনার দেশের রক্তস্মৃতি কোনদিনও ভুলিতে পারিনা। প্রিয় লেখক-কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী, বাংলাদেশের ক্রান্তিকাল অতিক্রমণে আপনি মহান সৈনিকের মতোই আমাদের মাথার ‘পরে পথ-প্রদর্শকের ভূমিকায় থাকুন অপ্রতিরোধ্য ও নমস্য মানুষ হয়ে। 

জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি শতায়ু হোন। সুস্বাস্থ্যে বেঁচে থাকুন আরও অনেক কাল।