প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:০৫

১.
বাংলা সাহিত্যের বর্ণিল ব্যক্তিত্ব, বরেন্দ্র বাংলার ‘চারণ কথক’ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। অনন্য জীবনশিল্পী, সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তিনি ৮২ বছর বয়সে ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে প্রিয় জন্মস্থান গ্রামের বাড়ি মুশির্দাবাদের খোশবাসপুর সমাহিত করা হয়। প্রিয় কথাশিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। বহুমাত্রিক বিন্যাসের মাধ্যমে গল্পের বিচিত্রতায় ভর করে তাঁর সাহিত্য নির্মিত হয়েছে। সেই সাথে বিচিত্র জীবন ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর নানা লেখায়। ছিল বিচিত্র গল্প বলার বৈশিষ্ট্য। তাঁর গল্প ও একাধিক গ্রন্থ ভারতের প্রায় সমস্ত স্বীকৃত ভাষায় অনূদিত হয়েছে, ইংরেজিসহ বিশ্বের বহু ভাষায়ও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মোট ১৫০টি উপন্যাস ও ৩০৬টি ছোট গল্প লিখেছেন। উল্লেখ্য যে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুশির্দাবাদের খোশবাসপুর গ্রামে ১৯৩০ সালে ১৪ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন৷ অলীক মানুষের লেখক অলীকদেশে চলে গিয়ে হয়ে আছেন ‘অলীক মানুষ’। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সৃষ্টিসম্ভার টিকে আছে বাস্তব হয়ে, বাংলা সাহিত্য দূর্গের শক্তিশালী স্তম্ভ, ইতিহাস ও শিল্পের দলিল রূপে। আর এভাবেই অমর সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বেঁচে আছেন তিনি আমাদের মাঝে।
 
২.
বাংলা ভাষার বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের পিতা সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌস, অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ ছিলেন, ছিলেন গান্ধীবাদী, যোগ দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে; মা একসময় কবিতা ও গল্প লিখতেন। সিরাজ তাঁর পিতার সঙ্গে বর্ধমানের কর্ড লাইনে নবগ্রাম রেল স্টেশনের কাছে কিছুদিন ছিলেন । সেখানে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন । সেই নবগ্রাম গোপালপুরের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছিলেন 'প্রেমের প্রথম পাঠ' উপন্যাস । তাঁর লেখক জীবনের প্রথম দিকের অপূর্ব উপন্যাস । গোপালপুর থেকে পাশ করে তিনি ভর্তি হন বহরমপুর কলেজে। তিনি মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের মানুষ। বিল, মাঠ, দ্বারকা নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকায় বেড়ে ওঠা মানুষ ছিলেন। গাছপালা, রঙ বেরঙের প্রাণী, প্রজাপতি, ফড়িং প্রভৃতির উদার আহ্বানে সবসময় তার মনপ্রাণ ভরে উঠেছে। গাঁও-গেরামের বিচিত্র প্রকৃতির সঙ্গে মিশেছিল তার বাড়ির শিক্ষিত পরিশীলিত পরিবেশ। সেই পরিবেশও তাকে আঁকড়ে রেখে আটকাতে পারেনি। তিনি মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেতেন। তার নেশা ছিল যাত্রা, নাটক দেখার। যাত্রাদলের সঙ্গে মিশতে পারায় তাকে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছিল। বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির সংস্পর্শ তাকে বিশেষ ধারার সঙ্গে পরিচিত করেছিল। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহ, আহরণ ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি সেগুলো ব্যবহারে যে স্বচ্ছন্দ তার সবটাই ছিল তার ঘুরে বেড়ানো থেকে আহরণ। 

৩.
প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পলাতক কিশোরের জীবন অতিবাহিত করেছেন৷ রাঢ় বাংলার লোকনাট্য "আলকাপের" সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ে নিমজ্জিত হয়ে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন৷ তিনি ছিলেন 'আলকাপ' দলের "ওস্তাদ" (গুরু), নাচ-গানের প্রশিক্ষক। নিজে আলকাপের আসরে বসে হ্যাজাগের আলোয় দর্শকের সামনে বাঁশের বাঁশি বাজাতেন । নিজের দল নিয়ে ঘুরেছেন সারা পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, এমনকি বিহার-ঝাড়খন্ডেও। তাই পরবর্তী জীবনে কলকাতায় বসবাস করলেও নিজেকে কলকাতায় প্রবাসী ভাবতেই ভালবাসতেন । তাই সুযোগ পেলেই বার বার মুর্শিদাবাদের গ্রামে পালিয়ে যেতেন। সেই পলাতক কিশোর তাঁর চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। ঘুরতেন সেই রাখাল বালকের মাঠে, হিজলের বিলে, ঘাসবন ও উলুখড়ের জঙ্গলে, পাখির ঠোঁটে খড়কুটো আর হট্টিটির নীলাভ ডিম -সেই মায়াময় আদিম স্যাঁতসেতে জগতে । সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আজন্মই কিশোর মন নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। তিনি প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন। প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন তিনি। কৃত্রিম জটিল জগৎকে পাশ কাটিয়ে চলতে চেয়েছিলেন। তার সে ভাবনাগুলোরই প্রতিবিম্ব দেখি আমরা তার কিশোর সাহিত্যে।

৪.
আসলে তিনি প্রকৃতি ও মানুষের যে আদিম সম্বন্ধ তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন বার বার বিভিন্ন রচনায়। তিনি বই পড়তেন লাইব্রেরিতে গিয়ে। আবার বিচিত্র এই লেখক বাঁশি বাজাতেও শিখেছিলেন। ছাত্রজীবনে এবং পরে রাজনীতি ও গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লোকনাট্যদল ‘আলকাপে’র সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন। আগে পরে অনেকদিন ধরেই বাউল, ফকির, বৈরাগী, সাধু, বাউণ্ডুলে, খুনী, ডাকাত আর ছিঁচকে চোরেরা ছিল তাঁর পরম বান্ধব। সাহিত্যজীবনে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, এর ভেতর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিমল করের মতে, এই দুই জন একসঙ্গে হলে তাদের আলাপের কথাবার্তা যারপরনাই উপভোগ্য হয়ে উঠত। বিমল কর তাঁকে বলতেন ‘সিরাজ সাহেব’ আর শীর্ষেন্দু বলতেন, ‘এই যে বাংলার শেষ নবাব’। সিরাজের বাড়ি মুর্শিদাবাদ, তারওপর নামে সিরাজ শব্দটি আছে বলেই বোধকরি শীর্ষেন্দু এমনটা বলতেন। 

৫.
সিরাজের জীবনে ছন্নছাড়া স্বভাবটি পুরোদমে বাজায় ছিল। একসময় জীবিকার টানে কলকাতা বসবাস শুরু করেন, কিন্তু তাঁর গল্প-উপন্যাসের বেশিরভাগ গ্রামের পটভূমিতে লেখা। বাঙালি কবি এবং সাংবাদিক সৈয়দ হাসমত জালাল ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজঃ এক অনন্য জীবনশিল্পী’ শিরোনামে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখছেন, ‘বাবা সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌসী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর ছিল বিভিন্ন বিষয়ের বইপত্র পড়া এবং সংগ্রহের নেশা। সাহিত্যচর্চা করতেন তিনি। ইতিহাসের প্রতি ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। এবং বিস্ময়করভাবে তিনি ছিলেন আধুনিক রুচির মানুষ। তখনকার প্রকাশিত প্রায় সমস্ত পত্রপত্রিকাই আসত ওই গ্রামের বাড়িটিতে। সেখানেই সিরাজ পেয়েছিলেন বই পড়ার অসীম আগ্রহ, যা তাঁর মানসিক বিকাশের সহায়ক হয়েছিল। এরই পাশাপাশি সিরাজের ছিল স্কুল পালানোর নেশাও। বন্য প্রকৃতির মধ্যে রাখালদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কত দিন কেটেছে তাঁর। কৈশোরকাল থেকেই দেখেছেন দ্বারকা-তীরবর্তী বিশাল হিজল অঞ্চলের দুর্ধর্ষ হিংস্র প্রকৃতির মানুষদের, যাদের রক্তে ছিল হত্যার নেশা, আদিম স্বাধীনতাবোধের দুর্দম আবেগ। সিরাজ দেখেছেন, এই স্বাধীনতার স্বাদ মানুষকে খুনি করে, প্রেমিক করে – সে হয়ে ওঠে এমন এক জগতের বাসিন্দা, যেখানে আইন নেই, সমাজ নেই, শাসন নেই, তথাকথিত ধর্ম কিংবা শ্লীলতা-অশ্লীলতা বলে কিছু নেই। সেই বয়সেই সিরাজ উপলব্ধি করেছিলেন, এই দুর্গম রহস্যময় প্রকৃতি ও তার গভীরতর নৈরাজ্যের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা। পরিণত সিরাজের সাহিত্যে এরকমই স্বাধীনতাকামী, নৈরাজ্যবাদী এক চরিত্র শফিউজ্জামানকে দেখতে পাই ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চিরকালীন দ্বন্দকে বাংলা সাহিত্যে অনায়াস দক্ষতায় প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন সিরাজ। দ্বারকা নদীর অববাহিকায় সেই বিস্তীর্ণ দুর্গম তৃণভূমি ছিল তাঁর কাছে মাতৃজঠর-স্বরূপ। প্রকৃতির পাঠশালাতেই হয়েছে তাঁর জীবনশিক্ষার হাতে খড়ি। প্রত্যক্ষ করেছেন প্রকৃতির মায়াবী ও অলৌকিক রূপ। ফসল পাহারা দেওয়া নির্জন চাষা তাঁকে শুনিয়েছে সেই কাশবনে গভীর রাতের জ্যোৎস্নায় নেমে আসা পরীদের কথা। নিবিড় প্রকৃতির কোলে কাঠকুড়ুনি মেয়েদের সঙ্গে রাখালদের ইঙ্গিতপূর্ণ দুষ্টুমি কিংবা অনেক কিশোর-যুবকের প্রেম ও কামনার সংঘর্ষ দেখেশুনে জীবনের গূঢ় ব্যাপার-স্যাপার শেখা হয়ে যায়। কিন্তু এই জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা হয়ত-বা ক্লান্তও করত সিরাজকে। সিরাজ লিখেছেন, ‘অন্যমনস্ক ক্লান্ত বিষণ্ণ হয়ে তৃণভূমি থেকে গাঁয়ে ফেরার সময় আমিও ওদের মতো হঠাৎ পিছু ফিরেছি – কিছু কি ফেলে এলাম? কিছু কি কেড়ে নিল কেউ – ফেরত দিল না? মনে হত, ফেলে এলাম না তো হরিণের মতো কোনও সুন্দর বাছুর? এবং কোনও এক অলীক গৃহস্থকে কৈফিয়ত দিতে হবে ভেবে রাখালদের মতোই বুক কেঁপে উঠত।’ বস্তুত সে এক কালের রাখাল, যে জ্যোৎস্না ও কুয়াশার রহস্যময় মাঠে তরতাজা কবিতার জন্ম প্রত্যক্ষ করেছে, আবার সেই তৃণভূমিতেই ফুটে উঠতে দেখেছে প্রগাঢ় হিংসা ও হত্যার ছবি। সে দেখেছে রক্ত ও অশ্রুপাতের মধ্যে দিয়ে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যই মানুষকে লড়াই করতে হচ্ছে, যে মানুষ প্রকৃতির অন্তর্গত প্রাণীজগতের নিছক শরিক মাত্র। বন্য জন্তু, বৃষ্টি, বন্যা প্রভৃতি প্রকৃতির সহস্র প্রতিকূলতার বিরূদ্ধে এইসব ক্ষুধার্ত মানুষ তাদের পুরুষানুক্রমিক লড়াই ও বেদনার মূল্য পায়নি সভ্য পৃথিবীর কাছে। সেই প্রকৃতিরই ভয়ঙ্করী রূপ উন্মোচিত হল একদিন যুবক সিরাজের কাছে নির্মম মানুষহত্যা আর রক্তপাত দেখতে দেখতে। তাঁর উপলব্ধি হলঃ ‘জীবন ও মৃত্যুর সব রহস্যের উৎস প্রকৃতি – অথচ জীবনের জন্যে যেন তার কোনো করুণা নেই, মৃত্যুর জন্যে নেই কোনো শোক। তার কাছে মানুষ কী অসহায়।’ সিরাজের এই প্রকৃতি বিভূতিভূষণের প্রকৃতি থেকে ভিন্ন। এই প্রকৃতির মধ্যে রক্ত ও অশ্রুর পৃথক কোনও মূল্য নেই। এই প্রকৃতির মধ্যে থেকে অপুর মতো ‘অক্ষত ও নিষ্কলুষ’ হয়ে ফেরা যায় না।’

৬.
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে একঝাঁক লেখক বাংলা সাহিত্যে উদিত হন, যেমন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যশোদাজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়, রতন ভট্টাচার্য, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী - এঁদেরই সঙ্গে আবির্ভাব ঘটে সিরাজের। তবে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল বিপুল,তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র ছিল দ্বারকা নদীর অববাহিকায় আদিম প্রবৃত্তিতে ভরা নারীপুরুষ ও উন্মুক্ত প্রকৃতি। এই এলাকার নাম 'হিজল'। কান্দী মহকুমার অন্তর্গত। তাঁর 'হিজলকন্যা" উপন্যাসে সেই অঞ্চলের নরনারীকে ধরা আছে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখক সত্তায় জড়িয়ে ছিল রাঢ়ের রুক্ষ মাটি। মুর্শিদাবাদের পাশের জেলা বীরভূম, যেখানে লাভপুর গ্রামে তারাশঙ্করের জন্ম। একই জলহাওয়া তাঁদের দুজনকেই প্রাণোন্মাদনা দিয়েছিল। তাই সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বলতেন, "আমার পরেই সিরাজ, সিরাজই আমার পরে অধিষ্ঠান করবে।"

৭.
সিরাজের প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস – “নীলঘরের নটী” প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। একের পর এক প্রকাশিত হয় “পিঞ্জর সোহাগিনী”, “কিংবদন্তীর নায়ক”,“হিজলকন্যা”, “আশমানতারা“, “উত্তর জাহ্নবী”, “তৃণভূমি”, “প্রেমের প্রথম পাঠ”, “বন্যা”, “নিশিমৃগয়া“, “কামনার সুখদুঃখ”, “নিশিলতা”, “এক বোন পারুল”, “কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি”, “নৃশংস”, “রোডসাহেব“, “জানগুরু” ইত্যাদি। তাঁর "ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু", "ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন", "তরঙ্গিনীর চোখ", "জল সাপ ভালোবাসা", "হিজলবিলের রাখালেরা", "নৃশংস", "রণভূমি", "মাটি", "উড়োপাখির ছায়া", "রক্তের প্রত্যাশা", "মানুষের জন্ম", "মৃত্যুর ঘোড়া", "গোঘ্ন", "রানীরঘাটের বৃত্তান্ত", ইত্যাদি অসংখ্য ছোটগল্পের জন্য বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থায়ী আসন পেয়েছেন৷

৮.
‘কর্ণেল’ তাঁর সৃষ্ট একটি গোয়েন্দা চরিত্র । ক্ষুদে ও কিশোর পাঠকদের দাবি মেটাতে তিনি সৃষ্টি করলেন “গোয়েন্দা কর্নেল”নামে একজন রহ্স্যময় চরিত্র , যাঁর মাথা জোড়া টাক, ঠোঁটে চুরুট, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার, এখন প্রজাপতি ও পাখি দেখতে ভালোবাসেন ৷ অথচ তিনি অনেক অপরাধ ও হত্যার কিনারা করে শখের গোয়েন্দাগিরি করেন। “গোয়েন্দা কর্নেল” পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ‘গোয়েন্দা কর্নেল সমগ্র’ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হয়। অনেকের ধারণা, কর্নেলের যে চেহারা ও অবয়ব চিত্রিত হয়েছে তা নাকি ফাদার দ্যতিয়েনের সঙ্গে মিলে যায় !

৯.
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ (জন্ম : ১৪ অক্টোবর, ১৯৩০ - মৃত্যু: ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২) কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে৷ দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে চাকরি ও লেখালেখি সমানতালে চালিয়ে গেছেন। তাঁর জ্ঞান ও অধীত বিদ্যাসমূহ তাঁকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিদ্বানসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাস,সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব- সব বিষয়েই তাঁর বিস্ময়কর জ্ঞান ও বিদ্যার গভীরতা তাঁকে পণ্ডিতমহলে উচ্চ আসন এনে দিয়েছে৷

১০.
তাঁর গল্প ও একাধিক গ্রন্থ ভারতের সমস্ত স্বীকৃত ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এমনকি ইংরেজি তো বটেই, বিশ্বের বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে৷ তাঁর লেখা 'তৃণভূমি" উপন্যাসে কান্দী মহাকুমার এক বৃহৎ অঞ্চল ধরা আছে। "উত্তর জাহ্নবী" উপন্যাসে ধরা আছে এক বিশেষ সময় ও সমাজের কথা, যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত। আর "অলীক মানুষ" এক বিস্তৃত ভুবনের কাহিনী, যা এক মুসলিম পীর বা ধর্মগুরুর বংশে জাত পুরুষের আত্মানুসন্ধান। ব্রিটিশের রাজত্বের শেষভাগে এক পরিবর্তনীয় সময়ের নিখুঁত স্থির ছবি। এই অলীক মানুষ তাঁকে ভিন্ন লেখকের মর্যাদার চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করেছে।

১১.
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ছিল প্রবল। সংবাদপত্রে চাকরি করলেও কোনও মালিকানাগোষ্ঠীর কাছে মাথা নিচু করেন নি। 'অলীক মানুষ' উপন্যাস ছাপা হয় ধারাবাহিকভাবে 'চতুরঙ্গ' নামে একটি লিট্ল ম্যাগাজিনে। "তৃণভূমি" ছাপা হয় অধুনালুপ্ত 'ধ্বনি' নামক এক ছোট পত্রিকায়। বড় পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর সেরা উপন্যাসগুলি ছাপা হয়েছে ছোট পত্রিকায়। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের প্রতি ছিল তাঁর সস্নেহ পক্ষপাত। মিডিয়ার আলো ও প্রচারের প্রতি তাঁর আকুলতা ছিল না। নিজের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে প্রায় একা উন্নত গ্রীবায় ছোট ফ্ল্যাটে জীবনকে কাটিয়ে গেছেন। মাথা উঁচু করে থাকার দর্পী মনোভাবের জন্য তাঁকে অনেক মনোকষ্ট পেতে হলেও তিনি দমে যাননি। তবে তাঁর পাঠকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর। তাঁর ব্যবহারে ও আচরণে ছিল পরিশীলিত ভদ্রতা ও আন্তরিকতা।

১২.
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের 'অলীক মানুষ' উপন্যাসটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার - এসব ছাড়াও ভুয়ালকা পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত। তাঁর 'অমর্ত্য প্রেমকথা' বইয়ের জন্য জন্য তিনি পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতিপুরস্কার। এছাড়া ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার । পেয়েছেন বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার,সুশীলা দেবী বিড়লা স্মৃতি পুরস্কার, দিল্লির OUF সংস্থার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুরস্কার, শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি আরও অনেক পুরস্কার তিনি তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য-কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন। তাঁর অনেক কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, যেমন 'কামনার সুখ দুঃখ' উপন্যাস অবলম্বনে 'শঙ্খবিষ"। দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় 'নিশিমৃগয়া'। উত্তমকুমার অভিনীত 'আনন্দমেলা'। অঞ্জন দাশ পরিচালনা করেছেন সিরাজের ছোটগল্প 'রানীরঘাটের বৃত্তান্ত' অবলম্বনে 'ফালতু'। সিরাজের "মানুষ ভূত" কাহিনী চলচ্চিত্র ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চে ক্রমাগত অভিনীত হয়ে চলেছে৷ এই স্কুল পালানো মানুষটিই পেয়েছিলেন সাম্মানিক ডক্টরেট।

১৩.
অমলেন্দু চক্রবর্তী ‘উপন্যাস ভাবনা’বিষয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রতিবছর প্রকাশিত বাংলা গ্রন্থের তালিকায় উপন্যাসের সংখ্যা যত দীর্ঘতর, শালপ্রাংশু ঔপন্যাসিকের ভগ্নাংশ খুবই সংক্ষিপ্ত। নিশ্চিতই সবটা নৈরাশ্যের নয়। অমিয়ভূষণ স্তব্ধ অনেক কাল। দেবেশ রায় আছেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়দের সঙ্গে অতি তরুণ কিছু লেখক তন্নিষ্ঠ আছেন তাঁদের ব্রতপালনে ঋজুবান। আমাদের প্রত্যাশা এই কতিপয়ের কাছেই।’(এবং মুশায়েরা, তৃতীয় বর্ষ, ৩য় ও চতুর্থ সংখ্যা, অক্টো-ডিসেম্বর ১৯৯৬, পৃ.৬৪)। আবার অশোককুমার মিত্র বলেছেন, 'শুধু কর্নেল কাহিনী নয়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্প নানা রসের নানা ধারার। ভূতের গল্পে, কল্পবিজ্ঞানের গল্পে, রূপকথার গল্পে, মজার গল্পে, মেঘলা দিনের গল্পে তার জুড়ি মেলা ভার। বিচিত্র জীবনযাত্রা তার অভিজ্ঞতার ঝুলিটি যেমন ভরে দিয়েছে তেমনি তাকে গল্পের জোগান দিয়ে চলেছে নিরন্তর স্রোতের মতো।'

১৪.
লেখক স্বকৃত নোমান ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, একজন ঔপন্যাসিকের প্রস্থান’মূল্যায়নমূলক রচনায় বলছেন, ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখেছেন অসংখ্য। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস দেড়শ। এর সবই যে অগ্রসর পাঠকের পাঠযোগ্য তা নয়। লেখালেখিকে জীবিকা হিসেবে নেয়ায় তিনি অনেক বাজে লেখাও লিখেছেন। তবে এও অনুমান করি, কেবল অলীক মানুষ লেখার জন্যই হয়ত তিনি এই বিপুল উপন্যাস লিখে হাত পাকিয়েছেন। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আহত চরিত্রসমূহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে মুস্তাফা সিরাজ যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তার শিল্পরূপ অলীক মানুষ।উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র ধর্মপ্রাণ বদিউজ্জামান লেখকের দাদার আদলে অঙ্কিত, আর তার পুত্র শফিউজ্জামান লেখকের পিতার ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও কাঠিন্যের বিরুদ্ধে দ্রোহবুদ্ধিসম্পন্ন চরিত্রের আদলে অঙ্কিত। উনিশ শতকের পটভূমিতে মুস্তাফা সিরাজের ঔপন্যাসিক বিশিষ্টতা ও ইতিহাসগত বোধ-বুদ্ধি তাঁকে এই উপন্যাস রচনায় বিশেষ সাহায্য করেছে। ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর অনুপুঙ্খ উপাদানসমূহ ও ধর্মীয় মিথের সঙ্গে নিজস্ব কল্পনা ও সৌন্দর্যানুভূতি মিশিয়ে লেখক গড়ে তুলেছেন এই অনন্য মহাকাব্য, উনিশ-বিশ শতকের মুসলিম অন্দর মহলের তথ্যপূর্ণ এক শিল্পিত ডকুমেন্টশন। লেখক নির্মোহভাবে তাঁর সহজাত ভাষায় বুনেছেন অসংখ্য কাহিনী-উপকাহিনীর মধ্যে দিয়ে একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। একশ বছরের এই লৌকিক-অলৌকিকের আখ্যানটি রচিত হয়েছে কোলাজ রীতিতে। কখনো সহজ বয়ানে, কখনো মিথ ও কিংবদন্তী, আবার কখনো ব্যক্তিগত ডায়েরি, সংবাদপত্রের কাটিং জুড়ে দিয়ে দূর সময় ও বিস্ময়কর মানুষের বৃত্তান্ত এঁকেছেন তিনি। কোনো কালের ধারাবাহিকতা নেই এতে। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মিলে মিশে একাকার। এ যেন বাঙালি হিন্দু-মুসলমান জীবনের এক অনাবিষ্কৃত সত্যের উদ্ভাসন।উপন্যাসটি এগারোটি ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় ভারতীয় পাঠকসমাজ এটিকে বিশেষ মূল্য দিয়েছেন। 

১৫.
স্বকৃত নোমান আরো লিখছেন, ‘অপরদিকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তিনশ’রও বেশি ছোটগল্প লিখেছেন। এই বিপুল সংখ্যক গল্পের সবই যে সত্যিকারার্থে গল্প হয়ে উঠেছে- সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তিনি অসংখ্য গল্প লিখেছেন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা ভরানোর জন্য, পত্রিকাওয়ালাদের অনুরোধে বহু গল্প তাঁকে লিখতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর দক্ষিণের জানালা এবং কাটা মুণ্ডুর গল্প, ডালিম গাছের জিনটি, ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু, ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন, মানুষ ভূতের গল্প, তরঙ্গিনীর চোখ, সরাইখানা, জল সাপ ভালোবাসা, হিজলবিলের রাখালেরা, রণভূমি, উড়োপাখির ছায়া, সাপ বিষয়ক একটি উপাখ্যান, রক্তের প্রত্যাশা, মৃত্যুর ঘোড়া, কালবীজ কিংবা রানীরঘাটের বৃত্তান্ত-এরকম প্রায় অর্ধ শত গল্প পড়ার পর মনে হয় না বাকি আড়াই শ গল্প তাঁর লেখা।’

১৬.
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের প্রয়াণের পর ‘বাংলা উপন্যাসের নবাব’ শিরোনামে প্রিয়জন হামীম কামরুল হক লিখেছিলো মননশীল একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। হামীম কামরুল হক লিখেছে, ‘সিরাজের মানসকাঠামোর আরো একটি দিক ধরা পড়ে সালমান রুশদীর ‘দ্যা স্যাটনিক ভার্সেস’-এর সমালোচনায়। সিরাজের মতে, ধর্মের তার কাছে ব্যাধির মতো, কিন্তু কোনোভাবেই তিনি কোনো ধর্মকে আঘাত দিতে চান না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের উপর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি (সুনীল নিজে) সবচেয়ে যে বিষয়টি এড়িয়ে চলতে চান সেটি হল ধর্ম, বিশেষ করে তাঁর লেখার সূত্রে যদি ধর্মে বা কোনো সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তার চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না। তাঁরা সাবধান থাকতে চেয়েছেন, তাঁরা মনে করেছেন আমাদের পাঠকরা আজো তৈরি হতে পারেনি। ফলে জর্জ বানার্ড শ’র মতো কেউ বলতে সাহসী হননি যে, ‘‘অল গ্রেট ট্রুথস বিগিন অ্যাজ ব্ল্যাসফেমিস।” বানার্ড শ’, বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো মনীষীরা ব্রিটিশদের এমন সব কথা বলতে পেরেছিলেন, কারণ সেই ধরনের সভ্য সমাজ সেখানে তৈরি ছিল, ছিল গণতন্ত্রের প্রকৃত ও প্রগাঢ় চেতনা। কিন্তু আমাদের লেখকদের অনেকটাই গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। এর ভেতরে লেখা হয় ‘লালসালু’, ‘চাঁদে অমাবস্যা’, ‘অলীক মানুষ’, ‘ফুলবউ’ ও ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র মতো উপন্যাস। এইসব উপন্যাসে বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় জীবনের নানান প্রকাশ্য ও চোরামোহ এবং অন্তঃশীলা পীড়ন যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা আমাদের আগামী দিনে আরো সাহসী হয়ে উঠতে সহায়তা করার কথা ছিল। কিন্তু দিনে দিনে উলটোটাই ঘটেছে। একদিকে ধর্মীয় বেড়ি আগের চেয়ে শক্ত হয়েছে; অন্য দিকে শরীর সম্পর্কে লালিত সংস্কার আমাদের মুক্তির সেই প্রান্তরে নিয়ে যেতে পারেনি যেখান থেকে সাহিত্যের নতুন যুগ শুরু হতে পারত। ফলে যে কন্দর্প দেবতা বা ইরোস শিল্পের শেকড়ে জল ঢালেন তার সেই জলে আমরা সিক্ত হতে পারি নি। ডি.এইচ. লরেন্সের একটি কথা এ প্রসঙ্গে এসেই পড়ে “My great religion is a belief in the blood, the flesh, as being wiser than the intellect. We can go wrong in our minds. But what the blood feels, and believes, and says, is always true.. ” এই কথার সূত্রে প্রশ্ন জাগে, রক্তমাংসের এই প্রবল দাবীকে যে-লেখকরা অস্বীকার করেন, তারা আমাদের সত্যের দিকে নিয়ে যেতে পারেন কি? কিন্তু সেই মুক্তির দিকে পথটি তো এদিনে নির্মিত হয় না। আমরা মাহ্বুব-উল-আলম-এর ‘মফিজন’-এর কথাটাইবা ভুলে যাচ্ছি কেন? তিনি যে সাহস দেখিয়েছিলেন, ধর্মের নামে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, এবং আত্মপীড়নের যে সুতীব্র দিকটি তিনি উন্মোচন করেছিলেন, সেদিকে আমরা খুব বেশি নজর দেইনি। দেওয়াটা বোধ করি দিনে দিনে আরো কঠিন করে তুলেছি। সেই দিক থেকে সিরাজের মতো লেখকের লেখা ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে আমাদের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগায়। সেখানে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের চলে যাওয়ার অভাবটি আমরা বোধ করি।’

১৭.
বাঙালি কবি এবং সাংবাদিক সৈয়দ হাসমত জালাল ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজঃ এক অনন্য জীবনশিল্পী’ শিরোনামে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখছেন, ‘মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অঞ্চলের একটি গ্রাম খোশবাসপুর। ওই গ্রামের চারপাশে খোলা প্রকৃতি, আদিগন্ত মাঠ, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দ্বারকা নদী ও তার তীরবর্তী বনজঙ্গল নিজে যেভাবে আশৈশব দেখেছি, সেসবই ভিন্নভাবে আবিষ্কার করেছি, উপলব্ধি করেছি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্পে উপন্যাসে আর বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। আমার চোখে দেখা গ্রামীণ মানুষদের তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে নতুন করে চিনেছি বৃহত্তর মানবিক সত্যে, দার্শনিক বোধে। সেখানে তারা হিন্দু মানুষ নয়, মুসলমান মানুষ নয়। তারা এই দেশের মানুষ। সিরাজের ভাষায়, ‘লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাসের পদযাত্রী মানুষ।এভাবে ভাবতে পারা সহজ নয়। কিন্তু সিরাজ পেরেছেন। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গন্ডি তাঁর ভাবনা বা জীবনচর্যাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। অথচ সনাতন ধর্ম থেকে সেমেটিক সব ধর্ম, বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত থেকে কোরান, বাইবেল – এসব যেমন স্বচ্ছন্দে পাঠ করেছেন, শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন মানুষের এইসব জীবনদর্শনে, তেমনি তাঁর আগ্রহ ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে ইতিহাস, দর্শন থেকে ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্বেও। আর দেশ-বিদেশের সাহিত্য তো ছিলই। এসব মিলিয়ে তিনি ছিলেন মূলত ভারতীয় সত্তার মানুষ। গঙ্গা – পদ্মা – অজয় – ময়ূরাক্ষীর অববাহিকায় বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলকে তিনি একসময় চিনেছেন তাঁর করতলের মতো। এইসব গ্রামবাংলার মানুষ তাদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট-হতাশা, আনন্দ-প্রেম-যৌনতা, হিংসা-অশ্রু-রক্তপাত- এমনতরো বৈচিত্র নিয়ে উঠে এসেছে সিরাজের সাহিত্যে, আসলে যা গ্রাম-ভারতের আখ্যান। এ সম্ভবপর হয়েছে, কারণ, কথাসাহিত্যিক সিরাজের মস্তিষ্কে এবং হৃদয়েও অবিরাম কাজ করে গিয়েছে একজন ইতিহাস-গবেষক কিংবা এক নৃতাত্ত্বিক, যে আবহমান মানবসভ্যতা এবং অনন্ত ও রহস্যময় অরকৃতির প্রেক্ষাপটে আবিষ্কার করেছে এক-একটি চরিত্রকে, দ্বন্দে ও সংগ্রামে উদ্দীপ্ত, বিষণ্ণ এইসব প্রকৃতির সন্তানকে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাহিত্যকৃতির পেছনে তাঁর যে বিপুল বৈচিত্রময় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, সগভীর জীবনবোধ এবং মেধা ও পান্ডিত্য সতত ক্রিয়াশীল ছিল, তার পরিচয় পাওয়ার সুযোগ আমার ছিল আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেও। তিনি ছিলেন আমার অগ্রজ, আমার বড়দা। আমার শৈশব-কৈশোরে বড়দা যখন বৌদি ও ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়ে পুজোর ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আসতেন, তখন আমাদের ওই বাড়িটি প্রকৃতই হয়ে উঠত উৎসবময়। সন্ধেবেলা খোলা উঠোনে চেয়ার পেতে বসতেন বাবা, বড়দা এবং অন্য দাদারা। গম্ভীর প্রকৃতির বাবাকেও দেখতাম দাদার সঙ্গে অনর্গল আলোচনায় মগ্ন হয়ে যেতে। মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতি, কখন-বা রাজনীতির প্রসঙ্গ এসে যেত সেসব আলোচনায়। অন্য দাদারাও অংশ নিতেন তাতে। আর আমরা ছোটরা কেউ কেউ একটু দূরে বসে গোগ্রাসে গিলতাম ওইসব আলোচনা। বিভিন্ন লেখক, বইপত্র কিংবা তার বিষয়বস্তু সম্পর্কেও জেনে যেতাম ওইসব আলোচনা থেকে। কলকাতা শহরের সামগ্রিক সংস্কৃতির ছবিটি যেন স্পষ্ট হয়ে উঠত আমাদের কাছে। মনে আছে, একবার বাবার কথায় বড়দা হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গেয়েছিলেন, ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই, শোনো…।’ প্রসঙ্গত, কলেজে পড়ার সময় তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে। আশৈশোব স্কুল পালানো মেধাবী ছাত্র সিরাজের আশ্চর্য দক্ষতা ছিল গান গাওয়া ও বাঁশি বাজানোয়।’

(অকৃপণ ঋণ/তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, বইয়ের দেশ, দেশ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক গণশক্তি, নতুন বার্তা ডট কম, নতুনধারা, দৈনিক জনকণ্ঠ, যায়যায় দিন, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত