জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি
শিল্পী মিতা হক
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:০৮
১.
রবীন্দ্রগানে নিবেদিত শিল্পীর নাম মিতা হক। সঙ্গীত সাধনাই যার জীবনের ব্রত। নিরলস চেষ্টা ও অদম্য ইচ্ছাকে আকড়ে ধরে যিনি এখনও সঙ্গীত সাধনা করে চলেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিজেকে শিক্ত করার পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর সঙ্গীত লব্ধ জ্ঞান। স্বনামধন্য শিল্পী মিতা হক ১৯৬২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রিয় শিল্পী মিতা হকের জন্মদিনে তাকে জানাই নিরন্তর শুভেচ্ছা … । আমাদের সঙ্গীতের সুরের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র মিতা হক বাংলাদেশ টিভি ও বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী। তার একক ভাবে মুক্তি পাওয়া ২৫টির মতোন অ্যালবাম আছে। এর মধ্যে ১৪টি ভারত থেকে ও ১১টি বাংলাদেশ থেকে। তিনি ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা লাভ করেছেন। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক বেশকিছুদিন যাবৎ অসুস্থ। আমরা তার আশু আরোগ্য কামনা করি।
২.
সুরের মহান সাধিকা মিতা হক, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সংগীত শিল্পী ও শিক্ষক। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সহসভাপতি তিনি। ছায়ানটে শেখাচ্ছেন বহুদিন ধরে। নিজের গানের স্কুল সুরতীর্থ পরিচালনা করছেন ২৫ বছর ধরে। রবীন্দ্রসংগীত শেখানো আর সাংগঠনিক কাজ নিয়েই ব্যস্ত আছেন। আজন্মের বাঙালি সংস্কৃতির শুদ্ধতায় নিমগ্ন শিল্পী অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ, লালনই কেবল করেন না, বিকাশেও নিরন্তর সচেষ্ট। শিল্প-সংস্কৃতির একনিষ্ঠতায় সামাজিক দায়িত্বশীল ভূমিকাকেও অস্বীকার করেন না বলে নানান ইতিবাচক কর্মৃকান্ডের সাথে সম্পৃক্ততা দেখতে পাই। আর তাই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক বিনয়ের সাথে স্বীকার করেন- সমাজের মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে তার খুব ভালো লাগে। রবীন্দ্রসঙ্গীতসহ পঞ্চকবির গানও তার কণ্ঠে শ্রোতার মনে আবেগ জাগায়, ভাবনাকে তাড়িত করে।
৩.
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক সঙ্গীতপ্রেমী পরিবারে বড় হওয়ায় গানের জন্য আলাদা কোন স্কুল বা একাডেমীতে ভর্তি হননি। তাঁর চাচা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্র গবেষক ওয়াহিদুল হক। আর তাই প্রথমে চাচা ওয়াহিদুল হক এবং পরে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সনজিদা খাতুনের কাছে বাড়িতেই গান শেখেন তিনি৷ এরপর ১৯৭৭ সাল থেকে নিয়মিতভাবে গণমাধ্যমে গাইতে শুরু করেন৷পরিবারের সুরের ধারার ঐতিহ্য ধারণ ও বহন করছেন তিনি। ফলে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কাছের শিল্পী আপনজন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে দেরি হয়নি তার। নানা গুণিজনের পরম সান্নিধ্যে সুর সাধনার সঠিক ধারাকে ধরতে পেরেছেন, সঠিক সুরের যথার্থৃ প্রকাশ পায় তার কণ্ঠে। রবীন্দ্রনাথ সুর-বাণী সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বকবির সৃষ্টিরে নান্দনিক দিকটার গুরুত্ব পেতে দেখি তার কণ্ঠে।
৪.
প্রথিতযশা পরিবারের সদস্য হওয়াতেই কি তার জায়গা করে নিতে কোন সমস্যা হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে মিতা হক বলেন, তার পরিবারের কোন সদস্য কখনো তাকে তারকা বানানোর চেষ্টা করেনি৷ বাংলাদেশের অভিজ্ঞ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা একটি বিশেষ ঘরানা তৈরী করে রেখে তাতে নতুন কাউকে ঢুকতে দেননা এ অভিযোগ কতটা সত্য তা জানতে চাওয়ায় তিনি বলেন, কাউকে ঢুকতে না দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে তারা যেটি বলেন, রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে নিরীক্ষার কোন সুযোগ নেই, ফিউশন রবীন্দ্রসংগীত অচিরেই মিলিয়ে যাবে৷ মিতা হকের মতে এই প্রজন্ম এখনো রবীন্দ্রসংগীত শোনে এবং ভালবাসেন।
৫.
১১ বছর বয়সে তিনি বার্লিনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিশু উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি তবলা বাদক মোহাম্মদ হোসেন খান এর কাছে সঙ্গীত শেখা শুরু করেন। মিতা হক সুরতীর্থ নামে তিনি একটি গানের স্কুল পরিচালনা করেন। তিনি ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের রবীন্দ্র সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদের সহসভাপতি হিসেবে গুরুদায়িত্বও পালন করছেন।
৬.
সংগীতে অনন্য অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিল্পকলা পদক, চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। মিতা হক ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। এরপর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মিতা হককে বাংলা একাডেমির ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ দেওয়া হয়। রবীন্দ্র পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫০ হাজার টাকা। একই বছর চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ‘রবি-চ্যানেল আই রবীন্দ্রমেলা’য় রবীন্দ্র সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মিতা হককে সম্মাননা দেওয়া হয়। এই সম্মাননা হিসেবে ক্রেস্ট ও ৫০ হাজার টাকার অর্থমূল্যের চেক দেওয়া হয় তাকে।
৭.
মিতা হক অকাল প্রয়াত স্বনামধন্য অভিনেতা-পরিচালক নাট্যজন খালেদ খানকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র সন্তানের নাম ফারহিন খান জয়িতা। উল্লেখ্য, জয়িতাও একজন সম্ভাবনাময় সংগীত শিল্পী হিসেবে আমাদের সংগীত ভূবনে বিশেষ দৃষ্টি কেড়েছে। আলোকিত পরিবারের উত্তরাধিকারী জয়িতার নিরন্তর সাফল্যও কামনা করছি।
৮.
রবীন্দ্রচর্চার আগ্রহ গভীর হচ্ছে বলে মনে করেন মিতা হক। তবে শিল্পীরা চর্চামুখী না হয়ে প্রচারমুখী হচ্ছে বলেও মনে করেন মিতা হক। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক আরো বলছেন বিশেষ দিনেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আয়োজন বেশি হয়। এজন্য তিনি খুব দুঃখ পান। শিল্পীর ভাষায়, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল আমাদের প্রথম পরিচয়। সারাবছর তাদেরকে নিয়ে অনেক বেশি অনুষ্ঠান হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দেখি উল্টো। কেন? বিশেষ দিনের জন্য আমরা সব সময় অপেক্ষা করি। চ্যানেলগুলোকে আরও এগিয়ে আসা দরকার। মিডিয়ার কিছু দায়িত্ব আছে। এখন অনেক শিল্পী তৈরি হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতের অনেক শিল্পী আছে, যারা অনেক ভালো গান করে। শিল্পীর অভাব নেই। তাই বিশেষ দিবসের জন্য অপেক্ষা না করে আরও বেশি বেশি আয়োজন হওয়ার উচিত।’
৯
বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত রবীন্দ্র পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, আমার ক্যারিয়ারে খুব বেশি পুরস্কার পাওয়া হয়নি। তবে একেবারেই যে পাইনি তা নয়। পুরস্কার বেশি না পেলেও মানুষের মন থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তার চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে। এবার বাংলা একাডেমির এই পুরস্কার পেয়ে আমি ভীষণ আনন্দিত। এটা বড় একটা প্রাপ্তি। বাংলা একাডেমি থেকে পুরস্কার পাওয়া আমার জন্য অনেক সম্মানের।
১০.
বর্তমান প্রজন্মের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কেমন? বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা অনেক ভালো গান করেন। কিন্তু তাদের মাঝে একটা ট্রেন্ড চালু আছে। শিল্পীরা চর্চামুখী না হয়ে প্রচারমুখী হচ্ছে বেশি। টেলিভিশনে নিজেকে বারবার দেখানোর জন্য এগিয়ে যায়। এটা তাদের বড় ভুল। তাদের বোঝা উচিত গুণ থাকলে গুণের দাম অবশ্যই একদিন পাওয়া যাবে। তারা যদি নিয়মিত চর্চা করে তাহলে তাদের ভবিষ্যত্ অনেক ভালো হবে।
১১.
মেয়ে জয়িতার অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। মায়ের চোখে জয়িতা শিল্পী হিসেবে কেমন? জবাবে তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি জয়িতার ভালোবাসা ও নিষ্ঠা আমাকে খুশি করেছে। এখনও বয়স অনেক কম। হয়তো এখনও জয়িতা আমার চোখে পরিপূর্ণ শিল্পী না। তবে আমার বিশ্বাস, সে একদিন অনেক ভালো শিল্পী হবে। কারণ গানটা সে মন দিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করে। গানের প্রতি তার আস্থা ও মনোযোগ দেখে আমি ভীষণ আনন্দিত।
১২.
অনেক দিন অ্যালবামে তার নতুন কোনো গান না আসা নিয়ে বলছেন, ‘এতো বেশি অলস হয়ে গেছি, আমার মনে হয়, এখন আর ওসব হবে না। পরে দেখব। তবে আমি জয়িতার গানের দিকে বেশি নজর দিচ্ছি। এখনই ওকে ঠিকঠাক করে গানটা গাইতে হবে।’ তার প্রিয় শিল্পীদের নিয়ে, পছন্দের শিল্পীদের বিষয়ে বলছেন, ‘শ্রীকান্ত আচার্য, গিরিজা দেবী, অদিতি মহসিন, শিমু দে- অনেকের গানই ভালো লাগে। আমার মেয়ের গাওয়া গানও ভালো লাগে।’
১৩.
আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন মিতা আপা সবসময় সবাইকে নিয়ে।
লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা