প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আকিরা কুরোসাওয়া

‘আমি মনে করি আমার সব ছবিরই একটা সাধারণ বিষয়বস্তু রয়েছে। সেই সাধারণ বিষয়টি হলো প্রকৃতপক্ষে একটি প্রশ্ন: মানুষ কেন সুখী হতে পারে না?’ - আকিরা কুরোসাওয়া

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:১২

১.
প্রখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, সম্পাদক ও চিত্রনাট্যকার আকিরা কুরোসাওয়ার মৃত্যুবার্ষিকী আজ । বিংশ শতাব্দীর সেরা পরিচালকদের একজন তিনি। জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়াকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘রশোমোন (১৯৫১)’, যা জাপানি চলচ্চিত্রকে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়। ১৯৯০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুর পর বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে ‘শতাব্দীর এশিয়ান’ নামে অভিহিত করে। প্রাক্তণ সামুরাইদের বংশধর আকিরা কুরোসাওয়ার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, আকিরা কুরোসাওয়া ১৯১০ সালের ২৩ মার্চ টোকিওর ওমরি জেলার ওইম্যাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ছিল সানশিরো সুগাতা (১৯৪৩) এবং শেষ চলচ্চিত্র মাদাদাইয়ো (১৯৯৩)। তাঁর দুটি চলচ্চিত্র সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কার লাভ করে। তিনি একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি মোট ৩১টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। কুরোসাওয়া শুধু নির্মাণ, চিত্রনাট্য বা পরিচালনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন তা নয়, তিনি চলচ্চিত্রের কারিগরি দক্ষতা, সমালোচনা ও শিল্প কোন মানুষের জন্য নির্মিত হবে, সে অবস্থানও নির্ণয় করেছেন, যা তাঁর সমসাময়িক এবং পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাতারা ব্যাপক অনুসরণ ও অনুকরণ করছেন।

২.
‘সিনেম্যাটিক বিউটি অবশ্যই তাই, যা কোনো ফিল্মে বর্তমান থেকে সেই ফিল্মকে ফিল্ম হয়ে ওঠার চলমান চিত্ররূপে দৃশ্যায়িত করে।’ - আকিরা কুরোসাওয়া
বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রেক্ষাপটে আকিরা কুরোসাওয়া এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছবিতে সব সময় উপস্থাপন করেছেন নিজ দেশের সংস্কৃতি। এশীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে তাঁর ছবিই প্রথম বিশ্ব দর্শকের নজর কাড়ে। একই সঙ্গে প্রথম বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে জিতে নেয় অস্কার পুরস্কার। তিনি দেখিয়েছেন, কেমন করে সাহিত্যনির্ভর ভাল ছবি নির্মাণ করা যায়। এ আয়োজনের মাধ্যমে তাঁর সিনেমা সম্পর্কে এদেশের চলচ্চিত্র অনুরাগীরা ধারণা পাবে। নতুন নির্মাতারা জানতে পারবে কিভাবে নিজস্ব সংস্কৃতিকে চলচ্চিত্রে ধারণ করে বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করা যায়।আপন সৃষ্টিতে তিনি আমোদিত করেছেন বিশ্ব চলচ্চিত্রানুরাগীদের। সিনেমা নির্মাণে নিজস্ব ভাষা ও করণকৌশলে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এই নির্মাতা। সেই সূত্রে জয় করেছেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। স্বতন্ত্র আঙ্গিকের উপস্থাপনায় বিংশ শতাব্দীর সেরা পরিচালকদের মধ্যে উচ্চারিত হয় তাঁর নামটি।- স্টিভেন স্পিলবার্গ স্বীকার করেন, ‘দুনিয়ার অন্য কোনো ফিল্মমেকারের কাছ থেকে আমি যতটা না শিখেছি আকিরা কুরোসাওয়ার নিকট হতে নিয়েছি তারও অধিক।’ তিনি ছিলেন প্রবল আশাবাদী স্রষ্টা, স্বপ্নবান নির্মাতা। তাঁর শেষ ছবি মাদাদায়োর বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘এখনো না’! হয়তো তিনি ভেবেছিলেন এখনো ক্ষান্ত দেওয়ার সময় আসেনি!…স্বাপ্নিক মানুষরা চিরটাকাল স্বাপ্নিকই থেকে যায়। তবে মানবতা ও মূল্যবোধকে সর্বদা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হিসেবে ভাবা বিষন্ন নিয়তিবাদী কুরোসাওয়ার সব ছবিতেই দেখা যায় জীবনের উদযাপন, আছে জীবনের অফুরন্ত জয়গান। আকিরার সিনেমার প্রেক্ষাপট হিসেবে বারবার ফিরে এসেছে আশাহীন পৃথিবী। আর তাঁর চরিত্ররা প্রতিনিয়ত আশা অক্ষুন্ন রাখার জন্য সংগ্রামরত থাকে। এই সংগ্রাম শুধুমাত্র আকিরা কুরোসাওয়ার ছবির মানুষদের সংগ্রাম নয়… এটি আপামর জনসাধারণের সংগ্রাম। তাই যুদ্ধবিরোধী, পরমাণু বোমাহীন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, নিসর্গপ্রেমী, শান্তিকামী সকল মানুষই এই সংগ্রামের সমান অংশীদার।

৩.
‘ছবির কথা যদি মুখে বলতে পারা যেত তাহলে ক্যামেরায় তোলার আর দরকার হতো না, হতো কি?’-- আকিরা কুরোসাওয়া
চলচ্চিত্রকে বলা হয় সময়কে কাজে লাগানোর শিল্প, এই সময়কে পরপর গেঁথে আখ্যান তৈরি করা হয় সম্পাদনার টেবিলে। আকিরা বলেন, ‘সম্পাদনা কক্ষেই প্রকৃত জীবনের সূচনা হয়। সেই ধরনের জীবন ও গতি যা আমি চাই। … সহকারী পরিচালক রূপে কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমি জেনে গিয়েছিলাম যে সম্পাদনা করতে না জানলে চিত্রপরিচালক হওয়া যায় না। বাছাই-সংযোজনের শেষ পর্ব এই সম্পাদনা। তার চেয়েও বড় কথা, নির্মিত ছবির মধ্যে গতিসঞ্চার ও জীবনসৃষ্টির পদ্ধতিই হচ্ছে সম্পাদনা।’ আকিরা কুরোসাওয়া পরিচালনার পাশাপাশি নিজেই সম্পাদনা করতেন। এই সব বিশিষ্ট গুণ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁকে নিয়ে গিয়েছে অনন্য উচ্চতায়।

৪.
‘আমি তাঁদের (সমালোচক) বলতে চাই, মস্তিষ্ক নয়, হৃদয় দিয়ে ছবি দেখতে। কারণ আমি সেভাবেই সিনেমা করে থাকি।’-- আকিরা কুরোসাওয়া
আকিরা কুরোসাওয়ার মা সীমা ওসাকা ছিলেন বণিক পরিবারের সদস্য আর বাবা ইসামাউ ছিলেন সাবেক সামুরাই পরিবারের সদস্য। সেনাবাহিনীর শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটে তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ চলে। খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর পিতা তাঁকে চলচ্চিত্রে উৎসাহিত করেন। ছয় বছর বয়সে দেখা একটি সিনেমা তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাঁর জবানিতে জানা যায় তাচিকাওয়া নামের শিক্ষার্থীবৎসল একজন গুরুর গল্প, যিনি শৈশবে আঁকিবুকির ক্লাসে তাঁকে যারপরনাই উৎসাহ দিয়ে থাকতেন। আকিরার মতে, ওই শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তাঁর মনের জানালায় কোনো একদিন আবিষ্কার করেন দৃশ্যকল্পের আসমান-জমিন। শৈশবে এভাবেই আকিরার মন রং-পেনসিলের স্বচ্ছ ভালোবাসায় সিক্ত হয়। ছাত্রাবস্থায় আর্ট স্কুলে একজন প্রতিভাবান পেইন্টার রূপে সুবিদিত আকিরা দীক্ষালাভ করেন পশ্চিমা কলাশৈলীতে। ১৯২৩ সালে কিপয়াটো রাজ্য ভূমিকম্পে ব্যাপক বিধ্বস্ত হয়। মানুষের ধ্বংসাবশেষ, ছিন্নভিন্ন দেহ, বিধ্বস্ত প্রকৃতি তাঁর মানসিকতায় প্রভাব ফেলে। এর কিছু দিন পর তাঁর ভাই আত্মহত্যা করে- এ সবই কুরোসাওয়ার নিজের ভেতরে শিল্পীসত্তাকে জাগিয়ে তোলে। নীরবে তিনি এসব পর্যবেক্ষণ করেন। স্থানীয় থিয়েটারে ছেলেবেলা থেকেই কাজ করতেন আর ভাইয়ের মৃত্যুর পর লেখেন প্রথম চিত্রনাট্য। তিনি প্রগতিশীল আন্দোলনেও নিজেকে নিয়োজিত করেন। আর্ট স্কুলের পাট চুকিয়ে ১৯২৮ সালে নিট্টেন প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রথম সৃজনশীলতার স্বীকৃতি পান। পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৯ সালে সমমনা একদঙ্গল তরুণ শিল্পোৎসাহীর সঙ্গে যুক্ত হন প্রলেতারিয়েত শিল্পী সংঘে, যাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল উনিশ শতকের রুশ সাহিত্য, তবে সাকির গেলাস হাতে নিয়ে ফিওদর দস্তয়ফস্কিকে ঘিরে কথার তুবড়ি ছুটত সবচেয়ে বেশি। দস্তয়ফস্কি সম্পর্কে তাঁর অভিমত, ‘তিনি মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে খুবই সৎভাবে তাঁর লেখা করেছেন।’ সংঘে যোগদানের ক্ষেত্রে আকিরার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শিল্পচর্চার এই নব আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা ও বোঝা। 

৫.
চলচ্চিত্রের ভাষা সৃষ্টিতে অবদান ও শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্মাণের দরুন যে ক’জন চলচ্চিত্রকার বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে আকিরা কুরোসাওয়া (জন্ম: ২৩ মার্চ ১৯১০ – মৃত্যু: ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮) অন্যতম। আকিরা কুরোসাওয়ার অনুপ্রেরণাদাতার তালিকায় আরো পাওয়া যায় সহোদর হেইগোর নাম। হেইগোর বদৌলতে তাঁর সিনেমার সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয় ঘটে। সিনেমা পাগল হেইগো কাজ করতেন ভিনদেশি নির্বাক ছবির ধারাভাষ্যকার বা বেনশি হিসেবে। সিনেমা মাতাল ভাইটির আকস্মিক আত্মহত্যা আকিরার সংবেদনশীল মনে বইয়ে দেয় মগ্নচৈতন্যের শিস। আকিরার বয়স যখন বিশের একটু ওপরে তখন হেইগো আত্মহত্যা করেন। এর চার মাস পরে কুরোসাওয়া পরিবারের বড় ছেলে মারা যান। চারজন ছেলের মধ্যে তখন কেবল আকিরাই বেঁচে থাকেন। তখন তাঁর বয়স ছিল তেইশ বছর। ১৯৩২ সালে প্রলেতারিয়েত শিল্পী সংঘ থেকে বের হয়ে এসে পেইন্টার হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও ঠিক মন বসাতে পারছিলেন না। মাঝে কেটে যায় আরো বছর তিনেক। এমন দশায় নতুন কিছু করার কথা ভাবছিলেন। ১৯৩৫ সালের কোনো এক সকালে প্রাতরাশের থালায় চোখ আটকে যায় দৈনিকের পাতায়। নতুন ফিল্ম স্টুডিয়ো ফটো কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিজে (পরবর্তী সময়ে যার নাম হয় তোহো) লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে সহকারী চিত্রপরিচালক পদে আবেদন করেন এবং কাজিরো ইয়ামামোতোর নির্দেশনায় শ্র“তিচিত্র নির্মাণকর্মে নিযুক্ত হন। ইয়ামামোতো আকিরাকে যত না পছন্দ করতেন সহকারী হিসেবে, ততোধিক ভালোবাসতেন সিনেমা ছাড়াও জগতের অন্য সব বিষয়ে তাঁর জানাশোনা ও অভিনিবেশের কারণে! কর্মাসক্ত আকিরা নিয়োগের পাঁচ বছরের মধ্যে ইয়ামামোতোর ছায়াছবিগুলোর জন্য পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করেন এবং আস্ত একেকটা সিকোয়েন্সের নির্দেশনা দিতে আরম্ভ করেন। নিজের কাজের প্রতি চরম যত্নবান এই কারুশিল্পীর পাকা হিসাবির মতো শুটিং-পূর্ব যাবতীয় আয়োজন এন্তেজাম করা ও চিত্রগ্রহণক্ষণে পুরো পরিস্থিতির ওপর দখল রাখার ব্যাপারে আছে ঈর্ষণীয় সুনাম। তিনি সেট ডিজাইন থেকে আরম্ভ করে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সরণপথ পর্যন্ত জ্যামিতির মাপে ছেঁকে ফেলতেন… ঠিক যে মতে একজন পেইন্টার তাঁর ক্যানভাসকে ভাগ করে ফেলে থাকেন। বস্তুত আমরা জানি, আকিরার মানসে দৃশ্যকাব্য প্রথম হাজির হয়েছিল পেইন্টিংয়ের বিমূর্ত কল্পনা নিয়ে। তবে বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে ‘প্রতিদিনকার একঘেয়েমির মধ্যে তখন সিনেমা আমাকে যে বৈচিত্র্য এনে দিত, সিনেমা দেখায় আমি যে আনন্দ পেতাম, তা আর কোথাও পেতাম না। তাই সিনেমা আমি প্রাণভরে উপভোগ করতাম। ছোটবেলায় দেখা অনেক ছবির বিশেষ বিশেষ অংশ আমার স্মৃতিতে আজো অম্লান হয়ে আছে।’ এই গল্পের সূত্র ধরে আমরা খোঁজ পাই তাঁর প্রিয় সিনেমা টিচার ইয়ামামোতোর। আকিরা বলতে থাকেন, ‘মহাত্মা ইয়ামামোতো ছিলেন সব সেরা শিক্ষকদের একজন। তিনি তাঁর অসামান্য পদ্ধতিতে আমাদের কাজ শিখিয়েছিলেন। তিনি, মনে হয়, তাঁর অধীত বিদ্যার সবটাই আমাকে শেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বলতেন, ‘আমি কুরোশাওয়াকে এটুকুই শিখিয়েছি যে কী করে মদ খেতে হয়। এর বেশি আর কিছুই না।’ ইয়ামামোতো ছিলেন ইয়াসিজিরো ওজুর সমসাময়িক বাস্তববাদী চিত্রনির্মাতা। আকিরা মনে করেন, ইয়ামামোতো শিক্ষক হিসেবে সফল। কেননা ইয়ামামোতোর কাজের সঙ্গে তাঁর সহকারীদের কাজের কোনো মিল নেই। তাঁর অনুপ্রেরণার তালিকায় আরো আছেন জন ফোর্ড, আবেল গাঁসের ‘লা রু’, ভাববিলাসী জর্জ স্টিভেন্সের ছবি, জঁ রেনোয়ার ‘মাই লাইফ অ্যান্ড মাই ফিল্মস’, ফ্রাঙ্ক কাপরা, উইলিয়াম ওয়াইলার এবং অবশ্যই কেঞ্জি মিজোগুচি। পাশাপাশি তিনি আরেকজনের নাম নিয়েছেন, যিনি তাঁকে ‘প্রভাবান্বিত করেননি কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয় পরিচালক’, তিনি মাইকেল আন্তোনিয়নি!

৬.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আকিরা তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করেন, যার নাম ছিল সানশিরো সুগাতা। শিল্পের মধ্য দিয়ে কিভাবে এসব প্রকাশ করা যেতে পারে- এ ভাবনা থেকে নির্মাণ করেন ‘সুগাতা’ । অভিনেতা তোশিরো মিফুনেকে নিয়ে ১৯৪৮ সালে নির্মাণ করেন ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল। কুরোসাওয়া ও মিফুন এরপর একে একে ১৬টি ছবিতে জুটি বেঁধে কাজ করেন। জাপানি চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা ছবি রশোমন (১৯৫০)-এর জন্মও এই জুটির হাত ধরেই। কুরোসাওয়া এই ছবি দিয়ে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন এবং পরবর্তীকালে একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার চেয়েও বড় পুরস্কার হলো, রশোমন দিয়েই জাপানি চলচ্চিত্র নিজেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যায়।

৭.
ওই সময় কুরোসাওয়া এমন কিছু কৌশল রপ্ত করেছিলেন, যা তাঁর ছবিগুলোকে অনন্য করে তুলত। ছবির শুটিংয়ের সময় তিনি টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করতেন। কারণ, তাঁর বিশ্বাস ছিল, অভিনেতার কাছ থেকে ক্যামেরা দূরে রাখলে অভিনয় ভালো হয়। এ ছাড়া তিনি একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। একাধিক ক্যামেরা ব্যবহারের জন্যই অ্যাকশন দৃশ্যগুলো বিভিন্ন কোণ থেকে দেখানো সম্ভব হতো। কুরোসাওয়ার ছবির আরেকটি বড় ট্রেডমার্ক হলো, ভাব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আবহাওয়ার সাহায্য নেওয়া। রশোমন-এর শুরুর দৃশ্যে অঝোর বৃষ্টিপাত, সেভেন সামুরাই-এর শেষ যুদ্ধের দৃশ্য, স্ট্রে ডগ-এর প্রচণ্ড উত্তাপ, ইয়োজিম্বোতে তীব্র শীত, ইকিরুতে তুষারপাত এবং কুমোনোসুজোতে কুয়াশা।

৮.
আকিরা চলচ্চিত্র মহলে টেনো বা সম্রাট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কাক্সিক্ষত ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট তৈরির জন্য তিনি বিপুল সময় ও শ্রম ব্যয় করতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে পারফেকশনিস্ট বলা চলে। রশোমনের শুরুর দৃশ্যে ভারী বৃষ্টিপাত ফুটিয়ে তোলার জন্য শুটিং এলাকার স্থানীয় পানির পুরোটাই শেষ করে ফেলেছিলেন। আর এই পানির সঙ্গে ক্যালিগ্রাফির কালি মিশিয়ে কালো রঙের সৃষ্টি করেছিলেন। কারণ, কালো রঙের বৃষ্টির গাঢ়তা আরও ভালো বোঝা যায়।

৯.
তিনি মনে করতেন অভিনেতাকে সিনেমার শটের জন্য সম্পূর্ণ নতুন পোশাক দিলে বিষয়টা বাস্তবসম্মত হয় না। এ জন্য অনেক সময় তিনি অভিনেতাদের শুটিংয়ের এক সপ্তাহ আগে পোশাক দিয়ে দিতেন। অভিনেতাদের প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই পোশাক পরতে হতো এবং পোশাকের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হতো। বিশেষ করে সেভেন সামুরাই ছবিতে এটার দরকার পড়েছিল। কারণ, এ ছবির লোকজন অধিকাংশই ছিলেন গরিব কৃষক। এ কারণে অভিনেতাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা যেন কাপড়গুলো এমনভাবে পরেন, যেন শুটিংয়ের সময় বোঝা যায়, সেটার অবস্থা ভালো না। আবহ সংগীত নিয়েও তাঁর ছিল ভিন্নমত। পরিপূর্ণ সংগীত চলচ্চিত্রের সঙ্গে যায় না বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। এ কারণে ছবির জন্য গান ও সুর নির্বাচনের বেলায় তিনি সেটাকে একটি মাত্র বাদ্যযন্ত্রে নামিয়ে আনতেন। অর্থাৎ একটি সুরের জন্য কেবল একটি বাদ্যযন্ত্রই ব্যবহূত হতো। অবশ্য ছবির শেষের দিকে পরিপূর্ণ সংগীতের ব্যবহার বাড়িয়ে দিতেন।

১০.
সমালোচকদের মতে, ‘আকিরা কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্র বাস্তবধর্মী। সমাজে ঘটে যাওয়া সঙ্গতি-অসঙ্গতি তিনি চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেন নিখুঁতভাবে। সেখানে তাঁর শিল্পসত্বারও ঘাটতি পড়েনি। তিনি কখনও কখনও সমসাময়িক টেকনোলজি ব্যবহার করেছেন। তাঁর প্রতিটি ছবি দেখলে, অন্য নির্মাতাদের থেকে খুব সহজেই তাঁকে আলাদা করা যায়। তিনি খুব ছোট বয়সে যে চলচ্চিত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, জীবনের শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করার জন্য চেষ্টা করে গেছেন। আগামী প্রজন্মের জন্য তাঁর চলচ্চিত্র এক মাইল ফলক হয়ে থাকবে।’ 

১১.
জাপানী চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুপরিচিত করার জন্য তাঁর অবদান অন্যতম। শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ ও ‘কিং লিয়ার’ অবলম্বনে নির্মাণ করেন যথাক্রমে ‘থ্রোন অব ব্লাড’ (১৯৫৭) এবং ‘র‌্যান’ (১৯৮৫) চলচ্চিত্রদ্বয়, যা সম্পূর্ণ জাপানী সংস্করণে নির্মিত। ‘দেরসু উজালা’ (১৯৭৫) নামক চলচ্চিত্রে তিনি মানবিক বোধকে উপস্থাপন করেন। এই চলচ্চিত্রে তিনি প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক এবং মানুষ ও জন্তুর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করেন। প্রধান চরিত্র দেরসু যিনি জীবনের একটা বিশাল সময় সাইবেরিয়ার গহিন অরণ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন, অরণ্যের ভয়ঙ্কর সব জানোয়ারগুলো তাঁকে কোনদিন আক্রমণ করেনি। অথচ তাঁকে মানুষের হাতেই জীবন দিতে হয় সামান্য একটি অস্ত্রের জন্য। ভয়ঙ্কর জানোয়ারের চাইতেও স্বার্থের কারণে মানুষ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা এই চলচ্চিত্রে তিনি ব্যক্ত করেন। এই চলচ্চিত্রটি বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয় এবং শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কার পুরস্কারও লাভ করে। সত্য কতটা আপেক্ষিক এবং মানুষ ও তার অভিজ্ঞতা অনুসারে দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যক্ষণ কতটা ভিন্ন হতে পারে তা রশোমন চলচ্চিত্র সুন্দরভাবে নির্ণিত করে। চলচ্চিত্রে বাস্তবতাকে পুন:উপস্থাপনে চিত্রগ্রহণে নানাবিধ কম্পোজিশন কৌশল অবলম্বন তাঁর রশোমন চলচ্চিত্রে প্রতীয়মান হয়। প্রতিটি চরিত্রের অভিব্যক্তি ও স্থানের বাস্তবতাকে সেলুলয়েডে তুলতে এবং সঙ্গে দর্শককে ওতপ্রোতভাবে জড়ানোর জন্য তিনি প্রতিটি ইমেজকে সার্থকভাবে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন।কাহিনীর আঙ্গিক নির্মাণে তিনি নতুন নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করেন, যেন দর্শকের নিকট কাহিনীটি বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য হয়। চলচ্চিত্র ভাষা বিনির্মাণে তাঁর স্বতন্ত্র শিল্পচেতনা উল্লেখযোগ্য। 

১২.
শৈল্পিক নৈপুণ্যে ও নান্দনিকতার নিদর্শনে অলঙ্কৃত হয়ে আছে কুরোসাওয়ার সব চলচ্চিত্র। সারা বিশ্বে প্রতিটি প্রজন্ম আকিরা কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্র দ্বারা অনেকটা অনুপ্রাণিত হয়ে আসছে। চলচ্চিত্রের ভাষা ও আঙ্গিকগত উৎকর্ষ সাধনে আকিরা কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্রসমূহ বিশ্বচলচ্চিত্র ইাতহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। তাঁর বহুল আলোচিত আরও বেশ কয়েকটা চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘ইকিরু’ (১৯৫২), ‘সেভেন সামুরাই’ (১৯৫৪), ‘হিডেন ফোর্টেস’ (১৯৫৮), ‘দি ব্যাড স্লিপ ওয়েল’ (১৯৬০), ‘ইয়োজিম্বো (১৯৬১), ‘হাই এ্যান্ড লো’ (১৯৬৩), ‘রেড বিয়ার্ড (১৯৬৫), ‘কাগেমুশা’ (১৯৮০) উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৩ থেকে শুরু করে সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘মাদাদায়ো’ (১৯৯৩) সহ তিনি সর্বমোট ৩১টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। জাপানের স্থানীয় কাহিনীগুলোকে চলচ্চিত্রে সর্বজনীনভাবে রূপায়ণে সফল হন তিনি। তাঁর বেশকিুছু চলচ্চিত্র বিভিন্ন দেশে পুনঃনির্মাণ হয়। এর মধ্যে বেশকিছু চলচ্চিত্র তার জীবদ্দশাতেই রিমেক হয়। ১৯৬০ সালে নির্মাতা জন ইলিয়ট স্টুজিস’ সেভেন সামুরাই অবলম্বনে রিমেক করেন ‘দি ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’। ‘মার্টিন রিট’ রশোমনের রিমেক করেন ‘দি আউটরেজ’ (১৯৬৪) নামে। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সের্গেই লিওন নির্মাণ করেন ‘দি ফিস্টফুল অব ডলার’ (১৯৬৪)। এটি কুরোশাওয়ার ‘ইয়োজিম্বো’ (১৯৬১) চলচ্চিত্রের পুনঃনির্মাণ। যদিও সের্গেই লিওন প্রথমদিকে অস্বীকার করেন কিন্তু পরবর্তীতে মামলা কোর্ট পর্যন্ত গড়ালে আকিরা কুরোসাওয়ার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে একটা উপসংহারে আসেন। সারাবিশ্ব থেকে সের্গেই লিওন এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যে পরিমাণ লভ্যাংশ অর্জন করেন, তার ১৫% তিনি আকিরা কুরোসাওয়ার সঙ্গে শেয়ার করেন। সম্প্রতি ‘কাগেমুশা’ চলচ্চিত্রের রিমেক করে দক্ষিণ কোরিয়া, মাসকারাদে নামের চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ২০১২ সালে।

(তথ্যসূত্র : শিল্প ও শিল্পী, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক জনকণ্ঠ, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট)


লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত