জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

শাইখ সিরাজ

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৩৩

১.
কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, কৃষকের পরম বন্ধু-কণ্ঠস্বর শাইখ সিরাজের আজ ৬৫তম জন্মদিন। তিনি ১৯৫৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন চাঁদপুরে। জন্মদিনে প্রিয় মানুষ সিরাজ ভাই, কৃষকের স্বজন শাইখ সিরাজকে জানাই অভিনন্দন, নিরন্তর শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন সিরাজ ভাই। (তবে বলে রাখা ভালো যে, আর আমাদের দশজনের মতোন আজ ৭ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রকৃত জন্মদিন হলেও সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ কিন্তু ২৮ জুন, ১৯৫৬। পারিবারিক কিংবা আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ সেপ্টেম্বরর জন্মদিন পালিত হয় বলেই জানি)। আমাদের একজন জনপ্রিয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। তিনি চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তাপ্রধান হিসেবেও সুপরিচিত। শুধু তা-ই নয়, তিনি একজন কৃষি উন্নয়নকর্মীও। শাইখ সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ভুগোলে। ছাত্রজীবনেই সম্পৃক্ত হন গণমাধ্যমের বিভিন্ন শাখায়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী গণমাধ্যমে কৃষি উন্নয়নকর্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে উন্নয়ন সাংবাদিকতায় পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘একুশে পদক’। কৃষিভিত্তিক একটি অনুষ্ঠানের একজন উপস্থাপক থেকে তিনি সারা বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত মুখ, একজন অতি সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। সমাজ পরিবর্তনের একজন গুরুত্বপূর্ণ রূপকার হয়ে উঠেছেন। আবারো প্রিয় সিরাজ ভাইকে জানাই তাঁর জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা। কামনা করি তাঁর সুস্থ ও আনন্দময় জীবন। প্রায় তিন যুগ আগে কৃষি সাংবাদিকতার মাধ্যমে উন্নয়ন সাংবাদিকতার যে পথটি তিনি দেখিয়েছিলেন, সে পথে আজও তিনি হেঁটে চলেছেন বিরামহীন, শ্রান্তি-ক্লান্তিহীন। তাঁর জন্মদিনে তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা, আপনি সুস্থ থাকুন, আগামী দিনগুলোতেও এ দেশের কৃষকের অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে একইভাবে কাজ করে যান, এই দেশের মাটি ও মানুষের জন্যে। 

২.
চ্যানেল আই-এর জন্মের কিছুটা আগে অর্থাৎ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-এর জমজমাটকালে আমি শাইখ সিরাজের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। দেখেছিলাম একজন স্বপ্নবান, সৃজনশীল মানুষকে। যিনি অবিরাম সৃষ্টিশীলতার নেশায় অক্লান্তভাবে ছুটে চলছেন। আমি তখন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-এর সার্বিক সহযোগিতায় শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘সোনালি দরোজা’ নির্মাণের কাজে পুরোপুরি যুক্ত ছিলাম। আর তাই সিদ্ধেশ্বরীর সেই আগের অফিসে প্রায় দেড় বছর প্রায় নিয়মিত কাছ থেকে দেখার, সময়ে অসময়ে জ্বালাতন করার সুযোগ পেয়েছিলাম শাইখ সিরাজ ভাইকে। আজ যদিও তিনি প্রায় সকলের কাছে স্যার হয়ে উঠলেও আমার কাছে সেই ভাই-ই রয়ে গেছেন। এখনও কোথাও দেখা হলে তিনি সস্নেহে আদর করেন, প্রীতিময় হাসি উপহার দেন। যদিও সেই সময়েও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-এর অনেকেই তাঁকে অনেকটাই ভয় পেতেন। আর এর কারণ বা রহস্য হচ্ছে তাঁর হাতের বেত। অবাধ্য সহকারির জন্য বেতটি বিশেষ সহযোগির ভূমিকা পালন করতো। অবশ্য ওই বেত নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা না থাকলেও অনেকবার সেটি নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে আমার নিরব দুষ্টুবুদ্ধি প্রবলভাবে সরব হয়ে উঠতো। সে সুযোগের কারণ রাতদিন প্রায় বিরামহীনভাবে সায়ীদ স্যারের সাথে আমাকে থাকতে হতো, জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ, সকল ধরনের কাজই করতে হতো। বিশেষত রাতভর অনুষ্ঠানের এডিটিং এর কাজে মোসাদ্দেক ভাইসহ অনেকের সাথেই অনিয়ন্ত্রিত সময় ক্ষেপনে ভীষণই পটু ছিলাম আমরা। ফলে দয়ালু সাগর ভাইয়ের উদারতার আকাশ মুক্ত থাকলেও শাইখ সিরাজ ভাইকেই এগিয়ে আসতে হতো অন্যদের জন্য এডিটিং প্যানেল ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। তখনও ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানটি শুরু করেননি। একান্তজনদের সাথে ভাবনার বীজ বপন চলছে।ফলে পুরোটা সময়ই তিনি দিতেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-এর কাজে। দিনের আলোয় যেমন, তেমনি রাতভর পরিশ্রমী শাইখ সিরাজের একান্ত সান্নিধ্য পেয়েছি অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবেই। যা এখন আর কেউ হয়ত কল্পনাও করতে পারে না, পারবেও না। আর কত যে বিচিত্র সব নানা পদের মুখরোচক খাবার উদরস্ত করেছি, খেয়েছি মন-প্রাণ ভরে তার হিসেব নিকেষ নেই। অবশ্য সেজন্য অধিক কৃতজ্ঞতা সায়ীদ স্যারেরই প্রাপ্য। আমাদের খাবারে বিল পরিশোধে ইমপ্রেসের বিক্রি হওয়ার আশংকার, আতঙ্কের কথা না-ই বা তুললাম। সাগর ভাই, সিরাজ ভাই স্যারের খাবারের বিলের ব্যাপারে কখনো প্রবল আপত্তি করেননি, আটকে দেননি, সে হোটেল সোনারগাঁও, শেরাটনই হোক আর তাঁদের খাবার দাবারের সুস্বাদু পিঠা পুলি খিচুরিই হোক। আমার জন্য সে এক আনন্দময় সময় ছিলো বটে! ব্যক্তিগত এসব বিষয় নিয়ে পরে আরো বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে।

৩.
আমার সেই প্রিয় শাইখ সিরাজ ভাই বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল ভবিষ্যৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অসামান্য অবদান রেখেছেন। আমার কাছে সিরাজ ভাই নিজে যেমন একজন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী মানুষ, তেমনি আবার সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এবং ভিশনারি। তিনি দেশের স্বার্থে কথা বলেন, মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি সকলের সম্মিলিত ভবিষ্যতের কথা ভাবেন বলেই হয়ে ওঠেন এদেশের কৃষকের পরম আপনজন, ‘আশ্রয়কেন্দ্র’। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান থেকে ফিরে আসার পর তিনি সেখানকার কৃষকদের তাঁর অনুষ্ঠান নিয়ে আগ্রহের কথা শুনে অনেকবারই আবার শুরু করার কথা বলেছিলেন-সেকথাও আজ মনে পড়ে।

৪.
বাংলাদেশেরই স্বশিক্ষিত কৃষি এবং পরিবেশ উন্নয়নকর্মী শাইখ সিরাজ। প্রায় তিন দশক ধরে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকদের বৈপ্লবিকভাবে তুলে এনেছেন গণমাধ্যমে। ক্ষেতের কৃষকের সঙ্গে গণমাধ্যমের যোগসূত্র নির্মাণে রেখেছেন অনবদ্য ভূমিকা যা প্রভাবিত করেছে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এবং বাংলার অগণিত প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকের মন। অবহেলিত কৃষককুল আর কৃষিকে তিনি নজরে এনেছেন নগরের মানুষের কাছে। উদ্দীপ্ত এই মানুষটি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন খামখেয়ালি প্রকৃতির সঙ্গে সদা যুদ্ধরত এবং সমাজ-রাষ্ট্রের চোখে অবহেলিত ও বঞ্চিত বাংলার কোটি প্রান্তিক কৃষক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। গণমাধ্যমই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অস্ত্র। যেখানে কৃষিপ্রযুক্তি এবং কৃষির ঐতিহ্যগত জ্ঞানের সম্মিলন কৃষকের দৃঢ়তা এবং সাফল্যের প্রধান নিয়ামক। আমাদের মাঝে অনেকেই বাস করেন যারা অসাধারণ উদ্যোগী মনোভাবের, আবার কেউ বা প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ ব্যবহারের নানা পথ দেখিয়ে চলেছেন। চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ তেমনি এক মাটির সন্তান, যিনি আবিষ্কার করেছেন জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার বিবিধ দিকনির্দেশনা। কৃষি আবাদের ইতিবাচক দিকগুলো শিখে কৃষক কীভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে প্রকৃতিরই অমূল্য দান, মাটির- তার এমন সব কর্মযজ্ঞ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। কৃষিক্ষেত্রে ‘কী হতে পারে’ আর ‘কী হতে পারে না’- এমন বার্তা তিনি ছড়িয়ে চলেছেন আর অনুপ্রাণিত করছেন অগণিত কৃষককে। কৃষকের নতুন কৃষি উদ্ভাবন গ্রামীণ এবং নগরের তথা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে জানান দেওয়ার নিরলস কাজটি করে চলেছেন শাইখ সিরাজ, যাতে দেশ আরও কল্যাণকর একটি ভবিষ্যতের দিশা পেতে পারে।

৫.
কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাগ্য পাল্টাবে, আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নতি লাভ করবে বাংলাদেশ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে দেশটির- একজন দক্ষ মাঠ-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাংবাদিক শাইখ সিরাজ বিশ্বাস করেন এভাবেই। আর তাই তো দেখি, কৃষি ও উন্নয়নমূলক টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও ইতিবাচক সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়ে শাইখ সিরাজ বাংলাদেশে উন্নয়ন সাংবাদিকতার যে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন; এর মাধ্যমে দেশের পল্লী উন্নয়ন, শ্রমজীবী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের মধ্য দিয়ে কৃষিপণ্যের জীবনকাল দীর্ঘস্থায়ীকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধকরণ ও গবেষণাধর্মী প্রচার-প্রচারণার কাজ করে চলেছেন। বিশেষ করে আগামীর খাদ্য চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কার্যকর দিক নির্দেশনা বের করে আনতে ইতোমধ্যে তিনি কৃষিখাতে উন্নত দেশ চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন সফর করে সেখানকার কৃষি প্রযুক্তি ও সাফল্যের বার্তা পৌছে দিয়েছেন বাংলাদেশের তৃণমূল কৃষক পর্যায়ে। মাটির সন্তান, শাইখ সিরাজ মিশে গেছেন বাংলার সবুজ প্রান্তরে, নদীনালায় আর আবাদি ক্ষেতে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই কঠিন সময়ের সঙ্গে লড়ে বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারবে খাদ্য নিরাপত্তা। তিনি বিশ্বাস করেন এই লক্ষ্যে তিনি পৌঁছবেন... পৌঁছবে বাংলাদেশ। কারণ তিনিই তো বাংলাদেশের ‘পরিবর্তনের রূপকার’। আমরা জানি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অনুকূল কৃষি-পরিবেশ, বৃহৎ কৃষি জনগোষ্ঠী এবং কৃষিপেশার অপার সম্ভাবনাময় দিকগুলো বলতে গেলে আঁধারে নিমজ্জিত ছিল। সে বিষয়ে নজর দিয়ে আশির দশকে বাংলাদেশের একমাত্র টেরিস্ট্রিয়াল টেলিভিশন, বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়ে আসেন কৃষিভিত্তিক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান, ‘মাটি ও মানুষ’। টেলিভিশন মিডিয়াকে সব সময়ই দেখা হয়েছে ‘বিনোদন-বাক্স’ হিসেবে। কিন্তু, সেই টেলিভিশনকেই ব্যবহার করেন উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে। আর তাই টেলিভিশনের চোখে আজ আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক টেকসই অর্থনীতি। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অর্থনীতি বাস্তবায়নে কাজ করে আসছেন তিনি। কৃষি উন্নয়ন সাংবাদিকতার গোড়াপত্তন নিয়ে তিনি বলছেন, ‘সত্তরের দশকে দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল। তখন মনে হয়েছে এ থেকে উত্তরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। তখন থেকেই উদ্যোগ নিই। শুরু হয় কৃষি উন্নয়ন সাংবাদিকতার গোড়াপত্তন। টিভির শক্তিকে কাজে লাগাই। তবে তখন কাজ করা সহজ ছিল না। কারিগরি সুবিধা ছিল না। ব্যয় ও কাজ করা ছিল কঠিন।’ কৃষি ও কৃষক নিয়ে কাজের শুরুর কথায় জানান, ‘তখন কৃষি বলতে শুধু ধান ও পাটকে বোঝাত। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে কাজ করি। কৃষির উপখাত বের করে আনি। পুকুরে মাছ চাষ। কৃষক বলতে শুধু গ্রামের কৃষকই নয়, শহরের যুবকও কৃষির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তিনি গ্রামে গরু, হাঁস, ছাগল, মাছ চাষ করতে পারেন। এমনকি বাড়ির ছাদেও বাগান করতে পারেন। পোলট্টি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এর মাধ্যমে শতভাগ যুবক যুক্ত হয়েছেন।’ 

৬.
কৃষিপ্রধান এ দেশের অবহেলিত, দারিদ্র্যক্লিষ্ট লাখো কৃষকের তিনি আপন আর আন্তারক কণ্ঠস্বর; কেউ তাঁকে হাতে তুলে বানায়নি, নিজ কর্মগুণেই হয়ে উঠেছেন তাঁদের মুখপাত্র। এ দেশের অর্থনীতির প্রধান উৎস কৃষি এবং দেশের অন্তত সত্তর শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষির ওপর এখনও নির্ভরশীল। অথচ কৃষিপ্রধান এ দেশের অর্থনীতির অবহেলিত খাতগুলোর মধ্যে কৃষি নিজেই একটি। সেই কৃষির প্রতি সবিশেষ নজর দিয়ে শাইখ সিরাজ আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, সত্যিকারের উন্নয়ন মানুষের উন্নয়ন, তাদের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন। অবকাঠামোগত পরিবর্তন এ কাজে সহায়তা করতে পারে মাত্র, সরাসরি কর্মসংস্থান করতে পারে না। তাই সত্যিকারের মানব কল্যাণের জন্য প্রয়োজন তাদেরকেই নিজ জীবনের চালকের আসনে অধিষ্ঠিতকরণ। শাইখ সিরাজ আরও দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কর্মসংস্থানের জন্য সনাতন পদ্ধতির ওপর সর্বদা নির্ভর করতে হয় না। বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের দ্বারে ধরনা দিতে হয় না। ‘জ্যাক’-এর মাধ্যমে কিংবা উৎকোচের বিনিময়ে সরকারি চাকরির আশায় জুতার তলা ক্ষয় করতে হয় না। এককথায়, চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে হয় না। ইচ্ছা করলে সাধারণ মানুষ নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থান করে জীবনযাত্রার মানের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে। একটি ‘সহায়ক পরিবেশ’পেলে তাদের এ প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হওয়া অবশ্য আরও সহজ হয়। বস্তুত শাইখ সিরাজের প্রচেষ্টায়, তার উৎসাহে এদেশের অসংখ্য মানুষ তাদের কর্মসংস্থান করতে পেরেছে। পেরেছে নিজের জীবনের হাল ধরতে, নিজ ভাগ্য গড়ার কারিগর হতে। যা ঘটেছে মূলত নিজেদের সময়, শ্রম, মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের যা কিছু আছে তা দিয়েই তারা আত্মকর্মসংস্থান করেছে। আত্মকর্মসংস্থানকারীরা শুধু হাঁস-গাছ-মাছই চাষ করছে না, তারা অনেক ব্যতিক্রমী পণ্যও উৎপাদন করছে। তারা উৎপাদনের অনেক নতুন ক্ষেত্রেও প্রবেশ করছে। অনেক নতুন প্রযুক্তির প্রচলন করছে। তারা উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে। নতুন নতুন পণ্য তারা দেশে-বিদেশে বাজারজাত করছে। 

৭.
টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রায় চার দশকের একনিষ্ঠ পথচলার মধ্য দিয়ে শাইখ সিরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন উন্নয়ন সাংবাদিকতার এক অগ্রপথিক হিসেবে। গণমাধ্যমে তার উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের কৃষিতে। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে বৈপ্লবিক সাফল্য। গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। দেশের অর্থনীতিতে কৃষির বহুমুখী অবদান সূচিত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বহু সাফল্যের দৃষ্টান্ত। কৃষি, গ্রাম ও মানব সম্পদ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা শাইখ সিরাজের উন্নয়ন সাংবাদিকতার প্রধান বিষয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও সূচিত হয়েছে ইতিবাচক এক পরিবর্তনের ধারা। বাংলাদেশ টেলিভিশন হয়ে বর্তমানে চ্যানেল আই-এর সূত্র ধরে শাইখ সিরাজ নিয়মিতভাবে সফল কৃষক ও কৃষি সাফল্য, ফলন বৈচিত্র্য, কৃষি ও কৃষকের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, বাজার ব্যবস্থার সঙ্কট নিরূপণ ও সমাধানের পথনির্দেশ, কৃষি উপকরণের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি, মাটির স্বাস্থ্য, জৈব কৃষি, পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপট, গ্রাম পর্যায়ে অবকাঠামো সঙ্কট, উচ্চ মূল্যের কৃষিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ, কৃষকদের সংগঠিত করা, উন্নত দেশগুলোর কৃষি সফলতা ও সেরা অনুশীলনগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের কৃষকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, বিভিন্ন দেশে বাঙালি কৃষি উদ্যোক্তাদের সাফল্য, দেশের কৃষিপণ্যগুলো রপ্তানির ক্ষেত্রে বাধাগুলো চিহ্নিত করা ও তা দূর করতে সরকারের নীতি পরিচালনা ও উদ্যোগগুলোর ওপর আলোকপাতসহ কৃষি-সংশ্লিষ্ট হেনো ইস্যু নেই যা নিয়ে তিনি অনুষ্ঠান করেননি। এর পাশাপাশি কৃষকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে তাদের অধিকার সচেতন করা ও রাষ্ট্রের নীতি পরিচালনার সঙ্গে তাদের বিষয়গুলো যুক্ত করার পেছনেও শাইখ সিরাজ অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। সংবাদে যেখানে কৃষিখাতই ছিলো উপেক্ষিত, সেখানে শাইখ সিরাজ কৃষককে দাঁড় করিয়েছেন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে; কৃষকের মুখ থেকেই তিনি তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করেছেন তাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর চ্যালেঞ্জের কথা। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এটি রীতিমত বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর মাধ্যমে একদিকে শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন কৃষক, কৃষি ও গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে আগ্রহ ও জানা-শোনা বাড়লো, অন্যদিকে গ্রামীণ জনপদে টেলিভিশন মিডিয়ার উপযোগ ও জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। শাইখ সিরাজ টেলিভিশনের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমের নগরকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতাকে ভেঙ্গে বিশাল পরিধিতে নিয়ে গেছেন। তার একের পর এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে টেলিভিশন আজ শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই সীমাবদ্ধ নেই, টেলিভিশন পরিণত হয়েছে সমাজ বদলের অন্যতম এক শক্তিতে।

৮.
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তার অমর টুয়েলফ্থ নাইট (Twelfth Night) নাটকে খ্যাতিমানদের সম্পর্কে বলেছেন, কেউ বিখ্যাত হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন, কেউ খ্যাতি অর্জন করেন, আবার কারও ওপর খ্যাতি আরোপ করা হয়। তবে এ তিনটি বিকল্পের মধ্যে নিঃসন্দেহে খ্যাতি অর্জনই সর্বাধিক আকর্ষণীয় ও সম্মানীয়। যুগে যুগে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন, তারাই হয়েছেন বরেণ্য ও স্মরণীয়। তারাই বড় অবদান রেখেছেন ইতিহাসে। কারও কারও ক্ষেত্রে এ সকল অবদান এসেছে নিজের ব্যক্তিগত সফলতা থেকে, যা সমষ্টির জন্যও কল্যাণ বয়ে এনেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে অবদানের প্রকৃতি হল অন্যের উপকার ও সমাজের অগ্রগতি। যার মাধ্যমে তারা সরাসরিভাবে অনেকের জীবন স্পর্শ করেছেন। কিংবা জাতির জন্য নতুন পথ রচনা করেছেন। এদের অবদানের ফলেই মানবসমাজ সামনে এগিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে। বস্তুত এ সকল ব্যক্তির অবদানের ইতিহাসই মানবজাতির ইতিহাস। আর তাই ড. বদিউল আলম মজুমদার সুন্দর করে লিখেছেন, শাইখ সিরাজ আমাদের সমাজের এমন এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব, যিনি উন্নয়ন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টিয়ে দিয়েছেন। যিনি সনাতন পদ্ধতির কর্মসংস্থানের পরিবর্তে আন্নোয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের ধারণার প্রচলন করেছেন। যার মাধ্যমে বাংলাদেশে তিনি উন্নয়ন সাংবাদিকতার নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন এবং এর পথিকৃতে পরিণত হয়েছেন। বস্তুত তিনি উন্নয়ন সাংবাদিকতা বিষয়কে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ফলে সঙ্গতভাবেই তিনি অভূতপূর্ব খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে এ খ্যাতির উৎস সরকারি ক্ষমতার আসন নয় বরং অসাধারণ একজন সামাজিক উদ্যোক্তা (social enterpreneur) হিসেবেই তার এ খ্যাতি। আর তাঁকে নিয়ে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ‘শাইখ সিরাজের নীরব বিপ্লব’ স্মৃতিচারণায় সুন্দর করে বলেছেন, ‘শাইখ সিরাজ ভাই আমাদের সামনে আছেন বলে অনেক সময়ই আমরা তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারি না। কিন্তু তাঁর কীর্তি এবং অবদান, তাঁর জীবন, তাঁর প্রচেষ্টা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এক নম্বর হলো সাধনা, ঐকান্তিকতা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, কবির সকলি আছে, একাগ্রতা নেই।আমাদের শাইখ ভাইয়ের একাগ্রতা আছে। সেটা খুব বড় কথা। ডেভিড শেংক নামের একজন লেখক আমেরিকায় একটা বই বের করেছেন—বহু গবেষণা করে। ‘দ্য জিনিয়াস ইন অল অব আস’। তিনি বলছেন, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আইনস্টাইন, পিকাসো, বেটোফেনের জিন আছে। আমরা সবাই জিনিয়াস। কিন্তু প্রকৃত জিনিয়াসরা একটা বিষয়ে এত মনোযোগ দেন, এত সাধনা করেন, এত একান্ত চেষ্টা করেন যে, তাঁর ওই জিনটা সক্রিয় হয়ে ওঠে। শাইখ সিরাজ ভাই কৃষি নিয়ে একান্তভাবে সাধনা করে গেলেন। ফলে কৃষি সাংবাদিকতায় তিনি হয়ে উঠলেন একজন মহিরুহ।’

৯.
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো শাইখ সিরাজ খাদ্যনিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচন বিষয়ে সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে অর্জন করেন জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এ এইচ বুর্মা অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন ব্রিটেনের বিসিএ গোল্ডেন জুবিলি অনার অ্যাওয়ার্ডস। ব্রিটিশ হাউজ অব কমেন্স তাকে প্রদান করেছে বিশেষ সম্মাননা। ব্রিটিশ-বাংলাদেশ ব্যবসায়ী সংগঠন দিয়েছে গ্রিন অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির স্বর্ণপদক, পেয়েছেন ডা: ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদকসহ অর্ধশত দেশী-বিদেশী পুরস্কার ও সম্মাননা। শাইখ সিরাজ চ্যানেল আই, বাংলাদেশ টেলিভিশনে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। দেশের কৃষি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গে দেশের পত্র-পত্রিকায় শাইখ সিরাজের রয়েছে সরব উপস্থিতি। দেশের বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত লেখেন তিনি। শাইখ সিরাজের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : মৎস্য ম্যানুয়েল, মাটি ও মানুষের চাষবাস, ফার্মার্স ফাইল, মাটির কাছে মানুষের কাছে, বাংলাদেশের কৃষি : প্রোপট ২০০৮, কৃষি ও গণমাধ্যম, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (সম্পাদিত), আমার স্বপ্নের কৃষি, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট (২০১১), সমকালীন কৃষি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১১), কৃষি ও উন্নয়নচিন্তা (২০১৩) ইত্যাদি।


লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত