জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
ভূপেন হাজারিকা
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৫৯
১.
‘মানুষ মানুষের জন্যে’ কিংবা ‘মানুষ যদি না হয় মানুষ দানব কখনো হয় না মানুষ। সাম্প্রতিক এই মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে, সভ্যতার চরম সংকটকালে বারবার যার গান, কণ্ঠস্বর গোপনে কিংবা একান্তক্ষণে মনে ভেসে আসে তিনিই ভূপেন, ভূপেন হাজারিকা। গানের যাযাবর কোকিল ভূপেন হাজারিকা, সংগীতের ভুবনের এক কিংবদন্তির নাম ভূপেন হাজারিকা । তিনি ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই সংগীতশিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, কিডনি বৈকল্যসহ বার্ধক্যজনিত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কিংবদন্তি গায়ক এবং সুরকার ভূপেন হাজারিকা ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর মারা যান। তিনি ছিলেন মানুষ মানুষের জন্য, বিস্তীর্ণ দুপারে, আমি এক যাযাবর, সাগর সঙ্গমেসহ আরো অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা। গায়ক, সুরকার ও কবি, এরকম অনেক গুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি। আবার করেছেন রাজনীতিও। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মানবতাবাদী। আর মানবতাবাদীদের কাছে তাঁর গান আজও মহান স্লোগান। যদিও শেষ জীবনে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপিতে যোগদান করেন ভূপেন হাজারিকা। এর ফলে রাজনীতির মাঠে অবশ্য খানিকটা বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ অবদানের কথা বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
২.
বিজেপি রাজনীতিজনিত সমালোচনা সত্ত্বেও ভূপেন হাজারিকা একজন মানবদরদি শিল্পী হিসেবে অমর হয়ে আছেন তার ভক্তদের হৃদয়ে। মানবতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বার্তাবাহক তাঁর গান বাংলা ও হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে। অসমের গণ্ডি পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় তাঁর গান। ভারতীয় সিনেমায় অসম ও উত্তর-পূর্বের লোকগীতি ও সংস্কৃতির পরিচয় ঘটানোয় তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৯৮-২০০৩ পর্যন্ত সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি’র চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের পরই সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হিসাবে মনোনীত হয় তাঁর গান ‘মানুষ মানুষের জন্য’। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি সিনেমায় গান গেয়েছিলেন ও ১৩ বছর বয়সে তাঁর লেখা প্রথম গান— অগ্নিযুগের ফিরিঙ্গতি। সেরা সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে জাতীয় পুরস্কারসহ পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের মতো নানা সম্মাননা।
৩.
‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ,/ জয় জয় মুক্তিবাহিনী / ভারতীয় সৈন্যের সাথে রচিলে / মৈত্রীর কাহিনী।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে এই গানটি গেয়েছিলেন মানবতার কণ্ঠস্বর ভূপেন হাজারিকা। বাংলা ও বাংলাদেশের প্রতি অসম্ভব ভালবাসা ছিল তার। আনন্দবাজার পত্রিকায় এক মন্তব্যে বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের পরই সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হিসাবে মনোনীত হয় ভূপেন হাজারিকার গান ‘মানুষ মানুষের জন্য’। বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি তাঁর যে টান এ টান নাড়ীর না হলেও প্রাণের। বাংলাদেশে সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ভূপেন হাজারিকা তাঁর ‘আমি এক যাযাবর ’গ্রন্থে বলেছেন: ‘কিছুদিন আগে ঢাকার একটা কাগজে আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সাক্ষাৎকারের হেডিং ছিল, ‘বঙ্গ সংস্কৃতির স্ফূরণ’–আমি ঢাকায় দেখেছি। কোনো দ্বিমতই নেই–বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক বেশি পরীক্ষা-নীরিক্ষা ঢাকায় আমার চোখে পড়েছে। আমি তো ভেবেছিলাম, বিগত আন্দোলনের পর অসমে অসমীয়া সাহিত্যের স্ফূরণ হবে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। কোলকাতার চোখে পড়েছে গোষ্ঠীচক্র, অহঙ্কার আর শভিনিজম। একসময় বঙ্গ-সংস্কৃতির জন্য সারা পৃথিবী যেমন কোলকাতার দিকে তাকিয়ে থাকত, আজ ঠিক সেইভাবে তাকিয়ে থাকে ঢাকার দিকে। প্রমাণিত হয়ে গেছে, বঙ্গ সংস্কৃতির গভীরতা কোলকাতার চেয়ে ঢাকায় অনেক বেশি।’ আসামে জন্ম নিয়ে তাঁর এই বাংলাপ্রীতি আমাদের অনেককে অবাক করে, শেখায়ও তার চেয়ে বেশি কিছু। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত প্রসাদ পত্রিকার জুলাই ১৯৮৭ সংখ্যায় প্রকাশিত কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৯)-এর একটি লেখা থেকে থেকে কিছুটা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন বাংলায় বসবাস করার ফলে বাংলার প্রতি ওর মমত্ববোধ স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু অসমের প্রতি বিশেষতঃ সেখানকার মানুষদের প্রতি ওর আকর্ষণ কোনোদিন তো কমেনি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তবে আমার মতে, ভূপেনের কোনো সীমারেখা নেই। সে আজ শুধু বাংলা বা শুধু অসমের, এমনকি সারা ভারতবর্ষেরও না, সারা পৃথিবীর।’
৪.
একজন স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী ও ভারতীয় সংগীত জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ভূপেন হাজারিকা। অত্যন্ত দরাজ গলার অধিকারী এই কণ্ঠশিল্পীর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। অসমিয়া চলচ্চিত্রে সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে ভারত এবং বাংলাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ভূপেন হাজারিকা নিজেকে তিনি ‘যাযাবর` ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাভাষীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা প্রবাদতুল্য। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কারিগর এই শিল্পীর দরাজ কণ্ঠে গাওয়া গানগুলো সব প্রজন্মের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। ড. ভূপেন হাজারিকা তার ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর ও কোমল ভঙ্গির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ভূপেন হাজারিকা উপমহাদেশের সঙ্গীতভুবনে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি কারণ তাঁর ছিলো এক. শীলন সমৃদ্ধ কণ্ঠশৈলী, দুই. গানের বাণী, তিন. গানে সুর ও চার. অসামান্য সুন্দর উচ্চারণ। তার রচিত গানগুলো ছিল কাব্যময়। গানের উপমাগুলো তিনি প্রণয়-সংক্রান্ত, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় থেকে তুলে আনতেন। গান যে শুধু শোনারই জিনিস নয়, উপলব্ধির ও বোঝার উপকরন-এটা বুঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন ভূপেন হাজারিকা। তার কিছু সৃষ্টি অবিস্মরণীয়। গভীর মন্দ্রস্বর ও কেতাদুরস্ত শব্দচয়ন এর জন্য তিনি পৃথিবী বিখ্যাত। তিনি আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে লোকসংগীত গাইতেন। তাঁর গাওয়া ‘আমি এক যাযাবর’ অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনায় নজরুল’, ‘সহস্র জনে মোরে প্রশ্ন করে মোর প্রেয়সীর নাম’, ‘মাইয়া ভুল বুঝিস নাই’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’–গানগুলি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য গানগুলো হচ্ছে—আজ জীবন খুঁজে পাবি, ও মালিক সারা জীবন, গঙ্গা আমার মা, প্রতিধ্বনি শুনি, বিস্তীর্ণ দুপারে, মানুষ মানুষের জন্যে, সাগর সঙ্গমে, হে দোলা হে দোলা, চোখ ছলছল করে।
৫.
কিংবদন্তি গায়ক এবং সুরকার ভূপেন হাজারিকা ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামে জন্মেছিলেন। অবিভক্ত ভারতে যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে তখন অরুণাচল ও অসমের সীমান্তবর্তী অঞ্চল আসামের সদিয়ায় ভূপেন হাজারিকার (জন্মঃ ৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ - মৃত্যুঃ ৫ নভেম্বর ২০১১) জন্ম। সেখানকার শিবসাগর স্কুলে ঠাকুর্দা বংশীধর হাজারিকার ছেলে বাবা নীলকান্ত হাজারিকা শিক্ষক ছিলেন। মা শান্তিপ্রিয়া দেবী সুগৃহিনী ছিলেন। বাবার সরকারী চাকুরী হওয়ায় দু‘বছর অসমের ধুবড়ী, দুবছর গুয়াহাটি এবং চার বছর তেজপুরে ভূপেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন।পিতা-মাতার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের বড়। ব্যক্তিগত জীবনে ভূপেন হাজারিকা কানাডায় বসবাসরত প্রিয়ংবদা প্যাটেলকে বিয়ে করেছিলেন। তাদের একমাত্র সন্তান তেজ হাজারিকা । তবে চিরবিদায়ের সময় তাঁর পাশে ছিলেন ঘনিষ্ঠজন ৩৯ বছরের সঙ্গীত চলচ্চিত্রকার কল্পনা লাজমি।
৬.
অসমিয়া, হিন্দি ও বাংলা ভাষার এক গানের পাখি ভূপেন হাজারিকা ১৯৪২ সালে গুয়াহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট আর্টস, কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বিএ এবং ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। ১৯৫২ সালে নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষায় শ্রবণ-দর্শন পদ্ধতি ব্যবহার করে ভারতের মৌলিক শিক্ষাপদ্ধতি প্রস্তুতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব”।
৭.
এই শিল্পীই মানুষ ও মানবতার কথা বলার জন্য জেল খেটেছেন; কিন্তু পিছপা হননি। গেয়েছিলেন শতাব্দীর অবিস্মরণীয় কালজয়ী সেই গান- 'মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না।' মানুষের প্রতি কতখানি গভীর দরদ থাকলে একজন শিল্পী এমন গান গাইতে পারেন! কেবল তা-ই নয়, সব গানেই আমজনতার কথা তুলে ধরার জন্য তার গানের মধ্যে জনগণ বারবার নিজেদের খুঁজে পেত। হিন্দু ধর্মের তীর্থ পবিত্র নদী গঙ্গার কাছে তিনি ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন, প্রশ্ন রেখেছিলেন গানের ভাষায়, 'বিস্তীর্ণ দু-পাড়ে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে-নীরবে ও গঙ্গা তুমি ও গঙ্গা বইছো কেন।' মানুষ আর জীবনের শিল্পী স্পস্ট প্রশ্ন রেখেছেন, দুই পাড়ের অসংখ্য নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের কষ্টের জীবনযাত্রা দেখেও কেন গঙ্গার প্রতিক্রিয়া হয় না, কেন সে শুধুই বয়ে চলে? এই বিশ্বায়নের যুগে, যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে সহানুভূতি হারিয়ে প্রায় যন্ত্র হয়ে ওঠা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেনথ 'মানুষ মানুষের জন্য' গানটি গেয়ে। কেমন অসাম্প্রদায়িক গণচেতনার শিল্পী হলে গাইতে পারেনথ 'গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা, ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা, মেঘনা যমুনা।' শুধু তাই নয়, নিপীড়িত মানুষের সপক্ষে তিনি শরৎ বাবুকে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন তার মহেশ, গফুর কোথায় কেমন আছে।
৮.
এই কিংবদন্তি গণসংগীতশিল্পী কৈশোরকাল থেকেই গান লেখা, সুর করা এবং একই সঙ্গে গাইতে শুরু করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি অসমিয়া ছবি ইন্দ্রমালতিতে গান করেন। অসমিয়া ভাষা ছাড়াও তিনি বাংলা-হিন্দিসহ ভারতের বেশ ক'টি ভাষায় গান করেছেন। সব ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তবে বাংলা ও হিন্দি ভাষাতেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান। খ্যাতি পান লেখক হিসেবেও। সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে গণযোগাযোগে পিএইচডি লাভ করা এ গণমানুষের শিল্পী এক জীবনে বহুবিধ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রযোজক-পরিচালক হয়েছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, অভিনয় করেছেন।
৯.
সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে লেখা গানগুলো তাকে গীতিকার হিসেবে বেশি জনপ্রিয় করে। এ ক্ষেত্রে গণসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হবিগঞ্জের কৃতী সন্তান হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সান্নিধ্য ও উৎসাহ তাকে অনুপ্রাণিত করে। তারই উৎসাহে ভূপেন হাজারিকা ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগদান করেন। অসমীয় বিলু ভাটিয়ালীর সুর গণজাগরণের গানে সার্থক প্রয়োগ করে তিনি হয়ে ওঠেন অসাধারণ এবং জনপ্রিয়। নিজ গুণে এ অসমীয় শিল্পী দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক জগতের অগ্রদূত হয়ে উঠেছিলেন।কারণ তাঁর কণ্ঠ ছিল দরাজ, সুমিষ্ট এবং সুরেলা গানের বাণী ছিল আধুনিক। গায়কীর শব্দ চয়ন ছিল নান্দনিকতায় ভরা।
১০.
ভূপেন হাজারিকা চার বছর ছিলেন বেনারসে। অনেক আঞ্চলিক সংস্কারকে কাটিয়ে বিশ্বাঙ্গনে প্রবেশ করতে লাগলেন। ১৯৪৯-এ সেপ্টেম্বরে আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবেন। সেখানে ভারতীয় ছাত্রদের সাথে দেখা। হঠাৎ একদিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৯৬১-১৯৪১) একান্ত সচিব অমিয় চক্রবর্তীর (১৯০১—১৯৮৬) সাথে দেখা আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে। তিনি হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। ভূপেনের গবেষণার বিষয় ঠিক করতে অমিয় চক্রবর্তীর দান অপরিসীম। এখানেই তাঁর সঙ্গীত জীবনের ভাবগুরু পল রবসন (১৮৯৯-১৯৭৬) সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে শুরু করেন তিনি। আত্মজীবনীতে ভূপেন হাজারিকা লিখেছেন, ‘একদিন হাঠাৎ শুনলাম, পল রবসন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। সম্প্রতি তাঁকে নিগৃহীত করা হয়েছে। প্রায় সম্পূর্ণ আমেরিকাই তাঁকে বয়কট করেছে। হলিউড থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। স্টেজেও তাঁকে বয়কট করেছে। কোথাও তাঁকে গান করতে দেয়া হবে না। রেকর্ডিং কোম্পানীগুলি তাঁর গান রেকর্ড করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোলকাতায় যেমন পাড়ার ছেলেরা স্বরবতী পূজো করে সেইভাবে মঞ্চ করা হয়েছে। আমরা সবাই বসে আছি একেবারে রাস্তায়। এ কথা আজ অনস্বীকার্য যে, পল বরসনের প্রভাব আমার জীবনে বিশেষভাবে পড়েছে। আমেরিকার যত নামকরা কাগজ আছে তার ছেঁড়া কাগজের ফালি দিয়ে সামনে একটা স্কীনবোর্ড তৈরি করা হয়েছে। পল ছ’ফুটের বেশি লম্বা। কোনো গ্রীনরুম নেই। নির্ধারিত সময়ে এলেন তিনি। পুরো কালো নয়। চকোলেট ব্রাউন গায়ের রং।… সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম উদাত্ত কণ্ঠের আহবান, ‘ওল ম্যান রিভার, ইউ ডোন্ট নাথিন্ । ইউ জাস্ট কিপ রোলিং রোলিং।’ লোকগীতি। তিনটে অন্তরা আছে।… সঙ্গে শুধু একটা গীটার রয়েছে। খুব যে একটা ব্যাকরণ মেনে গান করেন তাও নয়। মনে পড়ে গেলে, ক্লাস সিক্স এ পড়ার সময় প্রথম যখন গান করি তখন আমিও তো দাঁড়িয়ে গান করেছি। অসাধারণ লাগলো পল রবসনের সঙ্গীত পরিবেশনা রীতি। আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। বললাম, আমি কিন্তু মাঝে মাঝে আপনাকে এসে বিরক্ত করবো। বললেন, নিশ্চয়ই আসবেন। ওখান থেকে ফিরে এসে বন্ধুদের বললাম, সার্থক হয়ে গেল আমেরিকা দর্শন।’
১১.
সংগীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকার একসময় এই উপমহাদেশের কিংবদন্তী সংগীতকার ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। লতা যেমন ছিলেন ভূপেনের প্রেমে পাগল তেমনি ভূপেনও। এই প্রেমের কথা ভূপেন হাজারিকা তার আত্মজীবনী ‘আমি এক যাযাবর’ বইয়ে লিখেও গেছেন। মুম্বইর এক নাম করা গায়িকার সঙ্গে তার প্রেমের (বিশেষ সম্পর্ক) কথা ভূপেন হাজারিকা লিখে গেলেও কোথাও অবশ্য নামটি প্রকাশ করেননি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে সেই নামটিই প্রকাশ্যে এনেছেন ভূপেন হাজারিকার কানাডা প্রবাসী সাবেক স্ত্রী প্রিয়ংবদা প্যাটেল। ভূপেন হাজারিকার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে যোগ দিতে তিনি আসামে এসেছিলেন। সেই সময় তিনি একটি অসমীয়া টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তার ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবন ভেঙে গিয়েছিল লতা মঙ্গেশকারের জন্যই। তিনি শুনিয়েছেন কিভাবে লতা ও ভূপেন প্রেমে পাগল হয়ে উঠেছিল। প্রিয়ংবদা জানিয়েছেন, কলকাতার টালিগঞ্জে ভূপেন হাজারিকার ফ্ল্যাটে প্রায়ই ছুটে চলে আসতেন লতা মঙ্গেশকার ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে দেখা করবেন বলে। প্রিয়ংবদা জানিয়েছেন, রাতের পর রাত লতা ও ভূপেন দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে কাটিয়েছেন। আর স্ত্রী হিসেবে তিনি দরজার বাইরে অপেক্ষা করেছেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘কেতিয়াবা করিব লাগে’ (অমন একটু আধটু করতেই হয়)। প্রিয়ংবদা একদিনের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, একবার বিখ্যাত সুরকার জুটি কল্যাণজি-আনন্দজিকে সঙ্গে নিয়ে লতা মঙ্গেশকার কলকাতায় এসেছিলেন ভুপেনদার ফ্ল্যাটে। সেই সময় গভীর রাত পর্যন্ত ভূপেন ও লতার ঘরের বাইরে বসে থাকতে দেখে কল্যাণজি তাকে বলেছিলেন, বহেনজি তুমি ঘুমোতে যাও। উনি আজ বাইরে আসবেন না। আরেকবার দমদম বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে লতা মঙ্গেশকার নাকি প্রিয়ংবদার সামনেই ভূপেনকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার স্ত্রীর চেয়েও তোমাকে বেশি ভালবাসি। সেই কথা শুনে প্রিয়ম্বদা কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। প্রিয়ংবদার সঙ্গে ভুপেনের পরিচয় হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। ভুপেন তখন পিএইচডি করতে সেখানে ছিলেন। প্রিয়ংবদা নিজেই আলাপ করেছিলেন। তারপর প্রেম এবং বিয়ে। কিন্তু ১৩ বছরের মাথায় লতা ও ভূপেনের প্রেম দেখতে দেখতে অসহ্য হয়ে যাওয়ায় ভুপেনকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন প্রিয়ংবদা। এই সাক্ষাৎকার প্রচার হওয়ার পর চারদিকে প্রবল শোরগোল পড়ে গিয়েছে। অবশ্য ভূপেন হাজারিকার শেষ জীবনের সঙ্গী কল্পনা লাজমিও এই সাক্ষাৎকার নিয়ে খুবই বিরক্ত। আর লতা এই সাক্ষাৎকারের খবর জেনে বেশ ক্ষুব্ধ। লতা জানিয়েছেন, আমি প্রচণ্ড আহত। এই বয়সে এমন একটা কথা শুনতে হবে আমি তা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। তিনি আরও বলেছেন, এই ঘটনার ফলে ভূপেনদার মতো মানুষকেই অপমান করা হয়েছে।
১২.
গায়ক হিসেবে অবশ্যই তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ পরিবেশক ছিলেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনে পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে, বেস্ট রিজিওনাল ফিল্ম, সঙ্গীত, নাটক, একাডেমী পুরস্কারের পাশাপাশি অনেক আঞ্চলিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। আর আসামের এই কৃতী সন্তানকে ২০০৯ সালে ‘অসম রত্ন’ অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়। ওই বছরেই আসামের প্রধান শহর গৌহাটির কেন্দ্রস্থলে তার ভাস্কর্য বসানো হয়। ফাইবার গ্লাস ও অন্যান্য পদার্থ সহযোগে চমকপ্রদ `ড. ভূপেন হাজারিকা ভাস্কর্য` তৈরি করেন আসামের ভাস্কর্যশিল্পী বিরেন সিংহ। ভাস্কর্যের আনুষ্ঠানিক পর্দা উন্মোচন নিজেই করেছিলেন। এই কিংবদন্তি গায়ক, কবি এবং সুরকারকে তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যই তাঁকে চিরস্মরণীয় রাখবে। ভূপেন হাজারিকা তার সৃষ্টিশীল কর্মের জন্য যুগের পর যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষি জনমানসে তিনি অমর হয়েই থাকবেন।
১৩.
ভূপেন হাজারিকার গানের বাণী আমার মতোন অনেককেই ভীষণভাবে আবেগি করে, টানে। তেমনি একটি গানের অমর বাণী পাঠ করে তাঁর প্রতি আবারো শ্রদ্ধা জানাই।
১৩.২
সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ - চেতনাতে নজরুল
যতই আসুক বিঘ্ন বিপদ- হাওয়া হোক প্রতিকুল
এক হাতে বাজে অগ্নিবীণা - কণ্ঠে গীতাঞ্জলি
হাজার সূর্য চোখের তারায় - আমরা যে পথ চলি।।
সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ - চেতনায় নজরুল
এই সেই দেশ, একদা যেখানে -উপনিষদের বিশি
সমতার গান গেয়েছিল আর শুনেছিল দশ দিশি
প্রক্রিতাময়ীর ভাষাতেই আজো আমরা যে কথা বলি
হাজার সূর্য চোখের তারায় - আমরা যে পথ চলি।।
সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ - চেতনায় নজরুল~
এই সেই দেশ - এখনো এখানে উঠে আজানের ধ্বনি
গীতা বাইবেল ত্রিপিটক আর শুনা যায়-রামায়নি
কবি কালীদাস ,ইকবাল আর গালীবের পদাবলি
হাজার সূর্য চোখের তারায় - আমরা যে পথ চলি।।
সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ - চেতনায় নজরুল
(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক যুগান্তর, ইন্টারনেট)
লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা