প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

‘উত্তরদা’ এটিএম আব্দুল হাই

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৩৮

১.
আমাদের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় স্টুডিও প্রতিবেদনের পথিকৃৎ (স্টুডিওর সদরে অন্দরে) ব্যক্তিত্ব হিসেবে আলোচিত, জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’র ‘উত্তরদা’র আড়ালে থাকা সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির আলোকিত নিরব সাধকের নাম এ,টি,এম, আব্দুল হাই। ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৬৮ বছর বয়সে চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গণ এবং অসংখ্য অনুরাগীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে প্রিয় মানুষ হাই ভাই চিরতরে চলে যান না ফেরার দেশে, অচেনালোকে। প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় হাই ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার পরম প্রশান্তি প্রত্যাশা করি। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৩ সালের ৩ ডিসেম্বর জনপ্রিয় উত্তরদা ওরফে এ,টি,এম, আব্দুল হাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রুশ সংস্কৃতি কেন্দ্রে কাজ করেছেন। দৈনিক ভোরের কাগজসহ দৈনিক প্রথম আলো-র উপসম্পাদক হিসাবে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন আমৃত্যু। তিনি নানা স্বাদের, রকমের উপ সম্পাদকীয় লিখতেন, সম্পাদনা করতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মতোই তাঁর রচনার ভাষা ও মান ছিলো উন্নত, চিত্তাকর্ষক। তিনি এতটাই প্রচার বিমুখ ভাল মানুষ ছিলেন যে, নিজের নামটি প্রচারিত হোক- এমন কিছু কখনোই চাইতেন না, করেনও নাই সে রকম কোন অতিরঞ্জণ। তবে বিনীতভাবে কষ্টের কথাটিও বলতে চাই। দৈনিক প্রথম আলোতে হাই ভাইয়ের জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করতে ভুলে যাওয়াটা বড়ই বেদনার। প্রিয়জন গিয়াস (Gias Ahmed) ভাই যখন দৈনিক প্রথম আলোর বন্ধুসভার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন, তখন বন্ধুসভার পুরো একটি পাতাই হাই ভাইকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেই বিশেষ আয়োজনের পুরোটাই ছিল হাই ভাইকে নিয়ে লেখা, স্মৃতিচারণ, শ্রদ্ধা নিবেদন। এখন প্রথম আলো সব ভুলেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে গিয়াসভাইসহ আমরা অনেকেই তাঁকে ভুলিনি। প্রিয় হাই ভাই আছেন আমাদের হৃদয়ে, শ্রদ্ধার আসনে।

২.
প্রায় শুভ্রকেশী হাই ভাইয়ের কথা মনে পড়লেই স্মৃতির পুকুরে ভাসে পদ্মফুল, খেলা করে শ্বেতহংস দল, সাদা মনের অসাধারণ মানুষের ছবি ভেসে ওঠে মনের আকাশে। অসম্ভব বিনয়ী, মৃদুভাষী, সদা মিষ্টহাসী হাই ভাই ছিলেন আমাদের তৎকালীন ভোরের কাগজ পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় মুখ, সকলের আপন মানুষ। আমি গর্বের সাথে স্বীকার করে থাকি, আমি হাই ভাইয়ের সহকর্মী ছিলাম। বয়সে আমি তাঁর অনেক ছোট হলেও, ব্যবধান অনেক হলেও তাঁর আন্তরিক ও একান্ত পরম সাহচার্য পেয়েছি। পেয়েছি অকৃত্রিম, অপার স্নেহ। অসাধারণ ছিল তাঁর অন্তঃকরণ, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।সদালাপী ও বিনয়ী হাই ভাই ছিলেন আমাদের আদর্শপুরুষ। সম্পাদক মতি ( মতিউর রহমান) ভাই পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করতেন। ফলে আপন গুণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভোরের কাগজ পরিবারের মুরুব্বী। বাংলা মোটরের তৎকালীন ভবনের চারতলায় বসতেন তিনিসহ আমাদের আরো প্রিয়জনেরা। ফলে তিনতলার বার্তা বিভাগের কাজ সেরেই চলে আসতাম চারতলায়। সম্পাদক মতিভাইয়ের ‘কাঁচের দেয়াল’ঘর সত্ত্বেও চারতলার প্রতি প্রবল টান যেন প্রেমের টান, ‘আকুল শরীর মোর, বে-আকুল মন’। সেখানে নবীন-নবীনাদের ‘মেলা’য়, মহাসমাবেশে রসে-বশে জমিয়ে রাখতেন সঞ্জীবদা, আরেকপাশে ‘গ্রামবাংলা’র ফুল ফোটাতেন লতিফ ভাই, রমেন দা, অন্যদিকে আপন আপন বিভাগ নিয়ে ব্যস্ততায় বিভোর থাকতেন গিয়াস ভাই, তাপসদাসহ আরো অনেকেই। এসবেরই মাঝে হাই ভাই একনিষ্ঠ মনে কাজ করে যেতেন, লিখতেন, পড়তেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে কাজের সেই সময়গুলোতে কতকিছু যে শিখেছি তাঁর কাছ থেকে, তাদের সকলের কাছে, সেই হিসেব বেহিসেবী এবং গোপনই থাক না হয়। খুব দারুণ একটা অনিন্দ্য সুন্দর সময় পার করেছিলাম আমরা তখন। কোন এক ‘অলৌকিক জলযানে’ চড়ে, জীবনানন্দে সময় পরিভ্রমণকাল ছিলো আমাদের। সেই সোনালি সময়ে আমাদের বড় প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আমাদের ‘নাবালক’ সুলভ নানা অত্যাচার নিরবে সহ্য করে, সদা হাস্যমুখ মানুষটি মায়ামোহ সৃষ্টি করে সম্প্রীতির বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছিলেন সবাইকে। ভোরের কাগজ ভবন ভরে উঠেছিলো ভালোবাসার আলোয় উদ্ভাসিত উজ্জ্বল কোন প্রাঙ্গণ। আহারে, আমাদের প্রীতির রঙধসু সূতোয় জড়ানো সেই দিনগুলিকে যদি সময়ের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে পারতাম!

৩.
১৯৯২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে ভর্তি হয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি সায়ীদ স্যারের (অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) পিএস-এর চাকুরি ছেড়ে দেবার পায়তারা করছিলাম। সে সময়ই সুযোগ পেলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিকের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার। সে সুযোগটিই কাজে লাগালাম। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষে এরপর প্রতিবেদক এবং সাব-এডিটর হিসেবে (১৯৯৩-১৯৯৮) কাজ করার সুযোগ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই কিভাবে যেন (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কারণে !) হাই ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তৎকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক পত্রিকা ভোরের কাগজ পরিবারের সদস্য হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর কাজ করার সুবাদে তাঁর মতোন আরো অনেকের কাছেই শিখেছি কতকিছু। শুধু সাংবাদিকতা নয়, মানবিক আচরণ, সুরুচির বিকাশে, সুস্থ সাংস্কৃতিক বোধের জাগরণে তিনি রেখেছিলেন সবিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। আচার-আচরণ, ব্যবহার ছিল তাঁর অমায়িক, অনুকরণযোগ্য। কথা বলতে গেলে কখনো বিরক্ত হননি, হতে দেখিনি। খাওয়াতে ভালোবাসতেন, তাঁর কাছে গেলে কিছু না কিছু খাবার জন্য বলেছেন, খাইয়েছেনও।
 
৪.
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বেশ কয়েকবার আক্রান্ত হই, শারীরিক লান্থনার শিকার হতে হয় আমাকে। ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসীদের দ্বারা আমাদের কামালউদ্দিন হল দখল হলে প্রথমেই নির্যাতনের শিকার হই আমরা সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। হাই ভাই আমার আক্রান্তের খবর জেনেই মতিভাইকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করতেন বলে পরে জানতে পারি মতি ভাইয়ের কাছেই, ‘কি মোহন মিয়া, হাই ভাইরেও কী জাদু করল্যা যে সবার আগে তোমার উদ্ধারের খবর জানতে চায়?’ মতি ভাই জানতেন আমি বিশ্ববরেণ্য জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের জাদুদলের সদস্য ছিলাম, তাই জাদুর রহস্য বুঝি আমি সবই জানি এবং প্রয়োজনে প্রয়োগও করি ! মনে পড়ে, গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে এমনতর লান্থনার ক্ষেত্র থেকে উদ্ধার পেয়ে ক্যাম্পাস থেকে ভোরের কাগজ ভবনে এসে আগে দেখা করতে হতো হাই ভাইয়ের সাথে, খাবারও খেতে হতো তাঁর সাথে। তাছাড়াও অসংখ্যবার তাঁর খাবারে ভাগ বসিয়েছি, সেসব স্মৃতি ভুলি কী করে? সেসময়গুলি উদরপুর্তির ছিলো না, ছিলো অকৃত্রিম ভালোবাসায় পূর্ণ, স্নেহাশীষের আলোয় পরিপূর্ণ। তাঁর সেই অকৃত্রিম পিতৃস্নেহ আমি কখনই অস্বীকার করতে যেমন পারি না, তেমনই কী করেই বা ভুলি?

৫.
আমারই জন্মস্থানে, নগরবাড়ী ঘাটের যমুনার অতল জলে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, বরেণ্য শিল্প স্রষ্টা আলমগীর কবিরের মর্মান্তিক প্রয়াণ ব্যথা অনুভব করতে দেখেছি তাঁকে। আমাকে দেখলেই নাকি তাঁর আলমগীর কবিরের কথা মনে হতো বলে কয়েকবারই স্বীকার করেছেন। বলেছিলেন যাবেন আমার সাথে সেখানে, গড়ে তুলবেন স্মৃতিস্তম্ভ, স্মরণ ভাস্কর্য। কিন্তু নদী ভাঙ্গনের কারণেই সেই স্বপ্নটা আর বাস্তবায়ন করা হয়ে ওঠেনি আমাদের। আজো আমি বাড়ি গেলে, নগরবাড়ী ঘাটে গেলে আলমগীর কবিরের পাশাপাশি হাই ভাইয়ের মুখখানিও মনের মধ্যে দেখতে পাই। প্রবলভাবে অনুভব করি তাঁর শিল্পচৈতন্য, চলচ্চিত্রের আলোয় কুরুচির অন্ধকার দূর করার অসীম আশাবাদী উচ্চারণগুলো। অমর চলচ্চিত্র স্রষ্টা ঋত্বিক ঘটকের পিতৃভূমিও যে আমার জন্মস্থানেই, সেটাও তিনিই বোধকরি আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন।

৬.
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে আমার সম্পর্কের গভীরতার কারণে নানা রকম বইয়ের খবরাখবর নিতেন, প্রয়োজনীয় বই কিংবা রচনার ফটোকপি সংগ্রহ করে নিতেন। ভালো করে, বেশি করে পড়তে বলতেন চলচ্চিত্র সংক্রান্ত রচনা,গ্রন্থ। সত্যজিত রায়ের ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইটি নিয়ে কিংবা ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা এবং বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাস নিয়ে কতবার যে আলোচনা করেছেন, আমাকে আরো ভিন্নভাবে দেখার, নানান মাত্রিকতায় ভাবার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন অসীম আগ্রহ নিয়ে, সেই দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়লেই আমার চোখে জল চলে আসে কখন যে আবেগে, টের পাই না। তাঁর মতোন এমন স্বার্থহীনভাবে ছোটদের ভালোবাসার জলে স্নাতক করতে পারার মানুষগুলো আজ কই গেলো? যে ক'জন মানুষ আমাকে মনন, ব্যক্তিত্বে ও সৃজনশীলতায় আকর্ষণ করেছিলেন হাই ভাই ছিলেন তাঁদের অন্যতম। মৃদুভাষি অথচ রসিক মানুষ ছিলেন। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জন সমৃদ্ধতর হয় বলেই বিশ্বাস করতেন। ফলে চিত্রালীর পাতায় তাঁর সরস এবং দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নোত্তরগুলোর মধ্য দিয়ে সবাইকে আকর্ষণ ও আপন করে নিতে পেরেছিলেন তিনি। তাছাড়া প্রায়ই তাঁকে একটা কথা বলতে শুনেছি, ‘A witty question makes a witty answer’.
 
৭.
আজকের দুই বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে আলোচিত জয়া আহসানের তখন আসা-যাওয়া এবং দীর্ঘ সময় অবস্থান নিয়মিত হয়ে উঠেছিলো একসময় দৈনিক ভোরের কাগজ হাউজের চারতলায়। কোন কারণে বিষন্ন জয়াকে হাই ভাই কন্যাস্নেহে সামনের চেয়ারে বসিয়ে গল্পের ঝাপি খুলে ধরতেন, আমি নিরবে তাদের পাশে এসে বসতাম, ঋদ্ধ হতাম নি:সন্দেহে। এ রকম আরো অনেক আলোকিত স্মৃতি জমে আছে মনের মন্দিরে। আমার দু’জন অকাল প্রয়াত পরম স্বজন ‘দলছুট’ সঞ্জীব চৌধুরী এবং ‘রোদ্দুর’ লতিফ সিদ্দিকীর প্রতি তাঁর নিবিড় টান কিংবা বিশেষ স্নেহানুকূল্য দৃশ্যমান হয়েছে আমার মতোন অনেকের কাছেই। তাঁর অনেক স্নেহভাজনই আজ দেশের স্বনামধন্য সাংবাদিক, লেখক – তারা নানা দেশে, নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছেন। চিত্রালীতে তাঁর কাছে লিখে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন অনেকেই।

৮.
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে ইমপ্রেস টেলিফিল্মে কাজ করার কারণে ১৯৯৮ সালে ভোরের কাগজ ছেড়ে দিলে হাই ভাই অখুশি হননি। তখনও আজকের বহুল জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশনার মুখ দেখেনি, কিংবা চ্যানেল আই-য়েরও জন্ম হয়নি। ফলে আজীবনের স্বপ্ন শিক্ষকতার পেশার টানে লেখাপড়ার প্রস্তুতির সুবিধার জন্যে পেশাগত অনিশ্চিয়তার জগত ছেড়ে দিলেও সংবাদ মাধ্যমের প্রতি মোহ, প্রেম, টান আমার মোটেই কমে না। সেই কারণে সুযোগ পেলেই প্রিয় ভবন ভোরের কাগজে চলে যেতাম, স্বজন সান্নিধ্যে সমৃদ্ধ হতাম। সেই সময়েও হাই ভাইয়ের পাশে বসে বিবিসির শিক্ষামূলক তথ্যচিত্র তৈরির, ডেভিড ফ্রস্টের নির্মাণ কৌশল কিংবা চার্লি চ্যাপলিনের বেদনামিশ্রিত হাস্যরসের মাধ্যমে সঠিক ‘মেসেজ’টি তুলে ধরার শিল্পকলা ও নন্দনতত্ত্ব নিয়েও অনেক আলাপনে অসম্ভব রকম উপকৃত হয়েছি। শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘সোনালি দরোজা’র জন্যে আক্ষরিক অর্থেই ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’ দায়িত্বপালনকালে, কিংবা নানা স্কিড, ডকুমেন্টরী নির্মাণের সময়েও চলে আসতাম হাই ভাইয়ের কাছে।তাঁর উচ্চারণ এবং কলমের ভাষা, দু’টোই ছিলো মনোগ্রাহী। হাই ভাইয়ের লেখাগুলো নিয়ে কোন গ্রন্থ সংকলিত ও প্রকাশিত হয়েছে কি না জানি না, না হয়ে থাকলে হওয়াটা জরুরি বিবেচনা করি।তাহলে আমাদের চলচ্চিত্রের সোনালি সময়ের ইতিহাসের স্বর্ণরেনুসমূহ কালের ধূলোয় হারিয়ে যাবে না বলেই বিবেচনা করি।

৯.
আমাদের বিনোদন সাংবাদিকতার উজ্জল নক্ষত্রদের অন্যতম, বহুল প্রচারিত, জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘চিত্রালী’র পাঠক-পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ(চিপাচস)-এর প্রধান উপদেষ্টা, চিত্রালীর 'আপনাদের চিঠি পেলাম'-এ নানা রকম প্রশ্ন এবং জিজ্ঞাসার অসম্ভব বৃদ্ধিবৃত্তিক সরসতায়, চিত্তাকর্ষৃক জবাব প্রদানের মধ্যদিয়ে ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের তরুণ-তরুণীদের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনা এবং শিল্পের, নান্দনিক সৃজনশীলতার সুস্থ বোধ বিনির্মাণের নায়ক, ‘উত্তরদা’ নামের আড়ালে ছড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে থাকা ঋদ্ধ মানুষটি, যার আসল নাম এ.টি.এম আব্দুল হাই, আমার মতোন আরো অনেকের প্রিয় মানুষ, প্রয়াত পরম স্বজন হাই ভাইয়ের মহাপ্রয়াণ দিনে কত কথা, স্মৃতিই না শব্দ-বাক্যে প্রাণ পেতে চায়। আর তাই বারংবার বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই নিরব সংস্কৃতি সাধককে, আলোচনার আলো থেকে অনেক দূরে থাকা অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বকে।

১০.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সিনেমা বিষয়ক যে কয়টা প্রত্রিকা বেশী জনপ্রিয় হয়েছিল তার মাঝে সাপ্তাহিক 'চিত্রালী' ছিল অন্যতম। বর্তমান বাংলাদেশে যাদের বয়স চালশে চল্লিশের বেশী এবং পত্রিকা পাঠে যাদের অভ্যাস ছিল, তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে এ সত্য জানা যাবে। ওই সময় চিত্রালী পড়তেন না এমন শিক্ষিত লোকের সংখ্যা প্রায় বিরলই ছিলো। সিনেমার নায়ক/নায়িকাদের বড় ছবি, তাদের সাপ্তাহিক কর্মকান্ড তুলে ধরতো চিত্রালী। সাপ্তাহিক চিত্রালী বের হত প্রতি শুক্রবার আর সে দিনই মুক্তি পেত নুতন কোন ছায়াছবি! আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি দিন ছিলো সে সময়কাল। সেই সাপ্তাহিক চিত্রালীর পাঠকদের জন্য দু’টি পৃষ্ঠা বরাদ্দ ছিলো, যাতে পাঠকরা ইচ্ছে করলে লিখতে পারতেন। পরবর্তীকালে চিত্রালীর পাঠক সংগঠন গড়ে উঠেছিল, নাম দেয়া হয় "চিপাচস"। চিত্রালীর এ পাতাগুলোর একটির নাম ছিলো- আপনাদের চিঠি পেলাম। পাঠকরা যে কোন বিষয় নিয়ে লিখতে পারতেন, আর উত্তর দিতেন একজন, নাম ছিলো ‘উত্তরদা’।চিত্রালীর জনপ্রিয়তার, পাঠকপ্রিয়তার অন্যতম আকর্ষৃণ ও কারণ ছিলো উত্তরদা’র এই পাতাটি।

১১.
‘উত্তরদা’ ওরফে হাই ভাই জগতের চিরায়ত নিয়ম মেনে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর অনুকরণীয় কর্ম ও জীবনের আলোকিত স্বাক্ষর, তাঁর মানবিক চেতনা ও সুরুচির জীবনাদর্শ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দৃঢ়ভাবে আস্থা স্থাপনের মধ্যদিয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যভিত্তিক বিনোদন সাংবাদিকতার ধারা প্রচলন,শিল্প-সাহিত্য,চলচ্চিত্র,নাটক তথা সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতির বিকাশে সুস্থ,সৃজনশীল ভাবনায় শিল্পবোধসম্পন্ন একটি তরুণ সম্প্রদায় গড়ে তোলার জন্যে উত্তরদার মতো একটি জনপ্রিয় অবস্থানকে কাজে লাগানো, ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তর পরবর্তী স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের উত্থানরোধ, সামরিক-স্বৈরাচার বিরোধী যাবতীয় আন্দোলনে-তিনি, উত্তরদা ওরফে হাই ভাই চিত্রালীর চিঠি-পত্রের পাতায় ব্যক্তিগত শিল্প চৈতন্য বোধ এবং রসালাপের বাইরে ইতিহাসের সত্যকথনকে অত্যন্ত সুকৌশলে যে কাজে লাগিয়েছেন সে কথা তাঁর পাঠকেরা অস্বীকার করেন না বলেই জানি। আমরা যতবেশী হাই ভাইয়ের মতো সংস্কৃতিবান, সম্পূর্ণ মানুষদেরকে অনুসরণ করবো, তাঁর কর্ম, চেতনা ও আদর্শ নিয়ে করবো জীবন চর্চা, তাতেই গড়ে উঠবে জঙ্গিবাদমুক্ত, মানবিক একটি পৃথিবী, সার্থক হবে হাই ভাইয়ের সৃজনীসংগ্রাম।

১২.
হাই ভাইকে নিয়ে আরো অনেক লেখার আছে। তিনি তারুণ্যের উচ্ছ্বাসভরা যে কোন উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা করতেন না বলেই জনপ্রিয় ব্যান্ড সংগীতের গায়ক জেমস-এর 'বাবা' গানের ভিডিওচিত্রে পিতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। আগ্রহীজনেরা প্রদত্ত লিংকটিতে গিয়ে হাই ভাইকে, তাঁর অভিনয়কে দেখতে পারেন।জানাতে পারেন শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।

১৩.
রশীদ হায়দারের ‘চিত্রালী’র চিত্রাবলী’ স্মৃতিকথায় পরিচয় মেলে হাই ভাইয়ের গভীর রসিকতা বোধের। রশীদ হায়দারের ভাষায়, ‘হামিদুল হক চৌধুরী (চিত্রালীর মালিক) সম্পর্কে একটা কথা বেশ চালু ছিল। লোকটি পেনি ওয়াইজ, পাউন্ড, ফুলিশ। পেছন দিয়ে হাজার হাজার টাকা বেরিয়ে যায় তিনি টের পান না, কিন্তু সামনে এক ফুট দেড় ফুট অব্যবহৃত নিউজপ্রিন্ট মেঝেয় কিংবা অযত্নে কোথাও পড়ে থাকলে, আর সেটা তার নজরে পড়লে রক্ষে নেই। নোয়াখাইল্যা ভাষায় গালাগাল শুরু করে দিতেন। যাক, হামিদুল হক চৌধুরীর কথা থাক এ পর্যন্তই। তবে ওই চিত্রালী অফিসেই তার ছেলে খালেদ হামিদুল হককে দেখেছিলাম একটা মূর্তিমান অপছন্দের মানুষ হিসেবে। খালেদ ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়ছেন। তিনি এসেছেন বাপের সাম্রাজ্য দেখতে; মাঝে মাঝেই আসতেন। এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়াতেন, নোয়াখাইল্যা-ঢাকাইয়া মিশিয়ে বাংলা বলতে চেষ্টা করতেন। তবে ইংরেজিটা বলতেন মাতৃভাষার মতো। সেই খালেদ একদিন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা কথা বলে আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন : আমি টেগোর পড়েছি। 
সম্ভবত পারু ভাই কিংবা হক ভাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাংলায়? 
নো নো! ইন ইংলিশ। হি ওয়াজ এ গুড রাইটার। হবু ব্যারিস্টার খালেদ হামিদুল হক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, শুনে উত্তরদা এটিএম আবদুল হাই, আমরা বলি এ্যাটম হাই, নিচু গলায় বললেন, 
শালাকে ভেজা জুতা দিয়ে পেটানো উচিত। 
পরে জানতে চেয়েছি, 
ভেজা জুতা কেন? 
ওতে গায়ে লাগে বেশি, দাগও পড়ে ভালো।’

১৪.
আবারো প্রিয় হাই ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, আপনি আছেন আমাদের মাঝে, আমাদের অন্তরে, মন মন্দিরে, প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে, ভালোবাসার আলোয়।
(তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত